E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টিলার ওপর রহস্যময় এক কালো পাথর ও পেছনের গল্প!

২০২১ জুন ৩০ ১৭:১৮:১৩
টিলার ওপর রহস্যময় এক কালো পাথর ও পেছনের গল্প!

মতিউর রহমান মুন্না : ৩৬০ আউলিয়ার পূণ্যভূমি বৃহত্তর সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার অন্যতম উপজেলার নাম নবীগঞ্জ। নবীর নামানুসারে ঐতিহ্যবাহী এ উপজেলার নাম নবীগঞ্জ করা হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে আড়মোড়া দিয়ে ওঠা এই নবীগঞ্জ সুন্দর্যের যেন কোনো অংশে কম নেই এর কোন এলাকা। এ উপজেলার অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর দূর্গম পাহাড়ী অঞ্চল দিনারপুর পরগনা।

দিনারপুরে রয়েছে দর্শনীয় স্থান যেখানে পর্যটকরা একবার হলেও ঘুরতে আসেন এই জনপদে। অসংখ্য বাঁশ ও গাছ ঘেরা এ পরগনার দেবপাড়া ইউনিয়নের সদরঘাট পূর্ব দেবপাড়া গ্রামে অবস্থিত সুউচ্চ একটি পাহাড়। এ পাহাড়ের দক্ষিণে রয়েছে আরও একটি উঁচু পাহাড় নাম মীরটিলা। এছাড়া এখানে রয়েছে চা ও রাবার বাগান এবং উঁচু-নিচু হরেক রকমের পাহাড় টিলায় আবৃত দিনারপুরের জনপদ। এই এলাকা বাঁশের জন্য বিখ্যাত। দিনারপুরে শত শত টিলায় এখন চলছে বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব। এক সময় দিনারপুর পরগনা বৃক্ষের জঙ্গল হিসেবে পরিচিত ছিল। টিলায় টিলায় গাছপালা, লতাপাতায় সজ্জিত ছিল এই পরগনা। দিনারপুরের ইতিহাস অতি সমৃদ্ধ। এ অঞ্চল কৃষ্টি ও ঐতিহ্যে ভরপুর একটি সুপ্রাচীন জনপদ।

এই এলাকায় যেমন রয়েছে দর্শনীয় স্থান তেমন রয়েছে অনেক ইতিহাসও। দিনারপুরে সবচেয়ে উঁচু পাহাড় হচ্ছে ‘কুরুটিলা’। আর এ কুরুটিলায় অবস্থিত হাজার বছরের ইতিহাস, কালের সাক্ষী নিখুঁত এক কালো পাথর। রহস্যময় এ পাথরটি আজও উৎসুক মানুষের মনের খোরাক জোগায়।

দেবপাড়া ইউনিয়নের কবুলেশ্বর গ্রামের পাশে হাজার বছরের পুরনো জঙ্গল বাড়িতে অন্তত ১ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় কুরু টিলা। পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে শত বছরের পুরনো একটি বটগাছ। বটগাছের পাশেই একটি ছোট কদম গাছের নিচে রয়েছে শত বছরের পুরনো এই কালো পাথর। পাথরটি দিন দিন বড় হচ্ছে। এখন এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৫ ফুট ও ৩৩ ফুট প্রস্থ।

রহস্যজনক কালো পাথর নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে কৌতুহলও। পাথরটি সামনে রেখে অনেকে মনোবাসনা পূরণের জন্য শিরনি বিতরণ ও মোনাজাত করে থাকেন। প্রতিদিন ওই কালো পাথরকে দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন ছুটে আসেন। এলাকাবাসীর কাছ থেকে শোনেন পাথরের কাহিনি। সরেজমিনে গেলে পাথরকে নিয়ে প্রচলিত গল্প বলেন স্থানীয় প্রবীন কয়েকজন লোক। তাদের ভাষ্যে রহস্যময় এ কালো পাথরের হাজার বছরের ইতিহাসঃ

এই পাহাড়ের অদূরেই রয়েছে সদরঘাটের সুপ্রাচীন ইমামগঞ্জ বাজার। শত শত বছর আগের কথা। সে সময় এ বাজারে বড় বড় মাছ কেটে বিক্রি হতো। মাছের পরিত্যক্ত অংশ ফেলে দিত বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ীরা। আর ফেলে দেয়া মাছের এই পরিত্যক্ত অংশগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যেতেন সাদা পোশাক পরিহিত এক লোক। সবাই উনাকে ভিক্ষুক মনে করতো।

আর এ দৃশ্য প্রতিদিন মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করতেন পূর্ব দেবপাড়ার সামছু মিয়া নামের জনৈক ব্যক্তি। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা ছিল তার স্বভাব। প্রতিদিনের মতো একদিন সন্ধায় বাজার শেষে ওই লোক ইমামগঞ্জ বাজার থেকে মাছের ফেলে দেয়া অংশ কুড়িয়ে নিয়ে কুরুটিলা পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছেন। সামছু সাদা পোশাক পরিহিত লোকটির পিছু নেয়। পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে সামছু দেখতে পায় ছোট্ট একটি পাথরের সামনে গিয়ে ওই লোক ইশারা করতেই পাথর সরে গিয়ে ওই স্থানে একটি সুড়ঙ্গ রাস্তা হয়ে গেছে। আর ওই রাস্তায় লোক ভেতরে ঢুকে গেলেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন উনি দরবেশ ছিলেন। সামছু মিয়া অতি সতর্কতার সঙ্গে পিছু নিলেও দরবেশের স্বচ্ছ হৃদয়ের আয়নাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ধরা পড়ে যায় একজন আগন্তুক তার পিছু নিয়েছে। এই ভেবে দরবেশ পাথরের কপাট খোলা রেখেই ভেতরে চলে যান। সামছু মিয়াও না দেখে ফিরবেনা তার রহস্য কি। পাথরের কপাটের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পায় সেখানে একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। এ পথ দিয়ে সেও ভেতরে ঢুকে পড়ে। ভেতরে ঢুকে সামছু মিয়া গাবরে যায়। দেখতে পায় এক কল্পনাপুরীর রাজপ্রাসাদের দৃশ্য ও মুগ্ধকর পরিবেশ। নানা ফুলের মিষ্টি সুভাষ। স্বর্ণের তৈরী বাড়ির মতো মনে হয়েছে সামসুর। ঘরের এক কোনে লুকিয়ে থাকেন সামছু।

পরে দেখেন, বাজার থেকে কুড়িয়ে আনা মাছসহ অন্যান্য তরিতরকারি রান্না করা হয়। গভীর রাতে সাদা পোশাক ও পাগড়ি পরা ২১ জন দরবেশ ওই ঘরে প্রবেশ করেন। এরপর সবার সামনে স্বর্ণের তৈরি প্লেট দেওয়া হয়। কিন্তু একটি প্লেট অতিরিক্ত হয়। অবাক কান্ড। এ দৃশ্য দেখে দরবেশরা একে অপরকে বলাবলি করছেন একটি প্লেট বেশি কেন? ভাবনায় পড়েন দরবেশরা। তখন দরবেশরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন।

এ সময় হঠাৎ দরবেশ দলপতি সবার উদ্দেশ্যে বলেন, আজ আমাদের মাঝে একজন মেহমান আছেন। সামছু মিয়া তখনও লুকিয়ে সব কিছু দেখছিল এবং শুনছিল। দরবেশ দলপতির কথায় দরবেশরা অবাক হন এবং এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করেন। পরে দরবেশ দলপতির কথায় সামছু আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। তাৎক্ষণিকভাবে আদর- অভ্যর্থনা দিয়ে মেহমান সামছু মিয়াকে খাবার আসনে বসানো হয়। দুর্দান্ত সাহসী সামছু মিয়া উৎফুল্য মনে তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন।

এরপর রাতব্যাপী মিলাদ মাহফিল ও জিকির করে ফজরের নামাজ আদায় করে তারা সামছুকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে দেন। দরবেশরা সামছুকে সতর্ক করে দিয়ে বলে দেন, যদি এ খবর কাউকে বলো তাহলে তোমার মারাত্মক ক্ষতি হবে। সব কথা শুনে সামছু মিয়া দরবেশদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে সামছু গভীর চিন্তায় পড়েন। তার ভেতর নমনীয়ভাব চলে আসে। দুর্দান্ত সাহসী ও চঞ্চল সামছুর হঠাৎ এ পরিবর্তনের কারণ জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন পরিবারের লোকজন।

সবাই সামছুকে আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ খুলে বলার জন্য চাপ দেয়। সামছুর বৃদ্ধ মাতার অনুরোধে মুখ খোলে সামছু। দরবেশের সেই সতর্কবাণী অবশেষে কার্যকর হলো। ঘটনাটি তার আত্মীয়-স্বজনদের বলার ৩ দিনের মাথায় মারা যায় সামছু মিয়া। সামছু অবশ্য ঘটনা খুলে বলার আগে এ রকম ইঙ্গিত করেছিল তার স্বজনদের।
শেষে পাথরের কাছেই দাফন করা হয়েছিল সামছুকে।

কালের পরিক্রমায় পাহাড়ের জঙ্গল বিলীন হলেও কালো রহস্যময় পাথর ও বটগাছটি সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
অনেকে বলেন, ওই বটগাছের নিচে বসে দরবেশরা দিনের কাজ পরিচালনা করতেন। প্রতিদিন এ পাথর দেখার জন্য শত শত লোক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসছেন। পাহাড়ের চূড়ায় বটগাছের নিচে ভক্ত-অনুরাগীরা বসে দোয়া-দরুদ পড়েন এবং শিরনি বিতরণ করেন।

সামছু মিয়ার স্মৃতিতে অম্লান এ রহস্যময় পাহাড় ও পাথর যেন আজও এ দেশের পথভ্রষ্ট মানুষদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এলাকাবাসী ওই পাথরের কাছে যাওয়ার জন্য পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত একটি রাস্তা করেছেন।

তবে কালো পাথরটি নিয়ে যে গল্প রয়েছে, তা অনেকে বিশ্বাস করেন না। এটিকে কুসংস্কার বলেও মনে করেন অনেকেই।

(এম/এসপি/জুন ৩০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test