E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চাঁদপুরের রাস্তা ধ্বংস করছে যন্ত্রদানব ট্রাক্টর !

২০১৪ অক্টোবর ১৮ ১৪:৪৯:০২
চাঁদপুরের রাস্তা ধ্বংস করছে যন্ত্রদানব ট্রাক্টর !

চাঁদপুর প্রতিনিধি : কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত গ্রামীণ রাস্তাগুলো অতি অল্প সময়েই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। রাস্তা তৈরি বা সংস্কারের পর মাস না যেতেই সে রাস্তা ভেঙ্গে একাকার হয়ে যায়। আর এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে ট্রাক্টর। অবাধে ট্রাক্টর চলাচল করায় রাস্তাগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গ্রাম এলাকায় ট্রাক্টর বেশিরভাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে ব্রিক ফিল্ডের ইট পরিবহনে। বেপরোয়া গতিতে ট্রাক্টরের চলাচলে গ্রামীণ জনপদ মানুষের আশীর্বাদের পরিবর্তে দুর্ভোগ এবং কোনো কোনো জায়গায় মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়। শুধু রাস্তাই নয়, বিভিন্ন সময় মানুষের জানও নিয়ে নেয় এই ট্রাক্টর। এ ট্রাক্টর চলাচলকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে ব্যাপারে প্রশাসন, সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ এবং ব্রিকফিল্ড মালিকদের সমন্বয়ে সভা করার সিদ্ধান্ত রয়েছে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের। সহসা এই সভা হবে বলে জানিয়েছেন ওই সভার প্রধান উদ্যোক্তা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিক।

চাঁদপুর জেলার আট উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য গ্রামীণ সড়ক। মানুষের প্রয়োজনে প্রতি বছরই নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয় এবং নির্মিত রাস্তা সংস্কার করা হয়। এর জন্য সরকারের ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা। গ্রামের রাস্তার মধ্যে পাকা সড়ক ও কাঁচা সড়ক উভয়ই রয়েছে। মানুষের জীবন মান উন্নয়নে এই সড়ক ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে জন্য সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা জনগণের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। কিন্তু এই আশীর্বাদকেই মানুষের দুর্ভোগে পরিণত করে ফেলে ‘ট্রাক্টর’ নামের অবৈধ যান। এর প্রকৃত নাম হচ্ছে ‘পাওয়ার টিলার।’ প্রযুক্তির ব্যবহারে এটি জমি চাষাবাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। অথচ এটির ইঞ্জিনের পেছনে বড় ট্রলি লাগিয়ে এটিকে সড়কে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই যানবাহনটি সড়কে চলাচলের কোনো অনুমোদন নেই। অথচ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই অবৈধ যানটি সড়কে চলাচল করছে।

প্রায় দেড় যুগ যাবৎ এই ট্রাক্টর চাঁদপুরের সড়কে চলাচল করছে। প্রথম দিকে এর চলাচল সীমিত হলেও ক্রমান্বয়ে এটির ব্যবহার বাড়তে বাড়তে এখন ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শহর-গ্রাম সর্বত্রই এখন ট্রাক্টরকে মালামাল পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই যানবাহনটির যেমনি সড়কে চলাচলের জন্যে নিজের কোনো বৈধতা নেই, তেমনি এর চালকদের অধিকাংশেরই কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং অভিজ্ঞতা নেই। অল্প বয়স্ক ছেলে এবং আনাড়ি চালকরাই ট্রাক্টরের চালক। এই ট্রাক্টর দ্বারা রাস্তা ধ্বংস করা ছাড়াও অনেক মানুষও খুন হয়েছে। দেখা গেছে যে, রাস্তার পাশে থাকা দোকানের ভেতর ঢুকে পড়েছে, পথচারীকে চাকার নিচে পিষ্ট করে দিয়েছে এবং অন্য যানবাহনের সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দিয়েছে এই ট্রাক্টর। এতে করে প্রাণহানিসহ অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এতোসব ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও এই অবৈধ যানবাহনটির ব্যাপারে কারো কোনো মাথা ব্যথা কেনো নেই সে প্রশ্নের উত্তর রহস্যময়। আর প্রশাসনই বা নীরব কেনো সে জিজ্ঞাসা জনগণের।

ট্রাক্টরের ব্যাপক ব্যবহারের আগে দেখা গেছে যে, ঠেলাগাড়ি দিয়ে ব্রিকফিল্ডের ইট পরিবহন করা হতো। এর দ্বারা রাস্তার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হতো না এবং দুর্ঘটনাও তেমন একটা ঘটতো না। কিন্তু এই ঠেলাগাড়ি বাদ দিয়ে ট্রাক্টর দিয়ে মালামাল পরিবহন করতে গিয়ে রাস্তাঘাটও ধ্বংস হচ্ছে, মানুষও মারা যাচ্ছে। এই ট্রাক্টরের ইঞ্জিনের পেছনে যে বড় ট্রলি রয়েছে এই ট্রলির নিচের চাকাগুলোই বড় ভয়ঙ্কর। এই চাকাতেই রাস্তা ধ্বংস করে ফেলা হয়। ট্রাক্টরের দ্বারা এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি উঠে আসে গত মাসে জেলা আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় কমিটির সভায়। ওই সভায় এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও চাঁদপুর সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী এ জেলার ব্রিকফিল্ড মালিকদের নিয়ে ট্রাক্টর চলাচল বিষয়ে সভা করবেন। এ বিষয়ে গতকাল কথা হয় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে। তিনি জানান, সহসা আমরা মিটিং করবো।

হাজীগঞ্জে যন্ত্রদানব ট্রাক্টর প্রতিনিয়ত গিলে খাচ্ছে গ্রামীণ অবকাঠামোয় নির্মিত পাকা ও কাঁচা সড়কগুলো। যার কারণে সরকারকে প্রতিবছর একই সড়কে বারবার মেরামতের জন্য বরাদ্দ দিতে হয়। আবার এদের বেপরোয়া চলাচলের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। চাষাবাদের জন্য এদেশে প্রযুক্তির এ যন্ত্রটি আমদানী করা হলেও সড়কে চলাচলে কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু তা মানছে না ট্রাক্টর মালিক কিংবা চালকরা।
সরজমিনে দেখা যায়, উপজেলার চতুর্দিকে গ্রামীণ অবকাঠামোয় নির্মিত পাকা ও কাঁচা সড়কগুলোর অবস্থা একেবারে বেহাল। বিশেষ করে মাটির সড়কগুলোতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে আছে। আর পাকা সড়কগুলোর কিছু অংশ ভালো আবার কিছু অংশ একেবারে খারাপ। এ সকল সড়কে যান চলাচল অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

এর মধ্যে সবচে খারাপ অবস্থা সড়কগুলোর মধ্যে হাজীগঞ্জ-ধড্ডা-রঘুনাথপুর, নাসিরকোট-বামনগাঁও-সাহেব বাজার, বলাখাল-রামচন্দ্রপুর বাজার ভায়া ফরিদগঞ্জের বাসারা বাজার, রামগঞ্জ-হাজীগঞ্জ-কচুয়া-গৌরীপুর সড়কের হাজীগঞ্জ বাজারস্থ চৌরাস্তার বিশ্বরোড এলাকার উত্তর অংশ একই সড়কের রান্ধুনীমুড়া এলাকা, মনতলা বাজার এলাকার প্রধান সড়ক লেপ্টে যাওয়াকে অতিরিক্ত বালি বহনকে দায়ী করছে সড়ক বিভাগ। আবার একই সড়ক হতে চালিয়াপাড়া থেকে দরগা বাজার হয়ে ডাটরা শিবপুর বাজার পর্যন্ত এবং একই সড়কের সহযোগী সড়কসমূহ। হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া রামচন্দ্রপুর বাজারের পূর্ব অংশ, বেলচোঁ বাজার হয়ে রামচন্দ্রপুর বাজার পর্যন্ত মাটির সড়ক, আলীগঞ্জ হাটিলা সড়ক হয়ে বেলঘর বলিয়া ভায়া হাজীগঞ্জ কচুয়া সড়কের মধ্যবর্তী এলাকা সমূহসহ উপজেলার সকল কাঁচা সড়কে ট্রাক্টর চলাচলের কারণে সিএনজি স্কুটারসহ সকল ধরনের যান চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) আশরাফ জামিল বলেন, আমাদের গ্রামীণ অবকাঠামোয় নির্মিত কাঁচা-পাকা সড়কগুলো নষ্ট হবার প্রধান কারণ ট্রাক্টর। সড়কের যত ক্ষতি এরাই করে।

হাজীগঞ্জ থানার ট্রাফিক সার্জেন্ট সারোয়ার হোসেন জানান, এ থানায় ৬০ থেকে ৭০টি স্থায়ী ট্রাক্টর রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মৌসুমে কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আরো ২০-৩০টি ট্রাক্টর ভাড়ায় আনা হয়ে থাকে। সর্বসাকুল্যে এ উপজেলায় শতাধিক ট্র্রাক্টর চলাচল করছে।

রেনেটা ঔষধ কোম্পানীর হাজীগঞ্জে কর্মরত মেডিকেল প্রমোশন অফিসার মনির হোসেন জানান, চাকুরির সুবাদে উপজেলার সকল বাজারে যেতে হয়। এ যাওয়া-আসার পথে প্রতিনিয়ত ট্রাক্টরের কারণে বিভিন্ন সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়। এতোটাই দ্রুত বেগে সড়কে ট্রাক্টর চালায় যা বাস্তবে না দেখলে বুঝা মুশকিল। আবার বালি বহনের সময় ২/১টি ছাড়া কোনো গাড়িই ট্রিপল ব্যবহার করছে না। আর আমাদের ধারণা কোনো ট্রাক্টর চালকেরই কোনো ধরনের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।

‘গ্রামীণ অবকাঠামোয় নির্মিত পাকা ও কাঁচা সড়ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যে ৯০ ভাগ দায়ী যন্ত্রদানব ট্রাক্টর’ এক বাক্যে বললেন হাজীগঞ্জের ১১নং হাটিলা পশ্চিম ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন লিটন। আরেক প্রশ্নে এ জনপ্রতিনিধি বলেন, ট্রাক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমরা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অনেক বলেছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আর এ জন্য আমি আমার ইউনিয়নে বর্ষা মৌসুমে ট্রাক্টর চলাচলে বিধি নিষেধ দিয়ে মাইকিং করেছিলাম। ট্রাক্টর চালক ও মালিকগণ এসব তুচ্ছ ভাবেন। যার কারণে এলাকার জনগণ বর্ষা মৌসুমে ট্রাক্টর চলাচলে বাধা দিয়েছিলো।

হাজীগঞ্জের দক্ষিণের সীমান্তবর্তী এলাকা উপজেলার ১০নং গন্ধর্ব্যপুর ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন জানান, আমার এলাকায় ৯০ ভাগ সড়ক মাটির সড়ক। এগুলো নষ্ট হবার একমাত্র কারণ এ ট্রাক্টর। আমরা সরকারি বরাদ্দ, বিভিন্ন প্রজেক্টের নারী কর্মী দ্বারা সড়ক মেরামত করে লাভ হচ্ছে না। কারণ এক পাশ দিয়ে মাটির কাজ হচ্ছে আরেক পাশ দিয়ে ট্রাক্টর গিয়ে সড়ককে পূর্বের অবস্থানে নিয়ে যায়। আর আমাদের সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বর্ষায় অতিমাত্রায় ট্রাক্টর চলাচলের কারণ। কোনো সড়ক দিয়ে পর পর ৪-৫টি ট্রাক্টর যাওয়া-আসা করলেই ঐ সড়কে অন্য পরিবহন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর ট্রাক্টর চলাচল বন্ধ করে দিলে কোনো সড়ককেই সহসায় মেরামত করতে হবে না বলে আমি মনে করি।

উপজেলার বলাখালে ইট ও বালির ব্যবসা করেন এ রকম ক’জন নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিশ্চিত করে বলেন, ট্রাক্টর চালকদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন মাদক গ্রহণের সাথে জড়িত। এরা কর্মচারীদের মাল ভরতে দিয়ে নিজেরা গাঁজা সেবনে লেগে পড়ে। আমাদের মালামাল পরিবহন করে বিধায় আমরা দেখেও কিছু বলতে পারি না।

হাজীগঞ্জ উপজেলার মতো সব উপজেলার গ্রামীণ রাস্তাগুলোরই এমন বেহাল অবস্থা একমাত্র ট্রাক্টরের কারণে। প্রশাসনের কাছে জনগণের প্রত্যাশা যে কোনো মূল্যে সড়কে ট্রাক্টর চলাচল বন্ধ করা হোক।

(এমজে/এএস/অক্টোবর ১৮, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test