E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের মুখে যুদ্ধ কথা 

২০২২ সেপ্টেম্বর ০৯ ১৫:৫০:৩৭
বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের মুখে যুদ্ধ কথা 

আমি মকবুল হোসেন। জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ আগস্ট। ১৯৭০ সালে এসএসসি পাশ করে অক্টোবর মাসে ঢাকায় চাচার বাসায় আসি। ১২ নভেম্বর ভোলা, পটুয়াখালি, বাউফল, চর কলমী, চরপাটানাংলা, মহাসাইক্লোন/প্লাবন হয়। রেডক্রস রিলিপ ডিস্ট্রিবিউশন এর জন্য কর্মী খোঁজে। আমি কর্মী হিসেবে উক্ত কাজে যোগ দেই এবং জাহাজে করে উক্ত এলাকা সমূহে রিলিফ বিতরণে যাই। প্রায়  তিন মাস বন্যা কবলিত এলাকায় রিলিফ বিতরণ করে ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ সনে ঢাকায় ফিরে আসি। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ শোনার জন্য আমরা মতিঝিল এজিবি কলোনী হতে আমি, জাহাঙ্গির, আলমগীর, নাজমুল, রবিউলসহ বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাকামী ভাষণ শুনেছি। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসে ঢাকা থেকে দেশের বাড়ি গিয়ে ১৭ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আমার স্কুল সহপাঠী আমি, গোলজার হোসেন, মাসুম খাঁন, বাদশা মিয়া এর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে মে মাসের দিকে অসুস্থ বাবামাকে বাড়িতে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য গ্রামের পথ ধরে পোতাদিয়া, রাউতারা দিয়ে সানিকদিয়ার চর হয়ে পায়ে হেটে যেতে থাকি। রাত্রি ঘনিয়ে এলে এক কৃষকের বাসায় আশ্রয় নিই। উক্ত কৃষক রাতে আমাদের খাবার ব্যবস্থা করেন। পরের দিন ভোরে উঠে পুনরায় যাত্রা শুরু করি। কাশবনের ভিতর দিয়ে লুকিয়ে যেতে হয়েছে। 

এভাবে ৩ দিন হেঁটে কুষ্টিয়ার খাদেমপুর হয়ে বর্ডার ক্রস করে নদীয়া জেলার ডক্টর বিধান চন্দ্র রায় স্কুলে স্থাপিত কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে উপস্থিত হই। ওখানে যাওয়ার পর আমাদেরকে পরিচয় সনাক্ত করে ক্যাম্পে ঢুকিয়ে ১টা কম্বল, ১টা প্লেট, ১টা মগ দেওয়া হয়। পরের দিন সকালে নাস্তার জন্য খিচুরী দেওয়া হয়। নাস্তা শেষে মেডিকেলে নেওয়া হয়। মেডিকেল চেক করে পিটি করানো হয়। বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটি করি। যদিও ঢাকাতে থাকা অবস্থায় এজিবি কলোনির সামনে নটোরডেম কলেজের সামনে আ.স.ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন আমাদেরকে স্কাউট রাইফেল দিয়ে পিটি করিয়েছেন।

মনটা খারাপ হওয়ার পর দুদিন পিটি করে আমি ও গোলজার পরের দিন ক্যাম্প থেকে ছুটি নিয়ে বাসে ও ট্রেনে উঠে কলকাতায় রওয়ানা দেই এবং শিয়ালদাহ স্টেশনে এসে বাংলাদেশ এর অস্থায়ী কার্যালয় খুঁজে সেখানে যায়। প্রিন্সেস স্ট্রিটে এসে শাহজাদপুর কলেজের প্রফেসর আব্দুল আউয়াল, তাহাজ্জুদ হোসেন ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়।ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব স্বহস্তে আমাদেরকে পরিচয়পত্র লিখে দেন ও ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য হাত খরচের জন্য টাকা দিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে যেতে বলেন। পরের দিন আমরা কলকাতা থেকে কল্যাণী হলে আসি।

কল্যাণীতে তখন হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য ক্যান্ডিডেট নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছিল। আমরা লাইনে দাঁড়াই আমাদেরকে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচন করেন। পরেরদিন চার দিনের খাওয়ার উপযোগী পাউরুটি ও কলা দেয়। আমরা রুটি কলা নিয়ে শিখ সেনার তত্ত্বাবধানে মিলিটারি কনভয়ে উঠে বসি। কল্যাণী থেকে অবিরাম চারদিন চলার পর ভারতের বিহার প্রদেশের বীরভূম জেলার চাকুলিয়া বিমান বন্দরে (যেখানে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল সেই স্মৃতিগুলো তখনো ছিল) আমাদেরকে তাবু গেরে ক্যাম্প করা ছিল। সেই ক্যাম্পে আমাদেরকে ঢোকানো হয়। ১ দিন বিশ্রামের পর থেকেই আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়।

আমাদের ট্রেনিং এর ওস্তাদ ছিলেন শীখ সেনা কে.কে অধিকারী। টানা নিরবিচ্ছিন্ন আকারে ট্রেনিং হয়। ট্রেনিং চলাকালীন পাবনা জেলার আমাদের সাথে ছিলেন আব্দুর রউফ রাজা, আমি মকবুল হোসেন, আবুল কালাম আজাদ, আজহার, রঞ্জু, মকবুল হোসেন শান্ত, মোজাহার আব্দুল মান্নান। আমাদের হাতে কলমে প্রাক্টিকেল ট্রেনিং দেওয়া। আমরা ৩০৩ রাইয়েল ২ ইঞ্চি মর্টার, এসএমজি, এলএমজি, এসএলআর, হ্যান্ড গ্রেনেড, পিইকে, জিসি স্লাব, মাইন, ইত্যাদি প্রসঙ্গে ট্রেনিং শেষে আমাদের পরিক্ষা নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ট্রেনিং শেষে আমাদেরকে গ্রুপ করে নদীয়া জেলায় পাঠায়।

নদীয়া থেকে ক্যাপ্টেন আমাদেরকে অস্ত্র ও গোলা বারুদসহ বাংলাদেশে পাঠায়। আগষ্ট মাসে বাংলাদেশে এসে সারা ব্রিজের নিচে নৌকা যোগে ৮ জনের গ্রুপ নিয়ে ভাঙ্গুরা ব্রিজ রেকী করে রাত্রী আনুমানিক ৮ টা ৯ টার দিকে ভাঙ্গুরা ব্রিজ সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্প অকতসাৎ হামলা করি। সেখানে পাকিস্তানি আর্মি, রেঞ্জার ও রাজাকার ছিল।

পরের দিন সকালে জানতে পারি ৪ জন পাকিস্তানি সেনা ৩ জন রেঞ্জার ও রাজাকার খতম হয়েছে। এরপর আমরা নৌকাযোগে বনওয়ারী নগর চলে আসি। ওখানে দুদিন অবস্থান করার পর পুনরায় ভাঙ্গুরা বাজারে যাই এবং ভাঙ্গুরা টেলিফোন একচেঞ্জ এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেই। পরবর্তীতে নৌকা নিয়ে উল্লাপাড়ায় চলে আসি এবং উল্লাপাড়া আর্মি ক্যাম্প সংলগ্ন বিদ্যুৎ পোল উড়িয়ে দেই। পরবর্তীতে নৌকা যোগে ঘাটিনা ব্রিজ সংলগ্ন জনাব মরহুম আব্দুল লতিফ মির্জা পরিচালিত পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবির বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হই এবং পলাশ ডাঙ্গা যুব শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৈ ডাঙ্গা ব্রিজ নওগাঁর হান্ডাল এর যুদ্ধে একত্রে অংশগ্রহণ করি। ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়।

১৪ই ডিসেম্বর গ্রুপ নিয়ে শাহজাদপুর চলে আসি এবং ডাক বাংলাতে ক্যাম্প করি। ৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭২ অস্ত্র জমা দিয়ে রিসিট নিয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে চলে আসি। বর্তমানে বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় দিনাতি পাত করছি। সংসারে ২ ছেলে ২ মেয়ে, সবাই যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মোঃ মকবুল হোসেন (এফ.এফ নং-৫০৮৫), ভারতীয় তালিকা-৩৬৩৮৫, লাল মুক্তিবার্তা-০৩১২০৪০২৮০, বেসামরিক গেজেট-২৭৯৪, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা নং-০১৮৮০০০২২০৮, জামুকা আইডি নং-০৫০৮০২০৪৭৫।

অনুলিখন : দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test