E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পথের ধুলো থেকে : পর্ব-১৪

জনগণ তাদের মতো করে স্বাধীন করে ফেলে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশকে

২০২১ সেপ্টেম্বর ০৫ ২৩:৪২:৪৭
জনগণ তাদের মতো করে স্বাধীন করে ফেলে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশকে

সাইফুল ইসলাম


মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী যেমন—বেঙ্গল রোজিমেন্ট, ইপিআর পুলিশ আনসার বাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যখন মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়ে পড়ে তখন সাহসে চওড়া হয়ে যায় সাধারণ বাঙালির বুক। পিছনে তাকানোর পরিবর্তে শুধুই সামনে অর্থাৎ স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এই সব লেখালেখি আর নিজেদের তৃণমূলের অভিজ্ঞতা নিয়ে চলতে শুরু করে অনুসন্ধান কমিটির লেখক সংগঠকেরা। সেই সব লেখা আর অভিজ্ঞতা থেকে তারা একটি সার সংক্ষেপ করে নেয়। এখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ধাপ অথাৎ অসহযোগ আন্দোলনকে তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকে।

অসহযোগ আন্দোলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান’এর বেসামরিক প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। ৭ মার্চের পর বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। প্রাথমিক অবস্থায় এই প্রশিক্ষণে যুক্ত হয় সরকারের সবচেয়ে ঢিলোঢালা অথচ সশস্ত্র সংগঠন আনসার বাহিনীর সদস্যরা। তারা প্রথমে বাঁশের লাঠি পরে ডেমি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অবসরপ্রাপ্ত আনসার, পুলিশ, ইপিআর ও সেনাসদস্যরা। এরপরই আসে ছুটিতে আসা সেনাসদস্যরা। বিভিন্ন গ্রামের প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়ে পড়েন তারাও। পঁচিশে মার্চের পর শুধু ক্যান্টনমেন্ট আর ক্যান্টনমেন্ট লাগোয়া ঢাকা চট্টগ্রাম ছাড়া কোথাও ‘পূর্ব পাকিস্তান’এর অবশিষ্ট থাকে না আর। ঢাকা চট্টগ্রাম থেকেও সাধারণ মানুষ পালাতে শুরু করে। জনগণ তাদের মতো করে স্বাধীন করে ফেলে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশকে।

এদিকে, ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানা এবং ঢাকা, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি পুলিশ, ইপিআর সদস্যদের পাইকারী ভাবে হত্যা করা হচ্ছে—এমন খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ফলে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত সশস্ত্র বাঙালিরা নিজেদের আত্মরক্ষা এবং দেশপ্রেমের মিলিত তাগিতে বিদ্রোহ করতে শুরু করে, যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত হওয়ার এই বিষয়টি প্রধানত স্বতঃস্ফূর্ত ও অপকিল্পিত সিদ্ধান্ত বলা চলে। দেখা যাক, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের বিদ্রোহের রূপটি কেমন?

বীর মুক্তিযোদ্ধা এএসএম শামসুল আরেফিনের ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ গ্রন্থ অনুযায়ী ১ম বেঙ্গল যশোর, ২য় বেঙ্গল জয়দেবপুর, ৩য় বেঙ্গল সৈয়দপুর, ৪র্থ বেঙ্গল কুমিল্লা এবং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টার সেন্টার, ৮ম, ৯ম ও ১০ বেঙ্গল চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অন্তর্ভূক্ত। প্রথম বিদ্রোহ দেখা দেয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টার সেন্টারের অবস্থান এই সেনানিবাসে। এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাহবুবুর রহমান মজুমদার [এমআর মজুমদার] স্থানীয় আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকও। তাকে সোয়াত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে জন প্রতিরোধ এবং বন্দর কতৃপক্ষের অসহযোগিতার কারনে তার পক্ষে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নামানো সম্ভব হয় না। ২৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে হেলিকপ্টার দিয়ে ঢাকায় ফেরত নেওয়া হয় এবং সেখানে স্থলাভিষিক্ত হন অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারী। তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসে যোগদান করে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সোয়াত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের নির্দেশ দেয়। এই রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল সেনানিবাসের বাইরে ষোল শহরে। তার আগেই এদের বদলী করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তাই নিজেদের নিরাপত্ত্বার প্রয়োজনে সামান্য অস্ত্র রাখার সুযোগ ছিল তাদের। যাই হোক, ৮ অষ্টম বেঙ্গলেরসহ অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে তারা রওনা হয় অস্ত্র-গোলাবারুদ খালাসের উদ্দেশ্যে।

কিন্তু ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তান সেনারা ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে হামলা চালায় এবং লে. কর্নেল এমআর চৌধুরীসহ ৮ অফিসারসহ প্রায় ১৫০০ সৈন্যকে হত্যা করে। অল্প কিছু অফিসার ও সৈন্য এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। পথেই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর কাছে এ খবর পান মেজর জিয়া। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ফিরে আসেন ছাউনিতে। সকল অফিসার ও সৈন্যকে একত্রিত করে মেজর জিয়া নিজে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করে বিদ্রোহ করেন। একই সেনানিবাসে ৯ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল গঠনের পর্যায়ে। এদের প্রায় সবাই পূর্বোক্ত হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন। ১০ ইষ্ট বেঙ্গল মূলত ক্যাডেট ব্যাটেলিয়ান। প্রশিক্ষক ছাড়া কোনও নিয়মিত সৈন্য ছিল না সেখানে, তারা কেউ-ই বিদ্রোহ অংশগ্রহণ করে নি।

৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান কুমিল্লা সেনানিবাসে। আলোচনার সুবিধার্থে বলা প্রয়োজন, বাঙালিরা যেন বিদ্রোহ করতে না পারে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল নেয়। এর অংশ হিসেবে মেজর শাফায়েত জামিলের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ২২ মার্চ এই কোম্পানিতে সহঅধিনায়ক হিসেবে যোগদান করেন মেজর খালেদ মোশাররফ। ২৪ মার্চ তাকে ‘নক্সাল দমন’এর উদ্দেশ্যে এক কোম্পানি সৈন্যসহ পাঠানো হয় সিলেটের শমশের নগরে। রেজিমেন্টের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন গাফ্ফারও নানা কথা বলে সসৈন্য রওনা হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে। এদিকে, ২৬ মার্চ দুপুরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হত্যাযজ্ঞের খবর পান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত মেজর শাফায়েত জামিল। তিনি সকল ঘটনা অবহিত করেন সিনিয়র খালেদ মোর্শারফকে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে ২৭ মার্চ সকাল ১০টায় অবাঙালিদের গ্রেফতার করে ইউনিটে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ঘোষণা দেন। দুপুর ১২টার দিকে মেজর খালেদ মোর্শারফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছে ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন।

জয়দেবপুর সেনানিবাসে অবস্থান করছিল ২য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। জানুয়ারির মাঝামাঝি এই রেজিমেন্টের এক কোম্পানিকে টাঙ্গাইল, এক কোম্পানিকে ময়মনসিংহ এবং এক প্লাটুন সৈন্য রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনেশন ফ্যাক্টরিতে পাঠানো হয়। তখন রেজিমেন্টের বাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান এবং সহঅধিনায়ক মেজর শফিউল্লাহ। ২৩ মার্চ লে. কর্নেল মাসুদুল হাসানকে প্রত্যাহার করে তার স্থলে নিযুক্ত করা হয় আরেক বাঙালি লে. কর্নেল কাজী রকিবুদ্দিনকে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু হলে বিষয়টি প্রাক্তণ কমান্ডার মাসুদুল হাসান সহঅধিনায়ক শফিউল্লাহকে জানান। পরদিন রাজেন্দ্রপুর ডিপো থেকে পাকসেনারা হেলিকপ্টার যোগে গোলাবারুদ আনতে গেলে বিষয়টি জানাজানি হয়। তখন মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মঈন জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন এবং রেজিমেন্টকে ময়মনসিংহে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। নেতৃত্ব নিতে নতুন অধিনায়ককে অনুরোধ করলে তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। ২৮ মার্চ তারা জয়দেবপুর ছেড়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হন ২য় বেঙ্গল। টাঙ্গাইলে অবস্থানরত লে. হেলাল মোর্শেদ খান ওইদিনই মুক্তাগাছায় যোগ দেন। বেলা ৩টার দিকে তারা মিলিত হন ময়মনসিংহে অবস্থানরত মেজর নুরুল ইসলামের সঙ্গে। যুক্ত হন একই রেজিমেন্টের মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীও। মেজর শফিউল্লাহ সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। ২৯ মার্চ বিদ্রোহ করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান যশোর সেনানিবাসে। এর কমান্ডার বাঙালি লে. কর্নেল রেজাউল জলিল। ২৫ মার্চ তারা অবস্থান করছিল সেনানিবাস থেকে পঁচিশ মাইল দূরে চৌগাছায়। ২৯ মার্চ বিকেলে তাদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে আনা হয় এবং গোলাবারুদ অস্ত্রাগারে জমা করা হয়। ৩০ মার্চে অস্ত্রাগারের চাবি অবাঙালি ব্রিগেড কমান্ডার নিয়ে নিলে সাধারণ সৈনিকদের সন্দেহ হয়। এ অবস্থায় বাঙালি সৈন্যরা অস্ত্রাগার ভেঙে তাদের অস্ত্র বের করে আনে এবং বাঙালি কর্মকর্তাদের বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করে। ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লে. আনোয়ার সে ডাকে সারা দেন। সারা দিনের প্রতিরোধ যুদ্ধে লে. আনোয়ারসহ অন্তত ৪০ জন তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে শহিদ হন। এভাবেই শুরু হয় প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ যুদ্ধ।

৩য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান সৈয়দপুর সেনানিবাসে। এর অধিনায়ক সহঅধিনায়ক উভয়েই অবাঙালি। রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানির দায়িত্ব দিয়ে বাঙালি মেজর নিজামকে পাঠানো হয় ঘোড়াঘাট-পলাশবাড়ি এলাকায়। অপর বাঙালি ক্যাপ্টেন আশরাফকে এক কোম্পানি সৈন্যসহ পাঠানো হয় দিনাজপুরে। সেনানিবাসে থাকেন একমাত্র বাঙালি অফিসার ক্যাপ্টেন আনোয়ার। সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেনানিবাসে অবস্থিত বাঙালি সৈনিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। ৩১ মার্চ দুপুরে ওই সব সৈনিকদের ওপর পাকিস্তান সেনারা অতর্কিতে হামলা চালায়। এ সময় ছোট ছোট গ্রুপ হয়ে যে যেদিকে পারে বের হয়ে আসে এবং ক্যাপ্টেন আশরাফের অবস্থান ফুলবাড়িতে যুক্ত হয়। বিদ্রোহে আগ্রহীদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন মেজর নিজামউদ্দিন। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন ইপিআর, পুলিশের সহযোগিতায় প্রতিরোধ যুদ্ধে শামিল হয় ৩য় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।

এ ভাবেই বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে আসে বাঙালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের একটি অংশ। তারা তাড়া খেতে খেতে এক সময় পৌছে যায় ভারত সীমান্তে। বিদ্রোহ করার ফলে তাদের পাকসেনাবাহিনীতে ফেরার পথ রুদ্ধ হয়, অগত্যা বাঙালি সৈনিকদের জন্য ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’ ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকে না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাসাহিত্যিক, আহ্বায়ক-সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test