E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ ৪৩ বছরেও ফিরে পাননি শ্রবণ শক্তি

২০১৪ ডিসেম্বর ১৪ ১৫:৪৩:৩৩
মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ ৪৩ বছরেও ফিরে পাননি শ্রবণ শক্তি

রাজীবপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি : কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে জোরে কথা বলতে হবে। কোনো কিছু জানার বা তার কথা শুনতে হলে ওই একই কায়দায় উচ্চস্বরে কথা বললেই কেবল কানে শুনতে পান তিনি। এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলে বলে জানা গেল শ্রবণ প্রতিবন্ধী মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদের (৬৭) মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী এবং যুদ্ধে অংশ নেওয়া স্মরনীয় ও করুণ ঘটনা গুলো। মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীদের অবিরাম গোলা বর্ষণের শব্দে শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলা ওই বীর দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছরেও ফিরে পাননি শ্রবণ শক্তি।

মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি তখন ৭ম শ্রেণীতে পড়ি। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে বাবা-মাকে বললে তারা যুদ্ধে যেতে দিবে না-এই ভয়ে গোপনে স্থানীয় খাড়–ভাঁজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলা মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষনে যোগ দেই। এখানে প্রশিক্ষন নিয়ে মুক্তিবাহিনীদের সঙ্গে চলে যাই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সম্মুক যুদ্ধে। এখানে ১৭ পাক সেনাকে হত্যা করি। তারপর আরো প্রশিক্ষনের জন্য ভারতের কাকরিপাড়া ও দার্জিলিং মুজিব ক্যাম্পে প্রশিক্ষন গ্রহণ করে যোগ দেই লালমনিরহাটের হাতীবান্দার বড়খাতা যুদ্ধে। সুবেদার ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা দুইশ’ মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীদের হটিয়ে তাদের বাংকার দখল করে নেই। পরে পাক সেনারা আমাদের ওপর আর্টিলারি ও শিলিং বোমা বর্ষণ শুরু করে। তাদের অবিরাম বোমা বর্ষণে আমার সঙ্গে থাকা দুইশ’ মুক্তিবাহিনীর করুণ মৃত্যু ঘটে আমার চোখের সামনে। আর ওই গোলা বর্ষণের বিকট শব্দে ও আতংকে আমার শ্রবণ শক্তি হারিয়ে যায়। কিন্তু আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।’

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের খাড়–ভাঁজ গ্রামে বসবাস করেন নুর মোহাম্মদ। ব্রহ্মপুত্র নদের কিনারায় ন্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সহায় সম্পদ বলতে একমাত্র বাড়ির ভিটা সেটাও ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে। ৪ মেয়ে ও ১ ছেলেকে নিয়ে তাদের সংসার। মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ছেলে ঢাকায় গামেন্টসে চাকরি করে। ছেলের একটা সরকারি চাকরির জন্য নুর মোহাম্মদ বিভিন্ন স্থানে ছোটাছুটি করেছেন। অনেক কর্মকর্তার হাতে পায়েও ধরেছেন টাকার অভাবে তা আর ভাগ্যে জোটেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসে যে দুই হাজার টাকা ভাতা পাওয়া যায় তা দিয়েই চলে তাদের সংসার।

তিনি আরো বলেন, ‘টাকার অভাবে আমার চিকিৎসা করাতে পারছি না। উন্নত চিকিৎসা করালে হয়তো আমি নিজের স্বাধীন করা দেশের মানুষের কথা শুনতে পারতাম। কানে শুনতে না পেলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে এবং আমি তা দেখে যেতে পারব এটাই আমার সবচেয়ে বেশি পাওয়া।’ নুর মোহাম্মদের স্ত্রী হামিদা বেগম বলেন, ‘যে মানুষটা নিজের জীবনের মায়া করে নাই। তার বাবা-মাকে না জানিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেই মানুষটা এখন কানে শুনতে পান না। নিজের স্বাধীন করা দেশের মানুষের কথা শুনতে পান না। এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কত কিছুই না করছে। অথচ আমার মানুষটা একেবারে অসহায় জীবনযাপন করছে।’

মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ মনে যে দেশপ্রেম রয়েছে ঠিক তেমনি তার স্ত্রী হামিদা বেগম’রও। আর এ কারণে গত ২৭ বছর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হয়ে জনসেবা করে আসছেন। হামিদা বেগমের সততা আর নিষ্ঠার কারণে তার প্রতিদ্বন্ধিতা কেউ করতে সাহস পায় না। কেননা বিভিন্ন ত্রাণ সমাগ্রি, ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা প্রদানে একটি পয়সাও ঘুষ গ্রহণ করেন না তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কেউ তুলতে পারেনি। হামিদা বেগম বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর নির্দেশ ও আর্দেশের এক বিন্দুও এদিক ওদিক করি না। তার সততা ও নিষ্ঠাই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন।’

রাজীবপুর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হাই সরকার জানান, নুর মোহাম্মদ এর পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়। বিভিন্ন সময়ে সরকারি সাহায্য সহযোগিতা এলে তাকে প্রথমেই হিসাবে রাখা হয়। শ্রবণ শক্তি হারানো ওই অভাবের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে।

(আরএস/এএস/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test