E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পথের ধুলো থেকে: পর্ব-৫

সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলো একে অপরের পাশে আসছেন, সামাজিক মানুষেরাও শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতায় তাদের ভরিয়ে তুলছেন 

২০২১ জুলাই ১৭ ১৪:১১:১০
সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারগুলো একে অপরের পাশে আসছেন, সামাজিক মানুষেরাও শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতায় তাদের ভরিয়ে তুলছেন 

সাইফুল ইসলাম


বিভিন্ন রাস্তা ফোর লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, এ জন্য খুশি সাধারণ মানুষ। কিন্তু বিপত্ত্বি বাধলো সিরাজগঞ্জ-বগুড়া সড়কের শিয়ালকোল এলাকায়। সেখানে শহিদ শিবচরণ রবিদাসের সমাধি এবং তার কিছু দূরেই একটি গণহত্যার স্থান। সেখানে হত্যা করা হয়েছিল শিক্ষক-ছাত্রসহ ৭ জনকে। মানে মুক্তিযুদ্ধের সে স্মৃতিটিহ্ন উচ্ছেদ হচ্ছে সে ফোর লেনে। সেই সঙ্গে উচ্ছেদ করা হবে কয়েকটি পরিবারকে যারা প্রায় দুই শ’ বছর ধরে বসবাস করে আসছিল এই রাস্তার পাশে। তারা সম্পূর্ণই ভূমিহীন। এসব পরিবারের মধ্যে শহিদ শিবচরণ দাসের পরিবারও রয়েছে। তাদের উচ্ছেদের জন্য বুলডোজারও পৌঁছে গেছে এলাকায়। জনপথ বিভাগের কর্মচারিদের মাধ্যমে সমাধি ও শহিদ পরিবারকে উচ্ছেদের খবর প্রচার হয়ে পড়ে এলাকায়। এ পরিস্থিতিতে শহরের সংগঠকদের কাছে দৌড়ে আসে শিয়ালকোল এলাকার সংগঠক- শহিদুল আলম মেম্বার, আবুল হোসেন মিস্ত্রি, আব্দুল আজিজ মেম্বারসহ শহিদ পরিবারের সদস্যরা। তারা অনুরোধ করে বিভিন্ন নেতা ও প্রশাসনের কাছে ধর্না দেওয়ার জন্য। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় পরের দিনই এলাকায় মানববন্ধন এবং তার পরের দিন শহরে মানববন্ধন করার। জনগণের মধ্যে জানান দিয়ে তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের জানানো এবং প্রশাসনকে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

শিয়ালকোল বাজার- বিসিক শিল্পনগরী-শহিদ এম. মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের সামনে ‘শহিদ সমাধি উচ্ছেদ না করা এবং ভূমিহীন শহিদ পরিবারকে পূণর্বাসনে’র দাবিতে বেশ বড় মানববন্ধন হয়। পরের দিন একই দাবির সমর্থনে বাজার স্টেশনে মানববন্ধন হয়। সাংবাদিকেরা তৎপর হয়ে ওঠেন। সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতীয় দৈনিকগুলো। সংবাদ প্রচার করে প্রধান প্রধান টিভি চ্যানেল। বিভিন্ন মাধ্যমে এ খবর পৌঁছে যায় তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে। একই সময়ে তার সফরসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো সিরাজগঞ্জ অঞ্চল। দুএক দিনের মধ্যেই তিনি সিরাজগঞ্জে এসে শহিদুল আলম মেম্বার, আবুল হোসেন মিস্ত্রি প্রমুখ স্থানীয় সংগঠকদের ডেকে নেন সার্কিট হাউজে। সংগঠকেরা তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। একই সময় মন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন সিরাজগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রাশাসক কামরুন্নাহার সিদ্দিকী। তার উপস্থিতিতে মন্ত্রী মহোদয় মনোযোগ দিয়ে শোনেন সংগঠকদের দাবির কথা। সঙ্গে সঙ্গেই জেলা প্রশাসককে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়- এ সময়ে এ ঘটনা ঘটলে আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুন্ন হবে। তিনি শহিদের সমাধিকে রক্ষা এবং যে কোনও স্থানে শহিদ পরিবারকে পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন [২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া একটি বাড়ি পেয়েছেন শহিদ শিবচরণ জলদাসের এক ছেলে।]

একই আন্দোলন করতে গিয়ে আরো একটি ঘটনা সংগঠকদের নজর এড়ায় না। বাজার স্টেশনে আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে আসেন বিভিন্ন এলাকার শহিদ পরিবারের সদস্যরা। তখন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান তারা। জানতে পারেন পরস্পরের দুঃখকষ্ট পারিবারিক জীবন-যাপনের কথা। এখানেই পরিচয় ঘটে বাজার স্টেশন হরিজন কলোনির শহিদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিয়ালকোল অঞ্চলের সংগঠকদের। শিয়ালকোলের অন্যতম সংগঠক শহিদুল আলম মেম্বার জানতে পারেন হরিজন কলোনির চম্পা বাসফোড়ের কর্মহীনতার কথা। তিনি চম্পা বাসফোড়কে পরের দিনই যেতে বলেন শিয়ালকোলে। কারণ, তিনি জানতেন যে, শিয়ালকোলের আল-মাহমুদ স্কুল অ্যান্ড কলেজে একজন ঝাড়ুদার খুঁজছে। পরের দিন চম্পা সেখানে গেলে প্রিন্সিপালকে শহিদ পরিবারের সদস্যের কথা বলায় খুব সহজেই তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তিনি এখনো সেখানে কলেজ শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছে শহিদ পরিবারের সদস্য হিসেব সন্মানিত হয়ে কাজটি করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, পাশের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে কোনও সাহায্য সহযোগিতার সুযোগ এলেই চেষ্টা করা হয় এই শহিদ পরিবারকে সহযোগিতা করার। এ ভাবেই দরিদ্র শহিদ পরিবার সন্মানিত হতে থাকেন।

ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছিল এক ঝাঁক নবীন-প্রবীন কর্মীসমর্থক। আগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলা আর শেখানোই ছিল প্রধান প্রবণতা। আর এই শেখানোর দায়িত্ব পড়তো প্রধাণত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। অনুসন্ধান সংগঠকদের ধারণা গড়ে উঠতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অভিজ্ঞতাকেই ইতিহাস হিসেবে বর্ণনা দেন। কিন্তু তারা মনে করেন যে, মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ভূমিকা আলোচিত না হলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কখনোই রচনা করা সম্ভব হবে নয়। তখন সংগঠকেরা মনে করতে শুরু করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ করতে জনগনের, শহিদ পরিবারের কথা শোনা এবং তা-ও লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। এ কাজে মনোযোগি হওয়ার উদ্যোগ নেন সংগঠকেরা।

বেশ ভালো ভাবেই চলছিল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সাধারণের মধ্যে জাগিয়ে তোলার কাজ। তখনই মহামারী করোনার বিস্তৃতি ঘটতে শুরু করে বাংলাদেশেও। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সারাদেশে ঘোষণা করা হয় লকডাউন। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, কলকারখানা, যানবাহন বন্ধ হয়ে যায়। অন্য সব কিছুর সঙ্গেই স্থবির হয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধ অনুসন্ধানের কাজও। সংগঠকদের একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝতে সময় নিতে হয় প্রায় এক মাস। এই এক মাস সংগঠকেরা পরস্পর থেকে প্রায় বিচ্ছিহ্ন হয়ে পড়েন। মোবাইল ফোনে কিছু কিছু যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়, তা-ও প্রায় না রাখার শামিল। বিভিন্ন এলাকার জনগণের সঙ্গেও যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে করোনা সম্পর্কে যখন ধারণা গড়ে উঠতে থাকে তখন সংগঠকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কারও কারও সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মুখোমুখী বসা সম্ভব হতে থকে। এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়, তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা মেনে নিতেই হয়। লোকালয়ের সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্ভব হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রধাণত সংগঠকদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যারা যারা নিজ দায়িত্বে বৈঠকের আয়োজন করে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, অনির্ধারিত ভাবে হলেও মাঝে মাঝে সক্রিয় সংগঠকেরা কাজের সমন্বয় করে নেবে। এতে সংগঠকেরা একেবারে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ার চেয়ে নিভু নিভু হয়ে চলার চেষ্টা থাকে, অন্তত যারা সক্রিয় থাকতে চান তারা কাজটি ভিন্ন পরিস্থিতিতেও চালিয়ে নিতে থাকেন।

আর একটি বিষয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তা হলো লেখালেখি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত লেখালেখি স্থানীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশের ব্যবস্থা করার। বিভিন্ন বিয়য় নিয়েও আলোচনা হতে থাকে পরস্পরের মধ্যে। আগের ‘মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধস্মৃতি’ ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ ‘শহিদ পরিবার’ বিষয়বস্তু তো আছেই। আরও কী কী শিরোনাম এর সঙ্গে যুক্ত করা যায়, তার ভাবনা শুরু হয়। এ বিয়য়ে আহ্বায়ককে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয় যাতে স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন লেখা প্রকাশের। ‘সাধারণের চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘শহিদ পরিবার’ নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করা না গেলেও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার বই কেনার প্রতিশ্রুতিতে ঢাকার বেহুলা বাঙলা প্রকাশন প্রকাশ করে ‘১০ মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধস্মৃতি’ ১ম খণ্ড । করোনা মহামারীর মধ্যে অন্তত এটুকু সফলতাও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে থাকা সংগঠকদের পাথেয় হয়।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test