E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধামরাই রথের ইতিহাস প্রায় চার শত বছরের

২০২২ জুন ২৯ ১৪:২২:৩১
ধামরাই রথের ইতিহাস প্রায় চার শত বছরের

দীপক চন্দ্র পাল, ধামরাই : করোনা মহামারীর কারনে বিগত দুই বছর উপহাদেশ খ্যাত ধামরাইয়ের রথ মেলা উৎসব অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। পরিস্থতি স্বাভাবিক হওয়ায় এবার বর্ণাঢ্য আযোজনে বাংলাদেশের গর্ব ও উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধামরাইয়ের ঐতিহাসিক চার শত বছরের পুরোনো শ্রী শ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রা উৎসব ও মাস ব্যাপী মেলা শুরু হবে আগামী পহেলা জুলাই ২০২২ ইং তারিখে। আর ৯ ই জুলাই উল্টো রথ টানের মধ্য দিয়ে রথযাত্রা উৎসবের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান শেষ হলেও মেলা চলবে মাসব্যাপী ।

দুই বছর পড়ে থাকা রথের সংস্কার ও যাবতীয় সাজ স্বজা ও রংতুলির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। তাই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন রং তুলির শিল্পী কারীগররা। এবার রথযাত্রা বা রথমেলায় যে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি থাকবে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারী। এ উৎসবকে কেন্দ্র দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে আইন, শৃংখলা নিয়ন্ত্রন কারী সংস্থার সাথে।মেলাঙ্গনে ইতি মধ্যো বসেছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলায় পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা, নাচ, গান, যাত্রাপালা এবং হরেক রকম সৌখিন জিনিসপত্রের ষ্টল বসেছে।

ধামরাইয়ের এ রথ, এশিয়া উপ মহাদেশের সর্ববৃহত। ৪০ ফিট উচু কাঠের তৈরী এই রথ।শুধু বাংলাদেশেই নয় ধামরাই রথের ইতিহাস ভারতের মাহেষের রথ ও উরিষ্যার পুরিতে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মত ঐতিহাসিক ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশো মাধব দেবের রথ যাত্রা উৎসব ও তার মাসব্যাপী মেলা উপ-মহাদেশের মধ্যে বিশেষ একটি স্থান জুড়ে রয়েছে।

মেলার সার্বিক আয়োজনের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ঐতিহ্য বাহী রথযাত্রা উৎসব কে কেন্দ্র করে ধামরাইয়ে এখন সাজ সাজ রব পড়েছে। ধীরে ধীরে মেলাঙ্গন ভরছে দোকানী ও আগতদের ভীড়ে।

পহেলা জুলাই রথযাত্রা উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসিবে উপস্থিত থাকবেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শাসসুল আলম। শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির পরিচালানা ও রথ কমিটি সভাপতি মেজর জেনারেল জীবন কানাই দাস রথ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিতব্য আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন। স্বাগত ভাষন দেবেন শ্রীশ্রী যশোমাধাব মন্দির পরিচালানা ও রথ কমিটির সাধারন সম্পাদক কুমুদিনি ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান ও আর পি সাহার নাতি রাজিব প্রসাদ সাহা।অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন রথ কমিটির যুগ্ম সাধারন সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন।

বিশেষ অতিথি হিসিবে উপস্থিত থাকবেন ঢাকা- ২০ আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা বেনজীর আহমদ, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার শ্রী বিক্রম কে দোরাইস্বামী, সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ঢাকা জেলা প্রশাসক মো: শহিদুল ইসলাম,ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মো: মারুফ হোসেন সরদার, ধামরাই পৌর সভার মেয়র আলহাজ্ব গোলাম কবির মোল্লা, ধামরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাদ্দেস হোসেন, ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকি, সহকারী কমিশনার ( ভূমি ) ফারজানা আক্তার ও ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: আতিকুর রহমান সহ আরো অনেকে।

রথ উৎসব উপলক্ষে ১জুলাই সকাল ১০ টায় কায়েতপাড়াস্থ রথ খোলায় ও রথের সামনে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হবে। এ সময় ডাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা ও মহিলাদের উলু ধ্বনিতে মাধব মন্দিরের বর্তমান প্রধান পুরোহিত উত্তম গাঙ্গুলী ধর্মীয় অনুষ্টান সম্পন্ন করবেন।দুপুরে মাধব মন্দিরে ভোগ রাগের পর প্রসাদ বিতরণ করা হবে আগত হাজারো ভক্ত বৃন্দের মাঝে।

বাংলাদেশের ঐতিহ্য বাহী লোক উৎসবের অন্যতম প্রধান রথ উৎসব। গ্রাম বাংলার মানুষের হৃদয় ছুড়ে যাওয়া এই লোক উৎসব মুলতঃ হিন্দু ধর্মীয় চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এর স্রোতধারা এখন নির্দিষ্ঠ কোন গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতি বছর বাংলা আষাঢ় মাসের শুল্কা দ্বিতীয়ায় এই রথ উৎসব শুরু হয়ে থাকে। ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশো মধাব দেবের বিগ্রহকে রথের উপর উঠিয়ে টানা হয় এবং পুনরায় দশমিতে ঐ রথ টেনে পূর্ব স্থান ধামরাই রথ খোলায় আনা হয়। যার নাম উল্টো রথ। এই রথ সারা বছর এই খানে রাখা হয় বলে এই স্থানটির নাম করন হয়েছে ধামরাই রথ খোলা। ধামরাই রথ খোলা রথ মেলা ও ধামরাইয়ের প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। ধামরাইতে প্রায় মাস ব্যাপী চলে এই রথ মেলা উৎসব। তবে এর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হয়ে থাকে মাত্র ৯ দিন।

শুধু বাংলাদেশেই নয় ধামরাই রথের ইতিহাস ভারতের মাহেষের রথ ও উরিষ্যার পুরিতে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মত ঐতিহাসিক ধামরাইয়ের শ্রীশ্রী যশো মাধব দেবের রথ যাত্রা উৎসব ও তার মাস ব্যাপী মেলা উপ-মহাদেশের মধ্যে বিশেষ একটি স্থান জুড়ে রয়েছে।

ধামরাই একটি প্রধান ও প্রাচীন তীর্থ কেন্দ্র হচ্ছে এই মাধব মন্দির। এখানে শ্রীশ্রীযশো মধাব নামে একটি বিষ্ণু মুর্তি রয়েছে। বার মাস এই মাধব মন্দিরে পুজারী দ্বারা পুজিত হয়ে আসছে।হাজারো ভক্তবৃন্দের উপস্থিতি ঘটে সারা বছর ধরে। যশো মধব ঠাকুরের কূর্ষীনামা অনুসারে বাংলা ১০৭৯ সালে মুর্তিটি বর্তমান স্থানে (মাধব মন্দির) স্থাপিত হযেছে বলে জানা যায়।এসময় থেকেই শুরুতে একটি বাশের রথ নির্মান করে জনৈক রাম জীবন রায় মৌলিক এই রখথ উৎনবের প্রচলন করেন ধামরাইয়ে।

কথিত রয়েছে ইতিহাস খ্যাত পাল বংশের রাজত্ব কালে শেষ রাজা যশো পাল ঘটনাক্রমে একদিন তিনি ঢাকা জেলার ধামরাই থানার শিমুলিয়া এলাকায় রণস্থানে হাতিতে চড়ে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। এসময় যাবার পথে রণস্থান নামক স্থানে পৌছালে সমুক্ষে একটি লাল মাটির ঢিবি (উচু স্থান) দেখে রাজাকে বহনকৃত হাতিটি থেমে যায়।

এসময় রাজা যশো পাল তার সন্দেহ হলে হাতি থামার ব্যাপারে রাজার সঙ্গীয় লোকজনদের নির্দেশ করেন এবং সেই ঢিবি টি খনন করার জন্য নির্দেশ দেন।

রাজার লোকজন খনন কাজ শুরু করার কিছু ক্ষন পরে,গভীরে একটি সুরক্ষিত মন্দির রয়েছে বলে ধারনা করেন। পরবর্তীতে পুনরায় খনন কার্য চালাতে নির্দেশ করেন “রাজা যশো পাল”। সেখানে তার তত্বাবধান করেন রাজা নিজেই। সেখানে মন্দির আবিষ্কার হওযার পরে সেই সুরক্ষিত মন্দিরটিতে এই মাধব বিগ্রহ সহ অনেক বিগ্রহ পাওয়া যায়।

কথিত রয়েছে মাধবের বউ ছিল। খনন কার্য চলাকালে মাধবের বউয়ের দেহে আঘাত প্রাপ্ত হলে ,কেটে গেলে দ্রুত বউ আরো গভীরে চলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার প্রবাদ শুনা যায় ইতিহাসের পাতা থেকে। এই মাধব ও অন্যান্য বিগ্রহগুলি রাজা যশো পাল পূজা অর্চনার উদ্যোগ গ্রহন করেন। কালের বিবর্তনে বিভিন্ন সময়ে শিমুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয় এই মূর্তি গুলি।

অতপর পরবর্তীতে ইহা ধামরাইয়ের ঠাকুর বাড়ী পঞ্চাশে এসে উপনিত হয়। এবং সেখানে দীর্ঘসময় (অজ্ঞাত) ধরে পুজিত হতে থাকে। সেখান থেকে এক পর্যায়ে বর্তমান ধামরাই মাধব বাড়ীতে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজার নাম অনুসারে উক্ত বিগ্রহের নামের পূর্বে রাজা যশো পালের নাম যোগ হয়ে যায়। সেই নাম অনুসারে বর্তমানে মাধব বিগ্রহের নাম হয়েছে “শ্রী শ্রী যশোমাধব”,এই নামের ব্যাপক পরিচিতি ঘটেছে।

বর্তমানে একটি নির্বাচিত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এই মাধব মন্দির ও রথমেলা ও মেলাঙ্গন। বর্তমানে যার সভাপতির পদে রয়েছেন মেজর জেনারেল(অবঃ)জীবন কানাই দাস। কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের প্রতিষ্ঠাতা উপমহাদেশের খ্যাতনামা দানবীর রনদা প্রসাদ সাহার(আর.পি.সাহা)নাতি বর্তমানে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের চেয়ারম্যান শ্রী রাজিব প্রসাদ সাহা এই কমিটির সাধারন সম্পাদক হিসেবে এই মাধব মন্দিরও রথের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করে চলেছেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের অর্থায়নে।এছাড়াও মন্দিরের ভক্তদের কাছ থেকে আয়ও রয়েছে।

দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সাল থেকে প্রয়াত শ্রী ঠাকুর গোপাল বনিক দীর্ঘদিন ধরে এই মাধব মন্দিরকে চমৎকার ভাবে পরিচালনা করেছেন । তিনি গত ২০০৫ সালে মৃত্যুবরন করেন। এই মাধব মন্দির কে কেন্দ্র করেই ধামরাইয়ে শত শত বছর ধরে বাংলা ১২ মাসে ১৩ পার্বন-মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । দেশের দূর-দুরান্ত থেকে ভক্ত দর্শনার্থীরা এসে ভীর জমিয়ে থাকে মেলা-পার্বনে ।

বাংলার গৌরবময় এই সুপ্্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধামরাই এর রথ ও রথ মেলা উৎসবের গোড়া পত্তন হয়েছিল বাংলা ১০৭৯ সালে। সুবিখ্যাত শ্রী শ্রী যশো মাধবদেব বিগ্রহ তৎকালীন সেবায়েত শ্রী রামজীবন রায় মৌলিকের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও প্রেরণায় এই রথমেলা উৎসবটি চালু হয়েছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায় এবং বর্তমানেও তার ধারা বাহিকতা বজায় রেখে চলছে উঃসবের যাবতীয় কর্মকান্ড।

বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায় প্রথম থেকে আজ অব্দি ধামরাই এর যে পথে রথ চালনা করা হয়ে থাকে সেই পথটি প্রায় চারশত বছর পূর্বে বিশাল নদীর পাড়ছিল। এবং সমগ্র এলাকার দুপাড়ে ঘন সাদা কাশফুেল আবৃত ছিল। তখন রথ উৎসব চলাকালে কাশফুল পরিস্কার করে নিতে হযেছে রথ পৌর এলাকার যাত্রাবাড়ি মাধবের কথিত শশুরালয়ে।

প্রায় চারশত বছর পূর্বের সেই সময় প্রথম রথ দিবসে মাধব বিগ্রহ সহ অন্যান্য বিগ্রহ গুলিকে রথে উঠিয়ে স্থাপন করে বর্তমান ধামরাই কায়েতপাড়াস্থ মাধব বাড়ী থেকে ধামরাই এর যাত্রাবাড়ী নামক স্থানে মাধবের কথিত শুশরালয় নিয়ে যাওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। এখানেই উক্ত বিগ্রহ গুলি রথ উপলক্ষে ৯ দিন এই মন্দিরে পুজিত হয়। যা এখনো চলে আসছে।

তৎকালীন সময়ে উভয় মন্দির ছিল কুড়ের ঘর। দুই শতাধিক বছর পূর্বে উভয় স্থানেই বড় বড় দালান বা বিল্ডিং স্থাপিত হয়েছে। এই যাত্রাবাড়ী ও কায়েতপাড়া জুড়ে তখনও মেলা বসত মাসাধিকাল ধরে। মেলায় পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা, নাচ, গান, যাত্রাপালা এবং হরেক রকম সৌখিন জিনিসপত্র, ফল বিক্রিত হত যার বিশেষ আকর্ষন এখনো বিদ্যমান। এছাড়া মেলায় বাশের বাশী, ছোট বড় কাঠের ঘোড়া, পুতুল যা বিক্রমপুর থেকে আসত।এই সব হস্ত শিল্প এখন আর দেখা যায় না।

সময় ও যুগের বিবর্তনে প্লাস্টিকের খেলনা সে সব স্থান দখল করে নিয়েছে। বিলুপ্তির পথে যেতে বসেছে উক্ত শিল্পগুলি।

এই ধামরাইয়ে যে পথ দিয়ে রথ টানা হয় সেই পথে পশ্চিম পার্শ্বে রয়েছে চমৎকার একটি বড় মসজিদ। আর এই মসজিদের পার্শ্বে রথের মেলায় নানা প্রকার পাখি বিক্রি করা হত। যেমন- টিয়া, ময়না, ঘুঘু, কাকাতুয়া, জোট শালিক, জোট ময়ুর ইত্যাদি। এই রথের মেলায় বিশেষ আকর্ষন ছিল আগত সার্কাস দলের বৃহৎ আকার হাতি। হাতির গলায় ঘন্টা বাজিয়ে ছুটত ধামরাইয়ের পাড়ায় পাড়ায় ও বাজারের রাস্ত দিয়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাতির পেছনে পেছনে ছুটত আর চলত সারাদিন কোলাহল। রথের মেলায় ধামরাইতে আগত হাতির পিছনে ঘুরেনি এমন লোক কমই আছে যা আজো বিদ্যমান।

১০৭৯ সাল থেকে ধামরাই এর রথ মেলা সমন্ধে প্রাচীন নথিপত্রে রথমেলা চলছে তার ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে প্রথম নির্মিত বাশের রথ কবে কখন কিভাবে কাঠের রথে রূপান্তরিত হয়েছে তা সঠিক করে কেউ বলতে পারেনি। বাংলা ১২০৪ সাল থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত এই ১৪০ বছর সময় কালের মধ্যে ঢাকা জেলার অর্ন্তগত সাটুরিয়া থানার (বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার) বালিয়াটি জমিদারগণ পুরুষানুক্রমে পরপর চারখানা সুউচ্চ কাঠের রথ তৈরি করেছেন। এবং এই রথের যাবতীয় খরচ বহন করেছেন নির্মাতা বালিয়াটির জমিদারগণ।

এরপর ১৩৪৪ সালের নির্মিত রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ন গঞ্জের বাবু সূর্য নারায়ন সাহা। এই রথের গঠনকাল ছিল ১৩৪৩ বাংলা সালের শ্রাবন মাস থেকে ১৩৪৪ সালের আষাঢ় মাস পর্যন্ত এতে প্রায় ২৫০গুনি কাষ্টশিল্পী (কাঠ) কালিয়াকৈর, সাভার, সাটুরিয়ার, সিঙ্গাইর সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ধামরাইয়ের কাষ্ট শিল্পীদের সাথে মিলে ঐতিহ্যবাহী উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাইয়ের এই সুউচ্চ রথের নির্মান কাজে অংশ নেন।

১৩৪৪ সালের রথে ও পূর্বের রথে যে চাল চিত্র খোদিত ছিল তা হিন্দু ধর্মের মহাভারতের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে চিত্রিত ছিল। তাছাড়া পৌরাণিক চিত্রের সাথে সামঞ্জস্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর চিত্রিত ঘটনার দৃশ্যও স্থান পেয়েছিল সেই রথের গায়ে। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ ছিল বলে জানা যায়। তাই সে সময়কার আন্দোলনের ব্যক্তিত্বদের কয়েক জনের ছবিও বৃহৎদাকারের রথের গায়ে খোদিত ছিল। যা ঢাকা আর্ট কলেজে পাঠ্য সূচিতে ধামরাইয়ের এই বিখ্যাত রথের গায়ে শিল্প কর্মের ইতিহাস অন্তর্ভূক্তি ছিল। যা এই রথের উপর চিত্রিত উন্নত শিল্পকর্মের পরিচয় বহন করে।

এই রথের চুড়া ও পতাকা সমেত প্রায় ৭৫-৮০ ফুট উচ্চতা ছিল। দৈর্ঘ্য ছিল ৪০ ও প্রস্থে ছিল ৪৫ ফুট বলে জানা যায়। এই রথ ৩২টি চাকার উপর ও চারটি বড় মোটা খাম্বার উপর প্রয়োজনীয় টানা-পাইর ও আঠানের মধ্যে সাজানো ও আটা ছিল। তার উপর দ্বিতল ও তার উপর ত্রিতল, প্রথম ও দ্বিতীয় তলার চারটি করে মোট প্রথম ও দ্বিতীয় তলার চার কোনে ৪টি করে মোট ৮টি প্রকৌষ্ঠ ছিল। এবং তিন তলার উপরে একটি বড় ধরনের প্রকৌষ্ঠ ছিল। এই মোট ৯টি প্রকৌষ্ঠের নাম ছিল “নবরত্ন”। রথ টানার সময় আগলা ভাবে লাগানো হত দুটি বড় ধরনের কাঠের তৈরি ঘোড়া, ঠিক সামনের মধ্যভাগে। এই বৈশিষ্ট এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এই ঘোড়া দুটির গায়ে পিতলের পাত দিয়ে বাধানো ছিল বলে ধামরাই এর শ্রী শ্রী যশো মাধব মন্দিরে প্রধান পুরোহিত শতবর্ষ বয়সী (জীবিত থাকা অবস্থায়) শ্রীমাধব গাংগুলি এ কথা জানান।তিনি আরো বলেছিলেন, তৎকালিন সময় থেকে সুযোগ্য একজন সারথীকে ঐ ঘোড়ার উপর চড়িয়ে তার নির্দেশ ও বাজনার তালে তালে উপস্থিত হাজার হাজার ভক্ত দর্শকের উপস্থিতিতে ৩২ মন পাঠ দিয়ে তৈরী চারটি পাঠের কাছি (দড়ি) ধরে টেনে নিত ভক্তরা কথিত মাধবের শুরালয় মন্দির যাত্রা বাড়িতে।

এ সময় মেলাঙ্গন জুড়ে অসংখ্য উপস্থিত মহিলারা ধর্মীয় চেতনায় উলু ধ্বনি দিয়ে রথ যাত্রা ঊৎসবকে মুখরিত করে তুলত। আর ভক্তরা কলা ও কলার পাতায় মোড়ানো চিনি ছুড়ে দিত মাধবের উদ্দেশ্যে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি ভারত,নেপাল,বার্মা থেকেও এই রথমেলা ঊপলক্ষে লোকজন এসে ভীড় জমাতো ধামরাইয়ে।এখনও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্ত দর্শকেরা এসে ভীড় জমায় প্রতি রথের মেলায়। ধামরাই সদরের মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশী ও কাকিলাজানি নদীর দুপারে অসংখ্য যাত্রীদের নিয়ে নৌকা এসে ভীড়ত। এর মধ্যে দ্বিতল নৌকার দৃশ্য খুবই মনোহর ছিল বলে স্থানীয় বয়স্ক লোকদের কাছ থেকে জানা যায়। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, ফরিদপুর,চাদপুর, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল থেকেই এই দ্বিতল নৌকাগুলি এসে ধামরাইতে ভীড় জমাতো।সে সময়ে নৌ-পথে নৌকাই ছিল একমাত্র যাতায়াতের অবলম্বন।

সড়ক পথে তৎকালীন সময়ে যানবাহনের উপস্থিতি ছিল একেবারে নগন্য। এই রথ উৎসব রথ টান হিন্দু ধর্মীয় ভাবধারা থেকে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানের ধর্মীয় ভাবধারার বিলুপ্তি ঘটেছে। রথ উৎসবের ধর্মীয় আনুষ্ঠিকতা রয়েছে মাত্র,তবে তার গন্ডি এখন আর ধর্মীয় ভাবধারায় সীমাবদ্ধ নয়,সার্বজনীন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই মেলা সকলেই উপভোগ করে থাকেন। এই রথের মেলা থেকেই সকলেই প্রচুর আনন্দ ও আর্থিক মুনাফা অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকে। দেশ ভাগ হবার পর ঐতিহ্যবাহী উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাই এই রথ মেলার সবদিক থেকেই ভাটা পড়তে থাকে নানাবিধ কারনে। ১৩৬২ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তি হবার আগে থেকেই বালিয়াটির জমিদারগন মেলার খরচ বহন ও নির্মিত জীর্ণ রথের মেরামতের ব্যাপারে অনীহা দেখান শুরু করেন। তখন মির্জাপুরের রায়বাহাদুর রণদা প্রসাদ সাহা (আর. পি. সাহা) জীর্ণ রথখানা রথ উৎসবের পূর্বে মেরামত করে উৎসব পালনের (টানার ) উপযোগী করে দেন।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি তার কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট থেকে এই রথ উৎসবের যাবতীয় খরচ বহন করতেন বলে সংশ্লিষ্ট মাধব মন্দির পরিচালনা কমিটির কাছ থেকে জানা যায়। আজো তার ধারা বাহিকতা বজায় আছে বলে জানাগেছে।

উপমহাদেশ খ্যাত এই দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (আর.পি.সাহা)ও তার পুত্র ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালে রাজাকার ও পাকিস্থানী হানাদার বর্বর বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। এদিকে সারা দেশে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও যুদ্ধ চলাকালে বাংলা ১৩৭৭ সালের ২৭শে ও ২৮শে চৈত্র এদেশের লোক উৎসবের গর্ব ও ঐতিহ্যবাহী উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাই এর এই রথটিকে পাকিস্থানী বর্বর হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকার দালালদের সহযোগিতায় অগ্নি সংযোগ করে ভস্মীভূত করা হয়। এবং এর ৮/১০ দিন পরে কাঠের তৈরি বড় ঘোড়া দুটিও পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয় ।

তখন সারাদেশে চলছিল স্বাধীনতা লাভের জন্য মরণ পণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারনে বাংলা ১৩৭৮ সালের রথটানা বন্ধ থাকে রথ না থাকার কারনে। ১৩৭৯ সালে আষাঢ় মাসে সেই ইতিহাসের প্রথম অংশের মত ছোট করে বাশের রথ বানিয়ে রথ উৎসব পালন করা হয়েছে।

এর পর থেকে তারই সুত্র ধরে ছোট আকারের ২৫-৩০ ফুট উচু একটি কাঠের রথ তৈরি করা হয়ে যা পূর্বের রথের আকৃতি স্বরূপ মাত্র। তাতেই রথ উৎসবের সময়ে শ্রী শ্রী যশোমাধব বিগ্রহসহ অন্যান্র বিগ্রহ গুলিকে যথারিতী রথে স্থাপন করে টানা হয়ে আসছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে প্রত্যেক সরকারের কাছ থেকে ধামরাইয়ের এই বিখ্যাত রথটি পূর্বের রথের মতো বানানোর আশ্বাস পাওয়া গেলেও তা কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে অতিথিদের কাছ থেকে কখনও নগন্য আর্থিক সাহায্য প্রাপ্তির কথা জানা গেছে। প্রতি বছরই রথ উৎসবের শুরুতে উদ্বোধনী ও উল্টোরথ অনুষ্ঠানে সরকারের কোন না কোন মন্ত্রী বা উচ্চ পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এসে এর উদ্বোধন করে যান। প্রতিনিয়তই এই উদ্বোধরনী অনুষ্ঠান থেকেই রথটি পুনঃ নির্মানের আশ্বাস পেয়ে আসছিল মাধব মন্দির ও রথ পরিচালনা কমিটি। তাতে সফলতা আসেনি।

বিগত ২০০৬ সালে ধামরাইয়ের রথ উৎসবে তৎকালীন মাধব মন্দির কমিটির সাধরন সম্পাদক ধামরাইয়ের বিশিষ্ঠ সমাজ সেবক প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বনিকের আমন্ত্রনে রথ উৎসবে বিশেষ অতিথি হয়ে আসেন ঐ সময়ের বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাসের দূত শ্রীমতি বিনা সিক্রী।

ধামরাই বাসীর আন্তরিক দাবীর প্রেক্ষিতে শ্রীমতি বিনা সিক্রী তার ভাষনে পূর্বের আদলে ধামরাইয়ের রথটি নির্মান করে দেবার আশ্বাস দেন।

এর পর রথ ও মাধব মন্দির কমিটির দুই জন কর্মকর্তা বর্তমান মাধব মন্দির ও রথ কমিটির সাবেক সাধারন সম্পাদক প্রয়াত ঠাকুর গোপাল বণিক ও সদস্য শিল্পী সুকান্ত বণিক নিজে ধামরাই থেকে ভারতের পুরিতে যান। সেখানেই রথ নির্মান খরচ বিষয়ক ও তত্বাবধায়ক বিষয়ে আলোচনা হয়।

ভারত সরকার বাংলাদেশের সেতু বন্ধন অটুট রাখতে ধামরাইয়ে রথটির নির্মানে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করে নির্মানের প্রদক্ষেপ গ্রহন করেন।

এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশস্থ ভারতীয় দূতাবাসের তত্বাবধানে ২০০৯ সালে ধামরাই রথের টেন্ডার হয়। টেন্ডার পেয়ে উই.ডি.সি.কেল.বিন টেকনো.টাচ -ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ২০১০ সালের জানুয়ারী থেকে রথ নিমার্নের কাজ শুরু করে। এরপর নতুন রথেই ২০১০ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ধামরাইয়ের এই রথয়াত্রা উৎসবও তার মাস ব্যাপী মেলা। এবারো ১ জুলাই অনুস্থিত হবে বাংলার সুপ্রাচীন ইতিহাসখ্যাত ধামরাই এর ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা উৎসব ও তার মাসব্যাপী মেলা।

(ডিসিপি/এএস/জুন ২৯, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test