E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দেশ থেকে রাজনীতি হারিয়ে যাওয়ার একটি গল্প

২০২০ এপ্রিল ২৯ ২৩:২৮:৩৮
দেশ থেকে রাজনীতি হারিয়ে যাওয়ার একটি গল্প

প্রবীর সিকদার


কোনো এক বড় দুর্যোগের পর ব্যস্ত ইউনিয়ন পরিষদ! ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আসছেন ইউনিয়ন পরিষদে! কেউ ত্রাণ সামগ্রি নিচ্ছেন, কেউ ত্রাণের তালিকায় নাম লিখিয়ে যাচ্ছেন! বাজারের পাশেই ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়, স্কুলের খেলার মাঠ! ত্রাণ সামগ্রি বিতরণে কোনো অনিয়ম হলেই এক ছাত্রনেতা খালি তেলের ড্রাম গড়াতে গড়াতে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে এনে খাড়া করে তার উপর দাড়িয়েই শুরু করে দেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বরদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা! সব ত্রাণ মেরে খাচ্ছে চেয়ারম্যান মেম্বররা!

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খুব ভদ্র মানুষ। তিনি ডেকে ওই ছাত্রনেতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সরকার ত্রাণের মাল দেয়, কিন্তু ট্রাক ভাড়া দেয় না! ট্রাক ভাড়ার জন্য সবাইকেই কিছু কিছু কম দিয়ে ত্রাণ সামগ্রি বিতরণ করতে হয়! চেয়ারম্যানের ওই কথায় কোনো কাজ হয় না! সুযোগ পেলেই তেলের ড্রামের উপর দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা অব্যাহত রাখেন ছাত্রনেতা।

চেয়ারম্যান একদিন তার এক ঘনিষ্ঠ পরামর্শকের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। পরামর্শক তাকে চিন্তা না করার কথা বললে চেয়ারম্যান বিচলিত হয়ে বলেন, সাবধান ওকে মারধর করা যাবে না! পরামর্শক আশ্বস্ত করে বলেন, না না, তা করবো না; আমি একটি অন্য ব্যবস্থা করবো; সব ঠিক হয়ে যাবে! তুমি শুধু আমাকে একটু আধটু সহযোগিতা করবে! চেয়ারম্যান সম্মতি জানালেন।

একদিন বিকেলে স্কুল মাঠে একা বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছিলেন চেয়ারম্যানের পরামর্শক! পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন ওই ছাত্রনেতা। ছাত্রনেতাকে ডাক দিয়ে পাশে বসালেন। জিজ্ঞেস করলেন কুশলাদি। এক পর্যায়ে পরামর্শক বললেন, নেতা, তুমি প্রতিদিন এতো রাতে বাড়ি ফিরে যাও কিভাবে? ছাত্রনেতা বললেন, হেঁটে। পরামর্শক বললেন, হেঁটে তো বুঝলাম; কিন্তু মূল রাস্তা থেকে তোমাদের বাড়িতে যাওয়ার তো কোনও রাস্তা নেই! তাহলে ওই টুকু কিভাবে যাও? ছাত্রনেতা বললেন, কেন হেঁটে! পরামর্শক বললেন, হেঁটে তো বুঝলাম! বৃষ্টি বন্যায় তো মূল রাস্তার পাশে পানি জমে যায়! ওই কাদা-পানির মধ্য দিয়ে যেতে কষ্ট হয় না? ছাত্রনেতা বললেন, কষ্ট হলে আর কী করা! পরামর্শক বললেন, নেতা কাদামাটি মাড়িয়ে বাড়ি যাবে, এটা হয় না! দেখি রাস্তার ব্যবস্থা কী করা যায়! ছাত্রনেতা বললেন, রাস্তা করার টাকা পাবো কোথায়! এবার পরামর্শক বললেন, ওই চিন্তাটা আমাকেই করতে দাও। এবার ছাত্রনেতা ধন্যবাদ জানিয়ে পরামর্শকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে তেলের ড্রাম উঁচিয়ে চেয়ারম্যান মেম্বরদের অপকর্মের ফিরিস্তি জানিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একদিন পরামর্শককে ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে এনে বললেন, আপনি ছাত্রনেতার কি করলেন? ও তো বক্তৃতা দিয়েই চলেছে! পরামর্শক মুচকি হেসে চারদিক তাকিয়ে চেয়ারম্যানের কানে কানে কি যেন বললেন! চেয়ারম্যান সম্মতি দিতেই পরামর্শক বেরিয়ে গেলেন! পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট ও ম্যাচের বাক্স বের করতে না করতেই পরামর্শক সামনে পেয়ে গেলেন ওই ছাত্রনেতাকে! তাকে হাতের ইশারায় ডেকে নিয়ে স্কুল মাঠের মাঝখানে গিয়ে বসতে বসতে বললেন, তোমার বাড়ির রাস্তা হয়ে গেছে! ছাত্রনেতা বিস্মিত হলেন! পরামর্শক তাকে বসতে বললেন। ছাত্রনেতা বসার পরে পরামর্শক বললেন, তোমার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা হবে কাবিখার সরকারি প্রজেক্টে! তারপর তিনি ছাত্রনেতাকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বললেন, এই প্রজেক্টের চেয়ারম্যান, আর কাউকে বানানো যাবে না! তুমিই হবে চেয়ারম্যান! নইলে প্রজেক্টের সব গম ওরা মেরে খাবে! সম্মতি জানিয়ে ছাত্রনেতা চলে গেলেন!

একদিন হটাত ছাত্রনেতার ডাক পড়লো ইউনিয়ন পরিষদে! নেতা হাজির হলেন। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পাশে বসা পরামর্শক বললেন, তোমার বাড়ির রাস্তার জন্য সরকার তিন মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করেছে। তুমি গম নিয়ে যাও। ছাত্রনেতা বললেন, এখানেই থাকুক, কাজের সময় নেওয়া যাবে! পরামর্শক বললেন, মোটেই এখানে রাখা যাবে না; সব গায়েব হয়ে যাবে! তুমি তোমাদের গুদামঘর খুলে দাও, আমি কুলি লাগিয়ে গম পাঠিয়ে দিচ্ছি। ছাত্রনেতা চলে গিয়ে গুদামঘর খুললেন, আর কুলিরা একের পর এক গমের বস্তা সাজিয়ে রেখে চলে গেলেন!

ছাত্রনেতা এবার বাড়ির রাস্তার কাজে হাত দিবেন! যেখানেই দেখা হোক, চেয়ারম্যানের পরামর্শকের সাথে, দেখা হলেই ছাত্রনেতা বলেন, কাকা কবে কিভাবে রাস্তার কাজ শুরু করবো, সেটা তো বলছেন না! পরামর্শক একগাল হেসে বলেন, পাগল ছেলে, এতো চিন্তা কিসের! মালপত্র আমাদের হাতে, একসময় শুরু করা যাবে!

আজকাল করতে করতে বৃষ্টির সময় চলে এলো, তবু কাকা যে কেন রাস্তার কাজ শুরু করতে বলছেন না, সেই চিন্তায় ছাত্রনেতা অস্থির! এরই মধ্যে একদিন ছাত্রনেতাকে পরামর্শকের বাড়িতে ডেকে পাঠানো হলো। ছাত্রনেতা সময়মত তার বাড়িতে গিয়ে হাজির! জানতে চাইলেন, বৃষ্টি চলে এলো, আর কবে শুরু করবো রাস্তার কাজ! পরামর্শক একগাল হেসে চেয়ারে বসতে বলে এগিয়ে দিলেন কয়েক পৃষ্ঠা রোলটানা লেখা কাগজ! ছাত্রনেতা বুঝলেন, এটা মাস্টাররোলের কাগজ! পরামর্শক পাতায় পাতায় সই করার জন্য ছাত্রনেতার দিকে কলম এগিয়ে দিলেন! ছাত্রনেতা বিস্ময়ে হতবাক, কাজই তো শুরু করলাম না; এখনই মাস্টাররোল জমা দিবো কেন! পরামর্শক বললেন, এই কাজের এই নিয়ম! কাগজ পাকা তো সব পাকা! এই বৃষ্টিটা কমলেই আমরা কাজ শুরু করবো! তুমি সই করে দাও! ছাত্রনেতা আর কথা না বাড়িয়ে পাতায় পাতায় সই করে বললেন, দিনমজুরদের হাতের টিপসই কোথায় পাবো! পরামর্শক আর একগাল হেসে বললেন, সে সব আমি ডান হাত বাম হাত দিয়ে করে নিবো। ছাত্রনেতা উঠতে যাবেন, তখন একটু বসার সংকেত দিয়ে পরামর্শক বললেন, আমাদের রাস্তার কাজে ওই তিন মেট্রিক টন গম লাগবে না। এক/দেড় টন হলেই চলবে! তুমি আজই অর্ধেক গম বিক্রি করে ফেলবে! পরামর্শকের এই কথা শুনে ছাত্রনেতা আকাশ থেকে পড়লেন, কী বলেন! এতো সরকারি কাজের গম! এই গম আমি কি করে বিক্রি করি! পরামর্শক হেসে বললেন, যে কাজের যে নিয়ম, সেই নিয়ম মানতে হয়! এই সব কাজে অর্ধেক চেয়ারম্যান খায়, বাকি অর্ধেকে অন্যরা পায়, আর কাজ শেষ করতে হয়! এখন তুমিও তো প্রজেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান! আমি তো বলছি তোমাকে! আর তো কেউ জানবে না! তুমি আজই অর্ধেক গম বিক্রি করে নিজের জন্য একটি বাইসাইকেল কিনবে, আর তোমার অনুগত ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিদিন নাস্তাপানি খাবে! কিছু না খাওয়ালে ওরা তোমার পেছনে থাকবে কেন! ছাত্রনেতা সাইকেলের কথা শুনে কেমন যেন খুশি খুশি হয়ে গেলেন! কতো দিনের সখ একখানা সাইকেলের! পরামর্শকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছাত্রনেতা বাজারে গিয়েই অর্ধেক গম নগদ টাকায় বিক্রি করে দিলেন! তারপর শহরে গিয়ে নতুন সাইকেল কিনলেন, আর বানাতে দিলেন নতুন শার্ট প্যান্ট! কী খুশি তার মন!

একদিন মাঠে সিগারেট টানছিলেন চেয়ারম্যানের পরামর্শক! দেখলেন পাশ দিয়েই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে সেই ছাত্রনেতা! পরামর্শক নাম ধরেই ডাকলেন! ছাত্রনেতা এসে বসতেই পরামর্শক বললেন, দারুণ রুচি তোমার! এই না হলে নেতা! ভালো সাইকেল কিনেছ; নতুন শার্ট প্যান্টও মানিয়েছে বেশ! ছাত্রনেতা লাজুক হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, রাস্তার কাজ শুরু করতে হবে না! পরামর্শক একগাল হেসে বললেন, অবশ্যই শুরু করবো! তবে বৃষ্টি বাদলার মউসুম যাক! ছাত্রনেতা বললেন, ততদিন গম তো ইঁদুরের পেটে চলে যাবে! পরামর্শক বললেন, তা যাবে কেন! তুমি ওই বাকি গমও আজ বিক্রি করে দিবে! আমরা গম বিক্রির টাকা দিয়েই রাস্তার কাজ করবো। ছাত্রনেতা বললেন, বিক্রি করে টাকা আপনার কাছে রেখে দিই! পরামর্শক বললেন, তা কেন, থাকুক তোমার কাছেই! ছাত্রনেতা বললেন, টাকা আমার কাছে থাকলে তো সব খরচ হয়ে যাবে! পরামর্শক হেসে বললেন, তোমার টাকা শেষ হলেও তো সরকারের গম শেষ হবে না! আবার প্রজেক্ট হবে! সেই প্রজেক্টেই তৈরি হবে তোমার বাড়ির রাস্তা! এবার ছাত্রনেতা মুচকি হেসে বিদায় নিলেন। ওই সময়েই গুদামঘর খুলে বাকি গমও বিক্রি করে দিলেন নেতা!

এভাবেই চলে গেল অনেকদিন! ছাত্রনেতা আর ওই পরামর্শককে তাড়া দিচ্ছেন না! একদিন সকালে পরামর্শক ওই ছাত্রনেতাকে ডেকে পাঠালেন তার বাড়িতে! ছাত্রনেতা এলেই তিনি রাস্তার কাজ শুরুর কথা বললেন! ছাত্রনেতা লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। পরামর্শকের ভেতরে তখন হাসি, কাজের কাজ বুঝি হয়ে গেছে! ভেতরের হাসি চেপে পরামর্শক জানতে চাইলেন, কি হয়েছে তোমার বল, এতো লজ্জা কিসের! ছাত্রনেতা বললেন, গম বিক্রির সব টাকাই যে খরচ করে ফেলেছি! এবার হো হো করে হেসে ফেললেন পরামর্শক! এক পর্যায়ে হাসি থামিয়ে বললেন, কোনো চিন্তা নেই; আবার প্রজেক্ট হবে; সেই প্রজেক্টেই তৈরি হবে নেতার বাড়ির রাস্তা! নো টেনশন!

বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা! ইউনিয়ন পরিষদে ত্রাণ সামগ্রি বিলিবণ্টন করছেন পরিষদের চেয়ারম্যান। আর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরের বাইরের ফাঁকা জায়গায় তেলের ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ত্রাণ চুরির অভিযোগ তুলে চেয়ারম্যান মেম্বরদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন ওই ছাত্রনেতা। বক্তৃতা শুনতে শুনতেই পরামর্শক ঢুকলেন ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে। পরামর্শক বসতে না বসতেই চেয়ারম্যান অনুযোগের সুরে বললেন, কী করলেন আপনি! ছাত্রনেতা যে আমার গুষ্ঠি উদ্ধার করা থামাচ্ছেই না! পরামর্শক হাত উঁচিয়ে চেয়ারম্যানকে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করে বললেন, আমি আজই দেখছি বিষয়টি! বক্তৃতা শেষে যখন ছাত্রনেতা সাইকেল চালিয়ে চলে যান, তখন একজন চৌকিদার ডেকে পরামর্শক ছাত্রনেতাকে ডেকে আনতে বললেন। কিছু সময় পর ছাত্রনেতা এলেন। এবার আর পরামর্শকের মুখে সেই হাসি নেই! বসতে বলে একটু গম্ভীর হয়ে পরামর্শক বললেন, এবার তোমার উচিত কথা বলা থামাতে হবে! পকেট থেকে সেই মাস্টাররোলের কাগজ বের করে বললেন, চোর তো শুধু চেয়ারম্যান নয়; তুমিও! রাস্তা নির্মাণ না করেই ভুয়া মাস্টাররোল জমা দিয়ে তুমি তিন মেট্রিক টন গম বিক্রি করে টাকা মেরে দিয়েছ! এবার থানায় মামলা হবে, নির্ঘাত জেল হবে তোমার! পরামর্শকের এই কথায় ভয়ে ও লজ্জায় আঁতকে উঠলেন ছাত্রনেতা! ত্রাণপ্রার্থী মানুষেরাও শুনে হতবাক! তাদের নেতাও গমচোর! সবার মুখে তথন ছিঃ ছিঃ! ছাত্রনেতা কথা বলছেন না! এবার পরামর্শক ছাত্রনেতার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, তোমার বাড়ির রাস্তা আবার হবে! কিন্তু কথায় কথায় তেলের ড্রামের উপর উঠে আর বক্তৃতা দেওয়া যাবে না! এইটুকু হলেই চলবে! এবার থেকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে! মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ জানিয়ে ছাত্রনেতা চলে গেলেন!

তারপরের ইতিহাস আসলেই ইতিহাস! ছাত্রনেতা আর কখনোই তেলের ড্রামের উপরে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেননি! ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের পরামর্শকও কথা রেখেছিলেন, হয়নি কোনো থানা পুলিশ; নির্মাণ করা হয়েছিল ছাত্রনেতার বাড়ির রাস্তাও! আর এইভাবেই অঙ্কুরে হারিয়ে গেলেন সম্ভাবনাময় এক নেতা!

(পিএস/এপ্রিল ২৯, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test