E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

প্রতিরোধ যুদ্ধের এক সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

২০২২ মার্চ ২৩ ১৬:০৯:৪৩
প্রতিরোধ যুদ্ধের এক সাক্ষী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল

উল্লাপাড়া প্রতিনিধি : ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয় উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেল সেতুর পাশে। সে সময় এটি ছিল পাবনা জেলার একটি মহকুমা। ১৯ এপ্রিল পাবনা জেলার ডাব বাগান (শহীদ নগর) যুদ্ধের পর এই প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় উল্লাপাড়া উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে শাহজাহানপুর গ্রামের পাশে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধা দল। প্রায় দুই ঘন্টা ধরে চলা এই যুদ্ধ সিরাজগঞ্জে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত। আর এ কারণে যুদ্ধের স্থানটি এখন একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে দর্শনার্থীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। দিনটি ছিল ২৪ এপ্রিল শনিবার। তত দিনে হানাদার বাহিনীর প্রায় গোটা দেশে কর্তৃত্বে স্থাপন করেছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা অভিযান শুরুর পর দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে চলে প্রতিরোধ। সিরাজগঞ্জেও সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ ছিল।

রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই ছিল এ অভিযানের লক্ষ্য। কারণ,২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর সিরাজগঞ্জ জেলায় ঠুকতে প্রথমেই বাধা পায় শাহজাদপুর থানার বাঘাবাড়ী ঘাটে। বড়াল নদীর এ ঘাটে তখন সেতু ছিল না । স্থানীয় লোকজনদেশেরপ্রত্যন্ত অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর ঢুকে পড়ার খবর পেয়ে বাঘাবাড়ি ঘাট থেকে

নৌকা-ডিঙি সব সরিয়ে ফেলেছিল। পাকবাহিনী নদীর পূর্বপাড়ে এসে আটকে যায়। ওখানে থেকে পাক হানাদার বাহিনী একটি মর্টার শেল ছাড়ে। মর্টার শেলের ভয়ঙ্কর আওয়াজে রতন কান্দি ও আশে পাশের সব মানুষ ভীত সন্তস্থ হয়ে পড়ে। বাঘাবাড়ী ঘাট পূর্ব-পাড় থেকে ছাড়া পাকি হানাদারদের মর্টার শেলের গুলিটি

৬ কিঃ মিঃ দূরে ডায়া (ইসলামপুর )নামক গ্রামে গিয়ে পড়ে ছিল। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপিএ অ্যাডভোকেট মো: আবদুর রহমান ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাড়ে সংগঠিত হয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় পাকসেনারা দু’দিন নদীর পার হতে ব্যর্থ হয়। নিরুপায় হয়ে এই বাহিনীর একটি গ্রুপ রুটি পরিবর্তন করে ওখান থেকে পাবনা হয়ে ঈশ্বরদী রেলষ্টেশন থেকে ট্রেনযোগে সিরাজগঞ্জে ঢোকার পরিকল্পনা নেয়। এই গোপনা খবরটি ২৩ এপ্রিল গভীর রাতে সিরাজগঞ্জে পেীছলে সেখান থেকো প্রায় ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা হেঁটে ২২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পরদিন সকালে উল্লাপাড়া থানার ঘাটিনা রেলসেতুর পাশে শাহজাহানপুর গ্রামে এসে অবস্থান নেয়।

এ সময়ে এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ ও পলাশডাঙ্গা যুবশিবির পরিচালক ছাত্র নেতা আবদুল লতিফ মির্জা ও ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র সংসদের তৎকালীন জিএস আবদুস সামাদ ও সাবেক পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের ব্যাটালিয়ন কামান্ডার লুৎফর রহমান অরুণসহ অন্যান্যরা। ওই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছিল কয়েকটি ৩০৩ রাইফেল, কিছু বন্দুক ও একটি এলএমজি। সকাল থেকে ঘাটিনা সেতুর রেল অপসারণ, শাহজাহানপুর গ্রামের সীমানায় বাংকার খননসহ প্রতিরোধ কার্যক্রমে অন্যান্য প্রস্তুতি চলছিল।

পার্শ্ববর্তী চরঘাটিনা, ঘাটিনা, মাটিকোড়া, কর্মকারপাড়া বেতকান্দি, লক্ষ্ণীপুর, কানসোনা, সলপ, রামগাতী ও শাহজাহানপুর গ্রামের শত শত উৎসাহী যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করে। এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল লতিফ মির্জা দুপুর ১২ টায় দিকে পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীকে ডেকে যে কোনো বিপদ মোকাবেলার প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। দুপুর আড়াইটার দিকে শতাধিক পাকসেনা বহনকারী কয়লার ইঞ্জিনচালিত একটি ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশে এসে দাঁড়ান ঘাটিনা সেতুর পশ্চিম পাড়ে। রেলপথে মাইন বসানো থাকতে পারে সন্দেহে ইঞ্জিনের সামনে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল দুটি মালবাহী বগি। সেতুতে কয়েকটি রেল খুলে না ফেললে হয়তো ট্রেনটির পথে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হতো না।ট্রেন থেমে যাওয়া পর ১৫-২০ জন পাকসেনা সেতুর অবস্থা দেখার জন্য যখন নিচে নেমে আসে, ঠিক তখনই নদীর অপর পাড় থেকে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ার গুলো গর্জে ওঠে একযোগে। আচমকা গুলিতে হতচকিত হয়ে পড়ে শক্রবাহিনী। সুযোগ-প্রত্যাশী মুক্তিবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ১৫ জন পাকসেনা । কিন্তু এর কয়েক মিনিট পরেই শুরু হয় পাল্টা গুলি। ভারী অস্ত্র থেকে গুলি চলল বৃষ্টির মতো।

ফলে শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। ভয়ে-আতঙ্কে ঘাটিনা রেলসেতুর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর হাজার হাজার লোক গ্রাম ছেড়ে গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া, পোটলা ও অন্যান্য নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যায় বেলুকুচি থানার দিকে। শুরু হয় অসহায় নারী-পুরুষের আহাজারি। গুলিতে আহত হয় বেশ কয়েক জন নারী-পুুরুষ ও শিশু। কারোর পায়ে,কারো হাতে গুলি লেগে ছিল। রক্ত ঝরছে ক্ষতস্থান থেকে। তবুও প্রাণ বাঁচানোর কী কঠিন প্রয়াস। চিৎকার করে ছুটছে তারা।

বৃদ্ধরা ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ছে। আবার উঠছে। পালাচ্ছে তারা প্রাণপণে নিরাপদ আশ্রয়ে। যারা এই যুদ্ধ দেখেছেন তাদের স্মৃতিতে আজও সেই ভয়াবহতা নাড়া দেয়। সন্ধ্যার আগে পাকবাহিনীর গুলি থেকে যায়। ট্রেন পিছিয়ে যায় উল্লাপাড়া ষ্টেশনে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ জোরদার করতে আরও উৎসাহ হয়ে ওঠেন; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদও শেষ হয়ে যাওয়ার তারাও বিরতি টানেন। সন্ধ্যায় মুুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পার্শ্ববর্তী সলপ রেলষ্টেশন ক্যাম্পে চলে যায় এবং অপর দলটি রামগাতী গ্রামের পান্না চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। রাতে শাহজাহানপুর গ্রামটি পরিণত হয় এক ভুতুড়ে পল্লীতে। কোনো বাড়িতে জনমানবের চিহ্ন নেই। প্রাণ ভয়ে গ্রাম ছাড়ে সবাই। এসডিও শামসুদ্দিন আহমেদ গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য সন্ধ্যার আগেই সিরাজগঞ্জে রওনা হয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা আবদুল লতিফ মির্জা পাকবিহানী পরবতী আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপার দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন।

সিরাজগঞ্জ থেকে রাতেই আবার বেশ কিছু গোলাবারুদ এসে পৌছায়। ধারনা ছিল, পরদিন সকালে পাকবাহিনী আাবারও ব্যাপক সমরসজ্জা নিয়ে ঘাটিনা রেলসেতুর ওপার থেকে আক্রমণ চালাবে কিন্তু তা হলো না। ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী রেল সেতুতে নতুন রেল বসিয়ে ট্রেন পার করে ।পাকিস্তানি সৈনিকরা ট্রেন থেকে নেমে তান্ডবলীলা শুরু করে। শাহাজানপুর,কর্মকারপাড়া, মাটিকোরা, বেতকান্দি, লক্ষ্মীপুর গ্রামে অধিকাংশ বাড়ি লুটপাট করে এবং আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হায়েনারা শতাধিক লোকে নির্যাতন করে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। শ্ক্রবাহিনী উল্লাপাড়া রেলষ্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে গাড়াদহ বাজারে ৬ ইঞ্চি মর্টার বসিয়ে শেলিং শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের শাহজাহানপুর গ্রামের অবস্থানের ওপর। বৃষ্টির মতো শেল এসে পড়তে শুরু করে তাদের বাংকার ও আশেপাশের বাড়িতে,গাছে। হালকা অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পড়েণ মহাবিপদে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এদিনই পাকবাহিনী রেলসেতুতে নতুন রেল বসিয়ে ট্রেন পার করল অপর অংশে। এরপরই শুরু হলো তাদের তান্ডবলীলা। রেলপথের পার্শ্ববর্তী শাহজাহানপুর, কর্মকারপাড়া,মাটিকোড়া, বেতকান্দি, লক্ষ্মী এসব গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হলো।চালানো হলো লুটপাট।

২৫ এপ্রিল বাঘাবাড়ি ঘাট প্রতিরোধ ভেঙ্গে আর্মিরা শাহজাদপুরে ঢোকে। তারা দারিয়াপুর বাজার, সাহাপাড়া ও অন্যান্য স্থানে লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। অনেক মানুষ আহত হয় এবং মারা যায়।সড়ক পথে যাওয়ার সময়ে রাস্তার আশেপাশের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।ঐ দিনই চরিয়া গ্রামে গণ হত্যা চালিয়ে ১২৯জন নিরপরাধ নারী-পুরুষ ও শিশু কে হত্যা করে। চার শতাধিক বাড়ি-ঘর লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। হায়েনারা ২৫-৩০ জন মেয়ে কে নির্যাতন করে। একই ভাবে সিরাজগঞ্জ গামি পাকি হায়েনারা সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত পথের দুই ধারের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিল। হত্যা করল শতাধিক লোক। সিরাজগঞ্জ শহরে পৌছেও তারা শুরু করে ধ্বংসযজ্ঞ। প্রাণ ভয়ে, ইজ্জত বাঁচাতে শহরে লোক ছুটল প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে। বস্তুত ঘাটিনা রেলসেতুর প্রতিরোধ যুদ্ধের পরদিন থেকেই সিরাজগঞ্জের পুরো এলাকা পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তদানীন্তন উল্লাপাড়া থানা পরিষদ করতোয়া নদীর পাড়ে একটি স্মৃতিফলক নিমার্ণ করে।

(ডিএস/এসপি/মার্চ ২৩, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test