E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শেষ পর্ব

মুক্তিযুদ্ধের উৎকর্ষে একাত্তরের জুলাই এবং বন্ধু প্রতীম ভারত

২০২৩ জুলাই ২১ ১৪:৩৭:৪৮
মুক্তিযুদ্ধের উৎকর্ষে একাত্তরের জুলাই এবং বন্ধু প্রতীম ভারত

রহিম আব্দুর রহিম


জুলাই মাসে যুদ্ধ পরিস্থিতি এমন এক রুপ ধারণ করে যে, হয় মরণ, না হয় বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই বড়; একযোগে সারাদেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। ২৬ জুলাই কুমিল্লার মানারা সেতুতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও এক পর্যায় পিছু হটে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় এসময় ৪ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত। এই দিন কুমিল্লার নওগাঁও এবং আকমিনার মাঝামাঝি এলাকায় ক্যাপ্টেন আইন উদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৭ সেনা নিহত হয় এবং ৪ জন আহত হয়। অন্যদিকে এক মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়। এই বাহিনী নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরার পথে সায়েদাবাদ থেকে কসবাগামী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানীর সৈন্যের উপর অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ২১ সেনা ও ১ রাজাকার নিহত হয় এবং ৯নং সেনা আহত হয়। এই দিন (২৬ জুলাই) টাঙ্গাইলের ঘাটাইল কালিদাশ পাড়ার স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। প্রায় দু’ঘন্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ১৯ জন রাজাকার নিহত এবং ৭ রাজাকার আহত হয়। অন্যদিকে কুমিল্লার নরসিংহের কাছে মুক্তিবাহিনী ৭ রাজাকারের ছোট একটি দলের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ২টি রাইফেল ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি ওয়ারলেস সেট  ও ১২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী। এসময় তারা আটক ৭ রাজাকারকে ধরে তাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। ওই দিনই নোয়াখালী নরিমপুরে রেকি করতে গেলে রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার ওয়ালিউল্লাহকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে আটক করে। তাৎক্ষণিক উপস্থিত বুদ্ধিতে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ এক রাজাকারকে গুলি করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। 

মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু মাত্রা, আবেদনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের নানা কাহিনী উঠে এসেছে সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিকদের লেখনিকর্মে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘এক কিশোরের যুদ্ধযাত্রায়’ উঠে এসেছে ‘সদ্য কিশোরী বয়সে দেশ, নিপীড়ন, স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ একটু একটু করে বুঝতে যেদিন দেশত্যাগ করি সেদিন থেকে ফ্রক পরা আমি বড় হয়ে যাই। তারপর শরণার্থী দলের সাথে অবর্ণনীয় কষ্ট করে আগরতলায় রাজবাড়ি শিবিরে নাম লিখিয়ে বল্লা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেই। সেখানেই থাকতে শর্ট কোর্স নার্সিং ট্রেনিং করে ফিল্ড হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করি।’

লেখক মিস্টার খান তার আত্মজীবনীমূলক ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে লিখেছেন, ‘প্রায় কয়েক মাইল পথ হেঁটে দক্ষিণ ত্রিপুরায় একটি ছোট বাজারে গিয়ে পৌঁছালাম। ওই ছোট বাজারে যে লোক সংখ্যা, তার ৪গুণ বেশি শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে এসেছে। বাজারে কোন খাবার নাই। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত।’

ভারতের রায়গঞ্জ করোনেশ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রিয়রঞ্জন পাল তার এক প্রবন্ধে স্পষ্ট করেছেন, ‘পাক নিমর্মতা মাত্রা ছাড়া হয়েছিলো সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে, ব্যতিক্রম ছিলনা দিনাজপুরেও। পাক ঘাতকদের নারকীয়তায় গ্রামাঞ্চলে কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল বুঝা যায় প্রাণকৃষ্ণ গ্রামে মেশিনগানের গুলিতে ১৪৯ জন গ্রামবাসী ঝাঁজরা হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। এই নিদারুন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রাণ হাতে করে সীমান্ত পেরোয় বহু মানুষ। আশ্রয় নেয় সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে তৈরী হওয়া অনেকগুলো বড় শরণার্থী শিবিরে। এর মধ্যে রায়গঞ্জ সংলগ্ন হেমতাবাদের মলিন ক্যাম্প। এ ক্যাম্পের সামরিক চিকিৎসক হিসেবে কিছুদিন ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা বলরাজ সাহানিয়ার কন্যা শবনম। সেই সূত্রে রায়গঞ্জ এসেছিলেন অভিনেতা স্বয়ং। তার এই প্রবন্ধের পরতে পরতে যুদ্ধদিনের যে স্মৃতিকথা উঠে এসেছে তা এক ঐতিহাসিক মহাদলিল বলেই মনে হয়েছে। স্কুলে স্কুলে শরণার্থীদের ক্যাম্পে মানব কল্যাণে পড়ুয়াদের স্বেচ্ছাশ্রম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রাবন্ধিক তাঁর প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করেন, ‘রায়গঞ্জ শহরের বিশিষ্ট নাট্যকর্মী সীতেন চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘আমরা পালা করে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেছি। যেসব মিলিটারীর গাড়ি এখানে দাঁড়াতো আমরা তার জওয়ানদের জল, চা-বিস্কুট তুলে দিতাম। খুব খুশি হতেন ওরা। সম্ভবত বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থাটি হয়েছিল, সেটা এখন আর মনে নেই।’

‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে অবদান তা বিশ্বসমাদৃত দালিলিক ঘটনা। শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, পূর্ব পাকিস্তান থেকে গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে যাওয়া নথি বা অর্থ সংরক্ষণের ভূমিকা ছিল রায়গঞ্জের । যা সম্ভব হয়েছিল স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার রায়গঞ্জ শাখার মাধ্যমে । প্রিয়রঞ্জন পালের প্রবন্ধের সূত্র ধরেই মুক্তিযুদ্ধের এক গভীর অথচ অকথিত সম্পর্কের কথা জানতে আমি নিজে চলতি (২০২৩ খ্রি:) ২৮ এপ্রিল, অধুনা ভারতের ২৪ পরগনার হরিণাভী নিবাসী নীরেন্দ্রনাথ (নটু) সেনগুপ্তের সাথে দেখা করেছি। তার সাথে কথা হয়েছে ভারতে সোনারপুরের একটি আবাসিক বাড়িতে। নটু সেনগুপ্ত মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ছিল ভারত সরকারের তৎকালীন কোষাগার। সরকারি নির্দেশ এবং সামরিক বাহিনীর তত্ত্ববধানে একদিন কয়েকটি সীল করা ট্রাংঙ্ক এখানে রাখা হলো। এগুলো রাখতে যারা এসেছিলেন তাদের নাম পর্যন্ত স্মরণ করতে পারেন অশীতিপর নটু বাবু। অধ্যাপক ইউসুফ, নইমুদ্দিন এবং গোপাল ভট্টাচার্য দিনাজপুর শহর থেকে নিয়ে এসেছিলেন এসব ট্রাঙ্ক। তারা ছিলেন দিনাজপুরের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। পরে ইউসুফ সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন আমি জানিনা সেই সব ট্রাঙ্কে কি ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেসব ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দিনাজপুরে।’ ভারতের অবদান শুধু কথার কথা নয় কুটনৈতিক অঙ্গণে ও আন্তর্জাতিকভাবে নির্মিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিশাল অংশে ভারত জড়িয়ে আছে।

শত বেদনা ও কষ্টের মাঝে মুক্তির সাথে আনন্দ জড়িয়েছে যে, কয়েক বছর ধরে নানা ধরণের লেখা ও গবেষণায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের বিষয়টি নানা আঙ্গিকে উপস্থাপিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসকল ভারতীয় সেনা শহীদ হয়েছেন তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করে পর্যাক্রমে তাদের পরিবারগুলোকে সম্মান জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখক, সাহিত্যিক এবং স্মৃতিচারণে যারা বিভিন্নভাবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে তারাও একদিন সম্মাননার তালিকায় আসবেই।

লেখক : শিক্ষক গবেষক নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test