E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘রাজনীতি সন্ত্রাসীদের হাতে, ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হওয়া উচিত নয়’

২০১৯ সেপ্টেম্বর ২৫ ২২:৩২:৪২
‘রাজনীতি সন্ত্রাসীদের হাতে, ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হওয়া উচিত নয়’

বিসিএস ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে মনিষা এখন গরীবের ডাক্তার ও বাম রাজনীতিক। পুরো নাম মনিষা চক্রবর্তী। তিনি বরিশাল শহরের চ্যাটার্জী লেনে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযদ্ধে ৯নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাসুল হিসেবে ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ডা. মনিষার দাদা এডভোকেট সূধীর কুমার চক্রবর্তীকে পাকবাহিনীরা হত্যা করে।

পিষেমশাই লেখক দ্বিজেন শর্মার সংস্পর্শে থেকে ডা. মনিষা বেড়ে ওঠেন। মনিষা বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনাকালে তিনি বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ৩৪ তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন পদে নিয়োগ পেলেও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেননি। বর্তমানে তিনি বরিশাল বাসদের সদস্য সচিব। বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থেকে তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে গরিব মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।

সম্প্রতি ডা. মনিষা চক্রবর্তী জামালপুরের মেলান্দহে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী-চিকিৎসাসেবা এবং বিনামুল্যে ওষুধ বিতরণ করতে আসেন। তিনি আদ্রা ইউনিয়নের কুচিয়ামারা থেকে ফিরে বাঘাডোবা থুরি এলাকায় পৌঁছেন।এসময় মনিষার সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন গণমাধ্যম কর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি মেলান্দহ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মো. শাহ্ জামাল।

শাহ্ জামাল: বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আপনার অভিমত কী ?

ডা. মনিষা: লুটপাটের স্বর্গ রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা খুব দক্ষতার সাথে পরিচালিত হচ্ছে। জনগণের মধ্য দিয়ে যে প্রতিরোধটা করা দরকার, সেই জায়গাটায় আমরা চেষ্টা করছি। আমরা মনে করি জনগণ ছাড়া লুটপাটের পরিবর্তনটা আনা আসলে খুবই কঠিন। সেই জায়গায় জনগণকে নিয়ে কাজ এবং সংগঠিত করার চেষ্টা করছি।

শাহ্ জামাল: কৃষকদের নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন ?

ডা. মনিষা: আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিক কারোর প্রতিই সহানুভূতি পোষণ হয় না। আমরা দেখি কৃষক যখন ধানের দাম পান না। তখন শাসকদের মুখ থেকেও নানা রকম ব্যাঙ্গাত্বক কথাবার্তা শুনি। মর্মান্তিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে যে মানুষরা যাচ্ছেন, সেটাকেও তারা গুজব বলে উড়িয়ে দিতে চান। কৃষকদের জন্য আমরাই ধারাবাহিক আন্দোলন করেছি। বাংলাদেশের বামপন্থিরা ছাড়া এখানে কোন রাজনৈতিক সংগঠন সোচ্চার ছিল না। ঢাকায় ঘেরাও কর্মসূচি পালন থেকে শুরু করে একেবারে উপজেলা পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করেছি। ইউনিয়ন পর্যায়ে ক্রয় কেন্দ্র খুলে কৃষিপণ্য ক্রয়ের জন্য আমাদের সর্বোচ্চ সংগ্রাম করছি। আসলে সরকার কর্তৃক কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি একেবারেই শুণ্যের কোঠায়। ফড়িয়া এবং মধ্যসধ্যভোগিদের পক্ষেই দৃঢ অবস্থান দেখি। যারা পকেট কেটে বড় লোক হন তাদের পক্ষেই সরকারের অবস্থান দেখে থাকি।

শাহ্ জামাল: প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা দাঙ্গার বহিপ্রকাশে বাংলাদেশের উপর কোন প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ?

ডা. মনিষা: অবশ্যই। ভারতের পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা দেখছি যে, কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে মোদি সরকারের উগ্র হিন্দুত্ববাদ সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মুদি সরকার সম্পুর্ণভাবে সচেষ্ট। কাশ্মিরে যে স্পেশাল স্ট্যাটাস ৩৭০ ধারা বাতিল করে একেবারে কাশ্মিরকে সরকারের নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করছে। এই ইস্যুটি শুধু ভারতজুড়ে নয়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র পাকিস্তানেও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও কাশ্মিরের প্রতি এখানকার সহানুভূতি তৈরি হচ্ছে। এই সহানুভূতি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। সমস্যা হচ্ছে মুদি সরকারের হিন্দুত্ববাদ এজেন্ডা ওই দেশের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যেমন সমস্যার সৃষ্টি করেছে, এই দেশে এইটার প্রভাব পড়েবে না-এর কোন গ্যারান্টি কেও দিতে পারবে না। তবে বাংলাদেশের মানুষ অসম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেন। আমরা স্বাধীন হয়েছি ৭১ দিয়ে। আর পাকিস্তান-ভারত স্বাধীন হয়েছে ৪৭ দিয়ে। এটি একটা সাম্প্রদায়িক বিভাজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে সেকুলারিজম একেবারে গ্রথিত আছে। সেই হিসেবে বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষকে খুব সহজেই উস্কানি দিয়ে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাবে না। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে। বালাদেশে যাতে সম্প্রীতি বজায় থাকে। আর কাশ্মিরিদের পক্ষে আমরা অবশ্যই দাঁড়াবো। সেটা কোন উস্কানির মধ্য দিয়ে নয়। আমরা অবশ্যই কাশ্মিরের নির্যাতিত মানুষের জন্য দাড়াব। কারণ যেকোন নিপীড়িত মানুষের জন্য দাড়ানো একটি রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক দায়িত্ব।

শাহ্ জামাল: বর্তমান আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কেমন মনে হচ্ছে ?

ডা. মনিষা: বরগুণায় রিফাত হত্যা দেখছেন। বিশ্বজিৎ থেকে যদি শুরু করি। তাহলে দেখব প্রত্যেক ঘটনা ক্ষতাসীন দলের ছত্রছায়ায় ঘটছে। এই ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটানোর স্পর্ধা-সাহস একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের, যারা সন্ত্রাসী তাদেরই আছে। প্রচন্ড মাত্রায় এটি দিন দিন বাড়ছে। ক্ষমতা টিকিয়ে থাকার জন্য একদম জেলা পর্যায়ের নেতারাও একধরণের ফ্রাংকিন্স স্টাইল তৈরি করছেন। নয়ন বন্ডের মতো একজন ২০/২২ বছর বয়সের ছেলেকে মাদকের সম্রাট বানানো হয়েছে। তাকে খুনি-সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে। সেটিতো রাজনীতির প্রয়োজনেই বানানো হয়েছে। ক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এই জায়গায় এনেছে। আমরা মনে করি ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যে সন্ত্রাসীদের আধিপত্ত, ক্ষমতার রাজনীতির প্রোডাকশন। আমরা মনে করি রাজনীতি কখনো সন্ত্রাসীদের হাতে, ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হওয়া উচিত নয়। জনগণের জন্যই রাজনীতিটা হওয়া দরকার। জনগণের পক্ষে দাড়িয়ে যদি কেও রাজনীতি করে, তখন রাজনীতির সন্ত্রাসীদের পোষার দরকার হয় না। আমাদের সরকার সম্পূর্ণ জনগণের বিপক্ষে দাড়িয়ে রাজনীতি করছেন। আগের সরকাররাও করেছেন। ফলে এই ধরণের রাজনীতিতে সন্ত্রাসীদের পেলে পোষে বড় করার প্রয়োজন হয়ে থাকে।

শাহ্ জামাল: আইনশৃংখলা বাহিনীদের কেও ওেক অপরাধে জড়িত হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার কি অভিমত?

ডা. মনিষা: ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনটাই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। একটা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র যখন নষ্ট করে দেয়া হয়। সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি যেমন নির্বাচনে দেখেছি। সেই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চারিত্রিক গুণাবলী আশা করাটা... আমরা দেখছি দিন দিন সেটা তলানীতে যাচ্ছে। যেমন খুলনা রেলস্টেশনের ওসি থানার মধ্যে বসে ৫ জন মিলে একজন নারীকে ধর্ষণ করলো। তাহলে আমরা কোথায় যাচ্ছি! আমাদের বাজেটের বড় একটা অংশ এই বাহিনীর পিছে ব্যায় হচ্ছে। এই বাহিনী যদি আমাদের নিরাপত্তা না দিতে পারে, আমাদের টাকায় তাদের বেতন দিতে হচ্ছে। দিন দিন তাদের বেতন বাড়ছে। সুবিধাও বাড়ছে। যদি এই বাহিনী নিরাপত্তা দিতে নাপারে, তাহলে জনগণের মধ্যেই এই সচেতনতা বাড়ানো দরকার। মূলত: জনগণের সচেতনা শক্তিশালী হলে এগুলোকে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

শাহ্ জামাল: অনেকেই মন্তব্য করতেন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধি করলে হয়ত দুর্নীতি বন্ধ হবে। সরকার বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধিও করেছে। কিন্তু দুর্নীতি কমছে না। এ থেকে মুক্তির কোন পথ আছে বলে মনে করেন?

ডা. মনিষা: বিষয়টা আসলে এইভাবে ব্যাখ্যা করাটাই ঠিক না। আমরা মনে করি যখন দুর্নীতি একেবারে উপর মহল থেকে আসে, তখনি দুর্নীতিটা নিচ পর্যন্ত ছড়াতে পারে। যদি দুর্নীতি স্টাবলিশ না হতো; তাহলে কর্মচারিদের যে পরিমান বেতনই থাকুকনা কেন, ঘুষ বা দুর্নীতির সাথে যুক্ত হবার চিন্তাও করতেন না। মন্ত্রী থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত ঘুষ খাওয়ার সংস্কৃতিটা সবাই মিলেই এটা স্টাবলিশ করে। সে ক্ষেত্রে বেতন-ভাতাটা সেকেন্ডারি বিষয়। দীর্ঘ দিন থেকে যে প্র্যাক্টিস বা দুর্নীতির ব্যবস্থাকে তৈরি করেছেন। বেতন বাড়ালোও; যদি ব্যবস্থাটার পরিবর্তন নাহয় তাহলে দুর্নীতির চিত্রটা আমরা এমনটাই দেখতে পাব।

শাহ্ জামাল: বিরোধী দল বিএনপি বলছে সরকার এখন পুলিশ নির্ভর। এই কথার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করেন ?

ডা. মনিষা: এইটা শুধু বিএনপিই নয়। আমরাও বলছি। আবার এটাই বলছি, সরকার যখন জনগণের বিপক্ষে দাড়িয়ে দেশ পরিচালনা করে; তখন পুলিশ-সেনাবাহিনী এদের উপরই নির্ভরশীল হবে। আগে যে ন্যূনতম ভোটের প্রয়োজন হতো। এখন আর সেটার প্রয়োজন পড়ছে না। জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার জায়গাটা প্রায় শুণ্যের পথে। সেক্ষেত্রে জনগণের আন্দোলনকে থামিয়ে রাখতে পুলিশ-র‌্যাব-আর্মির পিছনে সরকারের বড় মনোযোগ আমরা দেখতে পাই। এদের প্রতি একধরণের নির্ভরশীলতাও দেখতে পাই। তবে এ কথাও সত্য, এই প্র্যাক্টিসটি শুধু এই সরকারই করে নাই। এর আগে বিএনপিকেও পুলিশের উপর নির্ভরশীল হয়ে দেশ চালাতে দেখেছি। আমরা মনে করি এই দু’টি দলের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প শক্তির মধ্য দিয়ে জনগণের পক্ষে দাড়াবে। এরকম একটা শক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাগ্যটা পরিবর্তন করা সম্ভব।

শাহ্ জামাল: জোটবদ্ধ নির্বাচনের প্রভাবে নেতৃত্ব সংকট-যোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার কী ভাবনা?

ডা. মনিষা: জোটবদ্ধ নির্বাচন বিষয় নয়। জনগণের আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নেতৃত্ব তৈরি হয়। জনগণের পাশে দাড়ানোর মধ্য দিয়েই জনগণের মধ্য থেকেই নেতা ওঠে আসে। জনগণের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিগত দিনে খুবই শোচনীয় মাত্রায় ছিল। আমরা মনে করি বামপন্থিদের মধ্যে যতটুকু আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, তারমধ্যে কৃষক বলেন, ছাত্র বলেন, শ্রমিকদের বলেন, নারীদের বলেন, সব কয়টি আন্দোলন কিন্তু বামপন্থিরা পরিচালনা করে। সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি যে, আন্দোলন থাকলে নেতৃত্ব থাকবে। জনসম্পৃক্ততা থাকলে নেতা ওঠে আসবে। কিন্তু সেটা নাথাকলে দলীয় কোন্দল থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test