E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পথের ধুলো থেকে : পর্ব-১২

গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি জনগণের সাহস বাড়ায়, স্বাধীনতা বিরোধীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক 

২০২১ আগস্ট ২৯ ১৫:৫২:০২
গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি জনগণের সাহস বাড়ায়, স্বাধীনতা বিরোধীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক 

সাইফুল ইসলাম


বিএলএফ কেন্দ্র থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয় কে কোন এলাকায় কাজ করবেন। মোটা দাগে ভাগ হয় সিরাজগঞ্জ শহর থেকে উত্তর দিকে উত্তরাঞ্চল আর দক্ষিণে দক্ষিণাঞ্চল। পুরো টিমের লিডার নির্বাচিত হন মোজাফ্ফর হোসেন মোজাম। ডেপুটি লিডার হন ইসহাক আলী। দক্ষিণাঞ্চলের লিডার আব্দুল সামাদ [বেড়া-পাবনা] ডেপুটি লিডার আব্দুল আজিজ মির্জা [বংকিরহাট-উল্লাপাড়া}। টিমভূক্ত থাকেন বিমল কুমার দাস [কামারখন্দ], আব্দুল বাকী মির্জা [শাহজাদপুর], ইফতেখার মবিন পান্না [সলপ-উল্লাপাড়া]। এদের প্রত্যেকেরই স্ব স্ব এলাকায় গণসংগঠণ গড়ে তোলার কথা। সেই সংগঠন থেকে সাহসী এবং রাজনীতি সচেতন, পিছুটানহীন কর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাহিনী গঠণের কথা বলা হয়। প্রথম দিকে সে চেষ্টাও করা হয় বলে লেখক-সংঠকদের সঙ্গে টিমভূক্তদের  আলাপচারিতায় জানা যায়। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের সবাই পলাশডাঙ্গা ভুক্ত হয়ে নিজেদের বিএলএফ পরিচয় হারিয়ে ফেলেন, হয়ে ওঠেন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সদস্য। ওই টিমের অন্যতম সদস্য বিমল কুমার দাস জানান, তারা বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। পরে যদিও পলাশডাঙ্গা পুরোটাই বিএলএফভূক্ত হয়েছেন, কিন্তু সেটা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভূক্তির প্রশ্নে। কিন্তু নীতিগত ভাবে বিএলএফের কর্মকৌশল আর পলাশডাঙ্গা পরিচালনা পদ্ধতি এক নয়। বিএলএফ গণনির্ভর ছোট ছোট গ্রুপ করে যুদ্ধ পরিচালনার কথা বলেছে আর পলাশডাঙ্গা পরিচালিত হয়েছে বেঙ্গল রেজিমেন্টের শৃঙ্খলায়। এদের পরিচালনার দায়িত্ব ছাত্র নেতারেদ ওপর থাকলেও যুদ্ধ এবং বাহিনী শৃঙ্খলা গড়ে তোলার দায়িত্ব পড়ে ইপিআর, পুলিশ, আনসার বিশেষ করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর। বাহিনী শৃঙ্খলা নিয়ে তাদের একটি গর্বও রয়েছে। 

এদিকে, উত্তরাঞ্চল প্রথমে জনগণ নিয়ে সংগঠন গড়তে ভারতে না যাওয়া আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরাজগঞ্জ বিএলএফের প্রথম ব্যচের সদস্য ফিরোজ ভূঁইয়ার স্মৃতিচারণে এর ছবি পাওয়া যায় সহবেই। তিনি লেখন-সংগঠকদের বলেন, ‘যে তরুণকে সন্ধ্যায় পৌরসভার রাস্তার বাতি জ্বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ঢুকতে হতো, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কোনও আত্মীয় বাড়িতে রাত কাটানোর কোনও অভ্যাসই ছিল না, তাকেই ছেড়ে দেওয়া হয় একা জনসংগঠন গড়ে মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্র সংগ্রহ করতে। এ পরিস্থিতিতে আমি আমার নেতা আমির হোসেন খানের পরামর্শ নেই। তিনি তখন সিরাজগঞ্জ কলেজের জিএস। অনেক জানাশোনা। তিনি অনেক গ্রামের নাম, ছাত্রলীগ কর্মীর নাম বলেন-যারা আমারও পরিচিত। সাহস পাই। চলে আসি ছোনগাছা ইউনিয়নের ভুড়ভুড়িয়া গ্রামে। খুঁজে বের করি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাত্রলীগ কর্মী জামালউদ্দিনকে। সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উন্মুখ, আমাকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ পায়। দুজন পরিকল্পনা করি। শহরে খবর পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে যাই আব্দুল লতিফ মাখন, কাজী ফিরোজ, সৈয়দ আলমাস আনোয়ার মোস্তফাসহ আরো কয়েক জনকে। বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান নিয়ে ওদের অস্ত্রের ব্যবহার শেখাই। দ্রুতই একটি গ্রুপ হয়ে উঠি আমরা। স্বাধীনতা বিরোধী বা ডাকাতদের বাড়িতে রাতের আধারে গিয়ে সাবধান হওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসতে থাকি। আমরা রাতে যখন দু’তিন জন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতাম, সে গল্পই জনগণ শতগুণ বাড়িয়ে প্রচার করতো। মু্ক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে বাড়িয়ে প্রচার হওয়ায় সুবিধা হতো আমাদেরই। বিভিন্ন গ্রামে আমাদের উপস্থিতি জনগণের সাহস বাড়ায়, পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।’ ফলে স্বাধীনতা বিরোধীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিতে থাকে।

সেপ্টেম্বর মাসে বিএলএফের আরো একটি গ্রুপ সিরাজগঞ্জ এলাকায় এসে পৌঁছে। এদের মধ্যে শেখ মোঃ আলাউদ্দিন ও মোতালেব হোসেনের বাড়ি শহরতলীর তেলকুপি এলাকায়। তারা বহুলী ইউনিয়ন এবং রায়গঞ্জ ও তাড়াশ থানায় বিএলএফের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করেন। আকবর আলীর বাড়ি তাড়াশ থানার লালুয়া-মাঝিড়ায়্, শশুরবাড়ি শহরতলীর গুণেরগাঁতী গ্রামে। তার সঙ্গে আসা বিএলএফের গ্রুপ আকবরের কোনও হদিস দিতে না পারলেও প্রথম ব্যাচের ইসহাক আলী বলেন, আকবর একটি গ্রুপের সঙ্গে ছিলো। যাইহোক, শেখ মোঃ আলাউদ্দিন ও মোতালেব হোসেন গোপনীয়তা বজায় রেখে বহুলীর আমিনপুরে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলেন। সেখানে প্রশিক্ষণ পান বেশ কিছু তরুণ, তাদের সঙ্গে নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং নিজেরা রায়গঞ্জ ও তাড়াশ তাদের তৎপরতা বজায় রাখেন। পাশাপাশি, কাজীপুর ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন যুদ্ধে বিএলএফ কমান্ডার মোজাফ্ফর হোসেন মোজাম এবং ডেপুটি কমা-ার ইসহাক আলীর সঙ্গে তারা অংশ নিতে থাকেন। জনসংগঠণ গড়ে তোলার ব্যপারে জনাব আলাউদ্দিন বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা সবাই দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আলাদা ভাব নিজের এলাকায় থেকে কাজ করাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতো তারা। একারণে কর্মীদের নিজ এলাকায় নিয়োজিত রাখতে পারেন নি তারা। ফলে জনসংগঠন গড়ে তুলতে পারেননি তারাও।

একই গ্রুপের আব্দুর হাই [অ্যাড. শাহজাদপুর], ইসমাইল হোসেন [শাহজাদপুর], আবুল কাশেম [শাহজাদপুর], শম্ভুনাথ [শাহজাদপুর], ইসমাইল হোসেন [উল্লাপাড়া] এবং আনিসুর রহমান ম. মামুন [কামারখন্দ] ও সোহরাব আলী [কামারখন্দ] একই রুটে স্ব স্ব এলাকায় পৌছেন। এরা পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে বিএলএফ নির্দেশিত পথে জনগণের সংগঠন এবং যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, কামারখন্দ, বেলকুচি, চৌহালী এলাকার যুদ্ধের বৈশিষ্ঠ অনেকটা বিএলএফ নির্দেশিত পথে চলতে থাকে। সেখানে বড় কোনও দল গঠিত হওয়ার সুযোগ কমে যায়। স্থানীয়, বিএলএফ ও এফএফের ছোট ছোট দলগুলোকে সব সময় ছোট রাখা হয়। গ্রামে পালিয়ে থাকা এবং জনগণের সঙ্গে মেশার সুবিধার্থে এক দল ভেঙ্গে আরো দল করা হয় বলে জানান এফএফ কমান্ডার তৎকালীন রাকসুর সহসম্পাদক কুয়াত-ইল ইসলাম। এই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে গ্রামে গ্রামে বৈঠক, মিছিল, পোস্টারিং এমনকি প্রেস বসিয়ে পত্রিকা, লিফলেট প্রকাশের ঘটনাও ঘটে।

অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে আব্দুল রাজ্জাক, জহুরুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিন ও আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে আরো চারটি গ্রুপে মোট ৪৮ জন বিএলএফ সদস্য সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে ঢোকার সুযোগ পায়। এদের প্রায় সবার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, বেলকুচি, শাহজাদপুর, কামারখন্দ ও উল্লাপাড়া। এদের কিছু সদস্য মিলিত হন ইসহাক আলীর সঙ্গে। অন্যেরা চলে যান বেলকুচি, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়াা অঞ্চলে। কিন্তু ততদিনে যুদ্ধ পরিস্থিতি পাল্টে গেছে অনেকটা। প্রায় সবাই লড়ছেন পাকসেনাদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য। ফলে, কৌশল পাল্টাতে হয় বিএলএফকেও। তারাও চূড়ান্ত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আসে বিএলএফের যুদ্ধ-কৌশল মূল্যায়নের সময়। বিএলএফ দ্বিতীয় ব্যাচের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই [অ্যাড. উল্টাডাব, শাহজাদপুর] তার স্মৃতিচারণে বলেন, ‘এর মধ্যে যোগাযোগ হয় পলাশডাঙ্গায় অবস্থানরত বিএলএফের অন্যতম সংগঠক সিরাজগঞ্জের প্রথম ব্যাচের তৎকালীন রাকসুর জিএস আব্দুস বামাদের সঙ্গে। তিনি এসেছিলেন কামারখন্দ এলাকায়। তার সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয় কামারখন্দের রায়দৌলতপুরে। আমাদের পক্ষে আলোচনায় ছিলাম আমি, খোরশেদ ভাই [পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক অ্যাড. খোরশেদ আলম। তিনি ভারতে না গিয়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পর এলাকায় চলে আসেন। তিনি এলাকার মুক্তিযুদ্ধে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।] শম্ভুনাথ, আনিসুর রহমান ম. মামুন, ইসমাইল হোসেন ও আবুল কাশেম। আব্দুস সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয় সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে বিএলএফের কর্মকা- নিয়ে। তিনি নানা প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে বলেন, আমরা যে কৌশলে কাজ করছি, সে কৌশলেই যেন কাজ করে যাই। বিএলএফের কৌশলে তারা [পলাশডাঙ্গা] কাজ করছেন না, এটাও তিনি স্বীকার করেন।’ বিএলএফ সদস্য ফিরোজ ভূঁইয়া বলেন, ‘শহর ও শহরতলীর কাজের পাশাপাশি নিয়মিত যোগাযোগ রাখি লিডার ও ডিপুটি লিডারের সঙ্গে। ধীরে ধীরে যুদ্ধ পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। জনগণ চাইছিল- আমরা ছলে-বলে-কৌশলে পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করি। তাই আমাদের বিএলএফও জনগণের সংগঠন গড়ে তোলার চেয়ে যুদ্ধের দিকেই ঝুঁকে পড়তে শুরু করে।’

নিউক্লিয়াসের ধারাবাহিকতায় বিএলএফ, যে বিএল্এফ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রাজনৈতিক যোদ্ধাদল। এর পরে অবশ্য ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপ’ এমনকি হিন্দু তরুণদেরও আলাদা করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশাল একটি গ্রুপ যুক্ত হয় এফএফ হিসেবে। এমনকি ভাষানী ন্যাপের একটি গ্রুপ ‘৬৯-এ ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ ষোঘণা দিয়ে যুদ্ধে নামে। এছাড়া জনগণের অবস্থাণ ভূমিকার পূঙ্খানুপঙ্খু খোঁজ-খবর জানা জরুরী বলে মনে করতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের অনুসন্ধানী সংগঠকেরা। তাদের বিষয়েও খোঁজখবর নেওয়াকে প্রয়োজন মনে করতে থাকে তারা। নইলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকেই যাবে বলে মনে করতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের অনুসন্ধানী সংগঠকেরা।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক- সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test