E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

১০ ডিসেম্বর : মাদারীপুর মুক্ত দিবস

২০১৪ ডিসেম্বর ১০ ০০:০৫:২৪
১০ ডিসেম্বর : মাদারীপুর মুক্ত দিবস

মাদারীপুর প্রতিনিধি : ১০ ডিসেম্বর। মাদারীপুর মুক্ত দিবস। মাদারীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও মুজাহিদদের কবল থেকে মুক্ত করেছে দেশকে। এ উপলক্ষে মাদারীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠন সকালে শহীদ সরোয়ার হোসেন বাচ্চুর মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

সংশ্লিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তখন স্থানীয় সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজে এয়ারফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর হোসাইনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয়। ১৭ এপ্রিল দুপুর ২ টায় মাদারীপুর শহরে ২টি বোমারু বিমানের সাহায্যে উপর্যপুরি বোমা হামলার পর ১৯ এপ্রিল মাদারীপুর শহরে পাক হানাদার বাহিনীর প্রবেশের আগ পর্যন্ত মাদারীপুর মুক্ত থাকে। আলমগীর হোসাইনের ট্রেনিং-এর এক সপ্তাহ পর ক্যাপ্টেন শওকত (পরবর্তীতে কর্ণেল হিসেবে অবসর প্রাপ্ত) ও স্টুয়ার্ট মুজিব (দেশ স্বাধীনের পরে ভারতীয় মিত্র বাহিনী দ্বারা নিহত) ও খলিল কেরানীসহ ১৫/১৬ জনের একটি দল উন্নত ট্রেনিং এর জন্য নোয়াখালী দিয়ে ভারতের অন্বিকাপুর যান। সেখানে ১০/১২ দিন ট্রেনিং দিয়ে দেশে আসেন। এলাকার সাবেক পুলিশ, সেনাবাহিনীর সদস্য, আনসার, কৃষক, ছাত্রসহ সর্বস্তরের জনতা এক হয়ে মুক্তি বাহিনী গড়ে তোলে। পাক হানাদার বাহিনী স্থানীয় এদেশীয় দালাল, রাজাকার, আলবদর, মুজাহিদ বাহিনীর সহায়তায় গোটা এলাকায় নির্যাতন চালায়। স্থানীয় এ.আর. হাওলাদার জুট মিলে ক্যাম্প তৈরি করে হত্যা, লুট, ধর্ষণ ইত্যাদি বিভিন্ন পৈশাচিক কর্মকান্ড করে। কিন্তু এ অত্যাচার নির্যাতনে মুক্তিযোদ্ধারা দমে না গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর মধ্যে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা মুক্ত হতে থাকে।

আগস্ট মাসে মাদারীপুর ফরিদপুরের সড়ক পথের ৩টি ব্রীজ যথাক্রমে সিদ্ধিরখোলা, চৌকদার ও সমাদ্দার ব্রিজ এক্স-ক্লুসিভের দ্বারা উড়িয়ে দিয়েছিল। য্দ্ধুকালীন সময়ে ব্রীজগুলো লোহার স্ট্র্যাকচার দিয়ে কোন রকম হালকা যান-বাহন চলার উপযোগী করা হয়েছিল। সর্বশেষ যুদ্ধ সংঘটিত হয় সমাদ্দার এলাকায়। ৬ ডিসেম্বর গভীর রাতে রাওফরমান আলীর নির্দেশে ব্রিগেডের হেড কোয়ার্টার ফরিদপুর সেনা নিবাসের আশে পাশের ৫ জেলার সকল পাকসেনাদের ফরিদপুর চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তৎকালিন মাদারীপুর মহাকুমার এস.ডি.ও মতিন সাহেবের ড্রাইভার আলাউদ্দিন মিয়া (মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স) মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্প, চৌহদ্দি ক্যাম্প, আমগ্রাম ক্যাম্পসহ সকল ক্যাম্পের পাকসেনাদের ফরিদপুর সেনানিবাসে চলে যাওয়ার গোপন সংবাদটি পৌছে দেন। তড়িৎ গতিতে মুক্তিযোদ্ধারা মেজর খলিলের নেতৃত্বে সমাদ্দার এলাকাটি ঘিরে ফেলে। ঘটকচর থেকে জিপ ও ট্র্যাকের আড়ালে পায়ে হেটে হেটে পাকসেনারা মেজর আ. হামিদ ঘটকের নেতৃত্বে সমাদ্দার ব্রিজ পার হওয়ার লক্ষে এগিয়ে যেতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পায়ে হেটে জমাদ্দার ব্রিজ পার হয়ে ট্র্যাক ও জিপে উঠে ফরিদপুর চলে যাওয়ার। ৭ ডিসেম্বর সংবাদ পাওয়ার পরেই মুক্তিযোদ্ধারা উন্নত অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সমাদ্দার এলাকা ঘিরে রেখেছিল। প্রধান সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ দিক মুক্তিযোদ্ধারা বাংকার করে রেখেছিল। পাকসেনাদের ওয়্যারল্যাসসহ গাড়িটি ব্রিজে উঠার সাথে সাথে অ্যান্টিট্যাংকমাইনের আঘাতে ব্রিজ ভেংগে গাড়িটি পানিতে পড়ে যায়। দ্রুতগতিতে পাকসেনারা পূর্বদিকে আগেই তৈরি করে রাখা ৬টি বাংকারে আশ্রয় নেয়। ৯ ডিসেম্বর সারা দিন সারারাত তুমুল যুদ্ধের পর পাকসেনাদের বাংকারে খাদ্যের রসদ ঘুরিয়ে গেলে তারা সাদা পতাকা তুলে সন্ধির প্রস্তাব দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সীজ ফায়ারের সুযোগে গাড়ীতে রাখা খাদ্য দ্রুতগতিতে বাংকারে নিয়ে আসে। ১ ঘন্টা বিরতিতে পাকসেনারা আবার ফায়ারিং শুরু করে। ১০ ডিসেম্বর সকাল ৯ টার দিকে মেজর খলিল যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। কৌশল হিসাবে উপর্যপুরি গ্রেনেড হামলার স্বীদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মাদারীপুর মুক্তিযোদ্ধাদের সকলের প্রিয় এবং সকলের ছোট একমাত্র সদস্য সরোয়ার হোসেন বাচ্চু মেজর খলিলের কাছে আবদার করে, তার সাথে বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করতে যাওয়ার জন্য। সকল বাধা অগ্রাহ্য করে সে কমান্ডারের সাথে যায়। সে উপর্যপুরি গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। ৩৮টি গ্রেনেড চার্জ করার পর ৩৯ গ্রেনেড চার্জের সময় পাকসেনাদের সরাসরি গুলির আঘাতে সরোয়ার হোসেন বাচ্চু নিহত হন। তাকে সমাধিস্থ করার জন্য মাদারীপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এবং সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজের প্রবেশ মুখে তাকে কবর দেয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে পাকসেনাদের খাদ্য ও গোলাবারুদের রসদ শেষ হয়ে গেলে তাদের মনোবল একেবারেই ভেংগে যায়। তারা আত্মসমর্পন করার জন্য সংকেত পাঠায় এবং আত্মসমর্পন করে। রাতের বেলায় মেজর খলিল পাকসেনাদের ডিসআর্মড না করে পরের দিন ১১ তারিখ সকালে মেজর ঘটক মুক্তিযোদ্ধা মেজর খলিলের নিকট তার ক্যাপ, বেল্ট ও পিস্তল খুলে জমা দেন ও আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পন করেন। ৩৯ জন পাকসেনা এবং ১৫ জন রাজাকার, মুজাহিদসহ মেজর ঘটক আত্মসমর্পন করেন। আত্মসমর্পনের পর পর মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ জন রাজাকার ও মুজাহিদদের পায়ের তলায় পৃষ্ট করে মেরে ফেলে । ঐদিন পাকসেনাদের মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দুয়া ইউনিয়নের কলাগাছিয়া হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসেন। ১১ ও ১২ ডিসেম্বর ঐ ক্যাম্পে সকলে অবস্থান করে। ১৩ ডিসেম্বর সরোয়ার হোসন বাচ্চুর মাজারে নিয়ে আসেন। ঐখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর সরকারী নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে নিয়ে আসেন। সেখানে খাওযা দাওয়া ও শীত বস্ত্র পড়ানোর পর আহত সেনাদের চিকিৎসার জন্য সদর হাসপাতালে এবং সুুস্থ্য সেনাদের মাদারীপুর জেলে প্রেরণ করা হয়।

২৮ ডিসেম্বর তাদেরকেসহ আশেপাশের ৫ জেলার আত্মসমর্পনকৃত পাকসেনাদের ফরিদপুর এসপির নেতৃত্বে ঢাকায় পাঠানো হয়। এভাবেই মাদারীপুর হানাদার মুক্ত হয়।


(এসিএ/পি/ডিসেম্বর ১০, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test