E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্মৃতি তোরণ নির্মাণের দাবি পরিবারের

বীর বিক্রম লিলু মিয়াকে এখন আর কেউ স্মরণ করে না

২০২১ ডিসেম্বর ১৫ ১৬:১০:০২
বীর বিক্রম লিলু মিয়াকে এখন আর কেউ স্মরণ করে না

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কৃতি সন্তান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক লিলু মিয়া বীর বিক্রমের গ্রামের বাড়ি উপজেলার ছয়সূতী ইউনিয়ের লোকমানখাঁর কান্দি গ্রামে তার স্মৃতি স্বরূপ একটি স্মৃতি তোরণ ও তার নামে একটি রাস্তার নাম করণের দাবী জানিয়ে তার ছেলে মো. শাহজাহান খান বলেন, এখন কেউ তার বাবা শহীদ বীরমুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক লিলু মিয়া বীর বিক্রমকে আর স্মরণ করেনা।

“বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ল্যান্স নায়েক লিলু মিয়া বীর বিক্রম” স্মরণে তার নামে একটি তোরণ নির্মাণের দাবী জানিয়ে গত ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন তার ছেলে মো. শাহজাহান খান। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক আবেদনটি সদয় বিবেচনার জন্য কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর প্রেরণ করেন। প্রায় ৫ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত তোরণ নির্মাণের কোন প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানান মো. শাহজাহান খান।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর উপলক্ষে “বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদ ল্যান্স নায়েক লিলু মিয়া বীর বিক্রম” নামে একটি তোরণ নির্মাণসহ একটি রাস্তার নাম করণে তার স্ত্রী ৮২ বছরের বৃদ্ধা মোসা. ললতা বেগমের শেষ আশাটুকু পুরণের দাবী জানান ছেলে মো. শাহজাহান খান।

জানা যায়, ১৯৭১ সালে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের ৯ উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) কর্মরত ছিলেন লিলু মিয়া। তার পদবী ছিল ল্যান্স নায়েক। উইং হেডকোয়ার্টার্সের অবস্থান ঠাকুরগাঁও শহরে। ২৬ মার্চ সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ ঠাকুরগাঁও শহরের রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। তারা সড়কে ব্যারিকেড দেয় এবং বাঙালি ইপিআরদের আহবান জানায় তাদের সঙ্গে যোগ দিতে।

একদিকে জনতার আহবান, অন্যদিকে শৃঙ্খলার অনুশাসন। ঠাকুরগাঁও উইংয়ের বাঙালি ইপিআর সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কারণ, তখন ওই উইং হেডকোয়ার্টার্সে ছিল বিপুলসংখ্যাক (১২০-১২৫ জনের অধিক) অবাঙালি সেনা। এ ছাড়া সেখানে ছিল সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেনা।

শেষ পর্যন্ত দেশ মাতৃকার আহবানেরই জয় হয়। ২৮ মার্চ রাতে (তখন ঘড়ির কাটা অনুসারে ২৯ মার্চ) লিলু মিয়াসহ বাঙালি ইপিআর সেনারা বিদ্রোহ করেন। উইংয়ে বাঙালি-অবাঙালি ইপিআরদের মাধ্যে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বেশির ভাগ অবাঙালি ইপিআর ও পাকিস্তানি সেনা (প্রায় ১১৫ জন) নিহত হয়।

এরপর ইপিআর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তারা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। একটি দল ভাতগাঁও (ঠাকুরগাঁও থেকে ২৩ মাইল আগে), একটি দেবীগঞ্জে, একটি দল শিবগঞ্জে প্রতিরক্ষাব্যহ তৈরি করে। এছাড়া ঠাকুগাঁও-সৈয়দপুরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিভিন্ন সড়কের খানসামা, জয়গঞ্জ ও ঝাড়বাতিতেও তারা প্রতিরক্ষা তৈরি করেন।
প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব প্রতিরক্ষার একটি সঙ্গে আরেকটির ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে অসুবিধা হয়। একমাত্র রানারই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। তখন কখনো কখনো এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় নির্ভীক, অকুতোভয় ও কৌশলী লিলু মিয়াকে। তিনি যুদ্ধের পাশাপাশি এই দায়িত্বও সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেন তখন।

এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন লিলু মিয়া এই দায়িত্ব পালনকালে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে এক প্রতিরক্ষা থেকে আরেক প্রতিরক্ষায় যাচ্ছিলেন। পথে দিনাজপুর-সৈয়দপুর সড়কের ১০ মাইল নামক স্থানে তিনি আক্রান্ত হন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে। ১০ মাইলেও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা। কিন্তু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রবল আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়ে ওই প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে যান।

এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রতিরক্ষা থেকে আরেক প্রতিরক্ষায় খবর পৌঁছাতে হবে ওই এলাকা দিয়েই। ১০ মাইল এলাকায় আছে পাকিস্তানী সেনা। আকাশেও মাঝে মধ্যে উড়ে বেড়ায় পাকিস্তানি হেলিকপ্টার। খবর পৌঁছানোর এ দায়িত্ব পড়ে লিলু মিয়ার ওপর। তিনি এতে থেমে যাননি। ভয়ও পাননি। নির্ভয়ে এগিয়ে যান ওই এলাকা দিয়ে। কিন্তু সফল হননি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। শহীদ হন তিনি।

শহীদ লিলু মিয়ার মরদেহ তার সহযোদ্ধারা উদ্ধার করতে পারেননি। পরে তার মরদেহ স্থানীয় গ্রামবাসী সেখানেই সমাধিস্থ করেন। সেই স্থান তারা তখন পাকিস্তানী সেনাদের ভয়ে চিহ্নিত করে রাখেননি। স্বাধীনতার পর তার সহযোদ্ধারা তার মরদেহ খুঁজে পাননি।

মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত রানার হিসেবে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য শহীদ লিলু মিয়াকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ নম্বর ১১৪।

শহীদ লিলু মিয়ার পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়নের লোকমানখার কান্দি গ্রামে। তিনি বিবাহিত ছিলেন। তার বাবার নাম সোনা মিয়া, মা সাইরননেছা। স্ত্রী ললিতা বেগম। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মো. হুমায়ুন খান কিছুদিন আগে মারা গেছেন। স্ত্রী ললিতা বেগম এখনো বেঁচে আছেন। স্বামীর পেনশন ভাতা পান তিনি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ছেলে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করেন।
লিলু মিয়ার ছোট মেয়ে মানোয়ারা বেগম বলেন, বাবার স্মৃতি মনে নেই। মায়ের কাছে মাঝে মধ্যে বাবার কথা শুনে চোখে পানি আসত। তিনি কেমন ছিলেন দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার একটি ছবিও নেই। শহীদ লিলু মিয়ার ছবি পাওয়া যায়নি।

(এসএস/এসপি/ডিসেম্বর ১৫, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test