E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ঢাক-ঢোল তৈরি করেই চলে জীবন জীবিকা  

২০২২ সেপ্টেম্বর ০৮ ১৮:৫০:১০
ঢাক-ঢোল তৈরি করেই চলে জীবন জীবিকা  

মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : দরজায় কড়া নাড়ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপুজা। মন্ডপে মন্ডপে বাদ্যযন্ত্র তথা ঢাক-ঢোল আর কাসরের শব্দের সঙ্গে ধূপের সুবাসিত ধোয়ার মনমাতানো মৌ মৌ গন্ধে মেতে উঠবেন ধর্মানুরাগীরা।

দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে টাঙ্গাইলের ঢাক-ঢোলের কারিগররা স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখছে। ঢাক-ঢোলের কারিগররা সাধারণত বাদ্যকর হিসেবে পরিচিত। সাধারণত বাদ্যকরদের বসবাসের এলাকা অন্যদের কাছে ঋষিপাড়া হিসেবে সমধিক পরিচিত।

এমনিতে সারা বছর কাজের চাপ না থাকায় বাদ্যকর সম্প্রদায়ের লোকরা কষ্টে-সৃষ্টে দিনাতিপাত করে থাকে। বছরে তিন মাস অর্থাৎ আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রাহয়ণ মাসে কাজের চাপ বেশি থাকে। বিশেষ করে পুজা-পার্বণে বাদ্যকরদের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে যায়। নিয়মিত আয়-রোজগার না থাকায় অনেকে পৈত্রিক এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। যাঁরা পৈত্রিক আদি এ পেশাকে ধরে রেখেছেন- তাঁদের আয়-রোজগারের মৌসুমও পুজা-পার্বণ।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, এক সময় টাঙ্গাইলের প্রায় সব উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঢাক-ঢোলের কারিগররা বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। ঋষিপাড়ার বাদ্যকরদের পরিবারের ছোট-বড় সবাই এ পেশায় কম-বেশি কাজ করে থাকেন। এখন বাদ্যকর পল্লী বা ঋষিপাড়ায় আগের সেই ব্যস্ততা এখন আর চোখে পড়েনা।

তাদের উত্তরসূরীরা সময়ের প্রয়োজনে পূর্ব পুরুষের পেশা পাল্টে ভিন্ন পেশায় চলে গেছে। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে উৎসব-অনুষ্ঠানে এখন ঢাক-ঢোলের তেমন কদর না থাকলেও পুজা-পার্বণে এখনও ঢাক-ঢোলের কদর রয়েছে। পুজার আরতিতে ঢাক-ঢোল ও কাসরের বাঁজনার এখনও কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য বছরের আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রাহয়ণ মাসের সময়টা তাদের কাছে অনেকটা ব্যস্ত সময়।

এ সময় ঢুলি থেকে শুরু করে ঢোল-খোলের কারিগররা ভীষন ব্যস্ততায় সময় পাড় করেন। পুজা ছাড়াও বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের আসরে ঢাক-ঢোল বাদ্যযন্ত্রের কদর অনস্বীকার্য।

সরেজমিনে দেখা যায়, টাঙ্গাইল জেলা শহরের কলেজপাড়া, কালিহাতীর পালপাড়া, নাগরপুর সদর ও সহবতপুর ইউনিয়নের ঋষি পাড়ায় ঢাক-ঢোল তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা। কারও দম ফেলার ফুরসত নেই। কাঠের খুট-খাট শব্দে মুখর বাড়ির উঠান। ঢাক-ঢোলের জন্য খোল তৈরি, রং করা, চামড়া লাগানো এবং মেরামতে ব্যস্ত বেশিরভাগ কারিগর।

টাঙ্গাইলের একাধিক বাদ্যকর জানান, বছরে তিন অর্থাৎ আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রাহয়ণ মাসে কাজের চাপ বেশি থাকে। বর্তমানে তারা দুর্গাপুজার জন্য কাজ করছেন। এ ব্যবসায় এখন যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ কষ্টসাধ্য। বড় আকারের প্রতিটি ঢাক ১০-১৫ হাজার টাকা, ছোট ও মাঝারি ৭-৮ হাজার টাকা, ঢোল বড়টি ৬ হাজার টাকা, ছোট ও মাঝারি ৫-৬ হাজার টাকা, খোল প্রতিটি ৪-৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

এই কাজ করে এখন সংসার চালানো যায় না। গান-বাজনা, যাত্রানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান কম হওয়ায় ঢাক-ঢোলের চাহিদাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কারণে কাজ কমে যাওয়ায় সংসারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যে কারণে এ কাজের প্রতি কারিহররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

নাগরপুর সদর ইউনিয়নের ঋষি পাড়ার কারিগর নিত্য বাদ্যকর জানান, পুজায় ঢাক-ঢোলের বাজনা অপরিহার্য। হিন্দুশাস্ত্রেও এর ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তাই ঢাক-ঢোল-কাসর ছাড়া পুজা-অর্চনার কথা ভাবাই যায় না। তিনি জানান, বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির আধিক্যে ঢাক-ঢোলের বাজনা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।

কাঠ, চামড়াসহ ঢাক-ঢোল তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন খুব একটা লাভ হয় না। আগের দিনের মতো ঢাক-ঢোলের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢাক-ঢোল, খোল, তবলা। তবে পুজা-পার্বণ ও বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ঢাক-ঢোলের চাহিদা রয়েছে। তার তিন পুরুষ ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। অনেক কষ্টে বাপ-দাদার পেশার হাল ধরে রেখেছেন।

নাগরপুর সরকারি কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক লক্ষ্মীকান্ত সাহা জানান, আমাদের প্রায় সবারই পুজা-অর্চনার সানাইয়ে ‘মন কেমন’ যেন করে ওঠে। শুধু সানাই নয়, জোড়া কাঠিতে ঢাক-ঢোল কিংবা কাসরের উপর একটানা একটি কাঠির তিনটি শব্দ-সুরের যে মুর্ছনা সৃষ্টি করে এসেছে তা বাঙালির একান্ত নিজের সুর।

এ সুরের ইন্দ্রজাল ছিঁড়ে আমাদের বাঙালির গানে গিটার, প্যাডড্রাম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র প্রবেশ করেছে। এর প্রভাবে আমাদের ঢাক-ঢোল লালিত সঙ্গীতে নেতিবাচক ছায়া পড়েছে। একথা অবশ্য সত্য সংস্কৃৃতি পরিবর্তনশীল এবং প্রবাহমান। ফলে নতুন বাদ্যযন্ত্র আমাদের সঙ্গীতে স্থান করে নেবে- এটাই স্বাভাবিক।

তবে একথাও সত্য যে, আমাদের দেশজ যন্ত্রের সুর ক্রমশ স্থিমিত হয়ে আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে- এগুলো সঠিকভাবে বাঁজানো এবং সঠিক সঙ্গীতের উপযোগী করে তৈরি করা লোকের অভাব। তাই ঢাক-ঢোল মিশ্রিত সঙ্গীতের জন্য হৃদয় ব্যাকুল হলেও একদিন সত্যিই স্থিমিত হয়ে যাবে আমাদের দেশজ বাদ্যযন্ত্রের সুর।

তিনি আরও জানান, বিচিত্র পেশার ভিড়ে দেশজ বাদ্যযন্ত্র তৈরির পেশায় অর্থের প্রাচুর্য না থাকায় মানুষ বংশানুক্রমে এসব পেশা পরিবর্তন করে নতুন উপার্জনের পথ ধরেছে। ফলে বাদ্যযন্ত্র তৈরির ঘরগুলো কমে গেলেও যাঁরা আদি এ পেশাকে ধরে রেখেছেন তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

(এসএম/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test