E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

করোনায় বিপর্যস্ত গ্রামীণ অর্থনীতি

২০২০ এপ্রিল ২৫ ১৬:১৬:৩৯
করোনায় বিপর্যস্ত গ্রামীণ অর্থনীতি

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার : সারা পৃথিবীর ন্যায় করোনায় বিপর্যস্ত আজ বাংলাদেশও। আমাদের মতো ক্ষুদ্র দেশে প্রচুর জনসংখ্যার চাপতো রয়েছেই। আর এ জনসংখ্যার বেশির ভাগই বাস করে গ্রামে। গ্রামের এসব খেটে এসব গ্রামীণ মানুষের মূল পেশাই হলো কৃষি। যে পেশা আদিম পেশা হিসেবেই পরিচিত। গ্রামে বসবাস করা ৮০ভাগ মানুষই কৃষির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিগত অর্থ বছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ১৩.৭ শতাংশ (বিবি)। এসব কৃষির উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে অনেক শিল্প আবার এই কৃষিই আমাদের খাদ্য সরবরাহের মূল উৎস। কৃষি এখন আর কেবল মাঠে ফসল উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সাথে যোগ হয়েছে প্লোট্রি ও মৎস্য চাষের মতো খাত। করোনার ফলে চলা দীর্ঘদিনের লক ডাউন মানুষকে যেমন করেছে ঘরমুখী তেমনি সৃষ্টি করেছে আতংক। ঘর থেকে মানুষ বের হতে না পারার কারণে কৃষি পণ্যের বাজারে যোগান থাকলেও কমছে চাহিদা। যোগান বেশি ও চাহিদা কম থাকায় কৃষক তার ন্যায্য মূল্য থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। মানুষ দীর্ঘদিন লকডাউনের ভয়ে খাদ্য সামগ্রী ব্যবহারের ক্ষেত্রেও হয়েছে অনেকটাই সাশ্রয়ী। 

তবে বিপাকে রয়েছে শহরে বসবাস করা মানুষ। শহরে কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারিগর হচ্ছে মধ্যস্বত্ব ভোগী কারবারিরা। পরিবহন সমস্যা ও উৎপাদন কম হওয়ার অজুহাতে দাম বৃদ্ধি করছে ব্যবসায়ীরা। শহরে পণ্যের দাম বেশি থাকলেও তা থেকে বঞ্চিত সাধারণ কৃষক। অন্যদিকে গ্রামের কৃষকরা জীবন রক্ষায় ফসল উৎপাদন করা থেকে নিজেদেরকে কিছুটা হলেও সরিয়ে নিয়েছে । এবং যারা শ্রমিক নির্ভর কৃষিকাজ পরিচালনা করে থাকে তাদের ক্ষেত্রে চরম আকার ধারণ করেছে শ্রমিক সংকট।

দেশীয় কৃষি উৎপাদনের প্রধান উৎস বোরো ধান। আর সামনে বোরো ধান সংগ্রহে কৃষি শ্রমিক সংগ্রহের বিষয়টি এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে উৎপাদিত ধান ঘরে তোলা নিয়ে দেখা দিতে পারে চরম বিশৃংখলা।বর্তমান সময়ে ধানের দাম বৃদ্ধি পেলেও কৃষকরা এ দাম থেকে বঞ্চিত। কারণ কৃষকের গোলায় এখন আর নেই ধান।যেসব ধান রয়েছে তার বেশির ভাগই পাইকার শ্রেণির হাতে। গ্রামীণ মানুষের প্রধান পেশা কৃষি তাই এক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে চলতি বছরের জিডিপির উপর চরম ভাবে আঘাত পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশে ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট ২০১৮/১৯ অনুযায়ী গত অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮.১৫% অর্জিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ২০১৯/২০ অর্থ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮.২০% লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় যা পড়ে যাবে চ্যালেঞ্জের মুখে। এবং এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁডাবে। এছাড়াও গ্রামে গঞ্জে গড়ে ওঠা প্লোট্রি শিল্পেও নেমে এসছে চরম বিপর্যয়।

যার ফলে যেমনি বাঁধাগ্রস্থ হবে কর্মসংস্থান তেমনি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে কৃষি ভিত্তিক গড়ে উঠা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। স্বল্পভাবে উৎপাদন চালু থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়,শিল্প পণ্যের বাজার, হস্ত ও কুটির শিল্প প্রভাবের বাইরে থাকবে না। কৃষি খাদ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদন করে দেশকে পরমুখাপেক্ষী হতে দেয় না। দ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে কৃষি। গ্রামীণ কৃষি পরিবহন উন্নয়ন,অঞ্চল ভিত্তিক শিল্প ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শুধু যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করে তা নয় এক্ষেত্র থেকে প্রচুর পরিমাণে রাজস্বও সংগ্রহ করে থাকে সরকার।

এছাড়াও রাজনীতিতে কৃষিতে উন্নত দেশগুলোর প্রভাব বিভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয় বলে দরিদ্র এবং খাদ্য ঘাটতির দেশগুলো আন্তর্জাতিক খাদ্য রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। ফলে অনুন্নত,স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে ব্যাহত হয়।

সুতরাং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও কৃষির ভূমিকা ব্যাপক। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে বৈদেশিক রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানা যায় ২০১৮/১৯ অর্থ বছরে ১৬৪১৯.৬৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২৪৯৮.৫৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিট্যান্স এসেছে আমাদের দেশে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ লকডাউন থাকায় দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ কমে এসেছে এমনকি প্রচুর পরিমাণে প্রবাসী দেশে চলেও এসেছে কর্মসংস্থানের মন্দার কারণে।

করোনার প্রভাব চলে যাবার পর তাদের পুনরায় যাওয়া নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এখন অর্থবছরের বাকি চার মাসে আর কত আসে সেটা দেখার বিষয়। রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো তৈরি পোশাক। বিজিএমইএ’র সদস্য সংখ্যা ৪হাজার ৬২১টি । আর এসব কারখানায় কর্মরত রয়েছে ৪১ লাখেরও বেশি শ্রমিক। বিবির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায় গত অর্থবছরে ৩৪১৩৩.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার এসেছে তৈরি পেশাক রপ্তানি খাত থেকে যা রপ্তানি আয়ের ৮৪.২১ ভাগ। এখাতে এখন নেমে এসছে চরম বিপর্যয়।

বিভিন্ন দেশের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এবং এ থেকে কোনদিন পরিত্রাণ পাওয়া যাবে তার সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই।এই সেক্টর বন্ধ থাকাতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার জীবন যাপন করছে এবং এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই গ্রামের। ফলে গ্রামে নেমে এসছে চরম বিপর্যয়। যা আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি তথা দেশের অর্থনীতির উপর চরম প্রভাব পড়বে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। এসব ক্ষতির হাত থেকে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরের জন্য প্রণোদনার কথা ঘোষণা করেছেন। এখন দেখার বিষয় এসব প্রণোদনার বাস্তবায়ন কতটা ফলপ্রসূ হয়। আর এর ফলপ্রসূতা অনেকটাই নির্ভর করবে ভূক্তভোগীদের নিকট প্রণোদনার অংশ সঠিকভাবে পৌঁছানো।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যম কর্মী।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test