E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলে বিলুপ্ত প্রায় মাটির ঘর

২০২২ অক্টোবর ১১ ১৬:২৯:০৪
টাঙ্গাইলে বিলুপ্ত প্রায় মাটির ঘর

মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : কালের পরিক্রমায় আধুনিক যুগে মাটির ঘর খুবই বেমানান বা চোখ ঝলসানো আলিসান আধুনিক বাড়ি নাকি মাটির ঘর তৈরির কারিগরের অভাব- ঠিক কি কারনে মাটি দিয়ে তৈরি ঘর আজ বিলুপ্ত ? এখন আর টাঙ্গাইলের পাহাড়ি অঞ্চলেও মাটির ঘর খুব একটা চোখে পরে না। অথচ যারা একটু উচ্চ বিত্ত শ্র্রেণির তাদের বাড়িতে দেখা যেত মাটির দোতলা ঘর।  এক সময় টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল ও মধুপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে এই মাটির ঘরই ছিলো নিরাপদ ও আরামদায়ক আবাসস্থল। নাকি পাহাড়ী মানুষের জীবন যাপন উন্নত হওয়াই- গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর বিলুপ্তির জন্য দায়ী ? 

গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর টাঙ্গাইলের পাহাড়ি অঞ্চল বিশেষ করে সখিপুর উপজেলার র্কীত্তন খোলা, কালিয়ান পাড়া, পাথারপুর, ইছাদিঘী,কচুয়া, কালমেঘা এলাকায় বেশ দর্শনীয় ছিল দোতলা বা তিনতলা মাটির ঘর। এখনো কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন কিছু মাটির ঘর। শুধু মাটির বসতবাড়িই নয়, ছিল ধান-চাল রাখার জন্য মাটির তৈরি গোলা ঘর ও কুঠি। এসব আজ অতীত। পাহাড়ি পথে যেতে যেতে দু একটা মাটির ঘর চোখে পরলেও তার বেশির ভাগই এখন পরিত্যক্ত।

গরমের দিনে ঠান্ডা থাকায় এক সময় মাটির ঘরকে গরীবের এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) ঘরও বলা হতো। কারন মাটির ঘর গরম ও শীতের সময় বসবাসের জন্য বেশ আরামদায়ক। তাই অনেক গ্রামেই বিত্তশালীদেরর দোতলা মাটির ঘর ছিল। এখনও এ অঞ্চলের অনেক বাড়িতে মাটির ঘর দেখতে পাওয়া যায়। মাটির সহজলভ্যতা,ঘর তৈরীর প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশী আগ্রহী ছিল। মাটির ঘর যাদের আছে তারা প্রতিবছরই মাটির প্রলেপ দিয়ে চুনকামসহ বিভিন্ন রং মেখে আলপনা আঁকতেন।

বাঁশতৈল এলাকার মাটির ঘর তৈরির কারিগর হাবিবুর,মণা ও আমিনুর জানালেন, সাধারণত এটেল বা আঠালো মাটি দিয়ে পানির সঙ্গে মিশিয়ে কাদায় পরিণত করা হয়। এরপর ২০/৩০ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরী করা হয়। প্রতিটি ঘর তৈরী করতেও মাসখানেক সময় লেগে যায়। কারণ একেবারে দেয়াল তোলা যায় না। কিছু দেয়াল তোলার পর শুকাতে হয়। ১০/১৫ ফুট উচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরী করে তার উপর খড় বা টিনের ছাউনি দেয়া হয়। একটি ঘর তুলতে সময় গুনতে হয় কমপক্ষে তিন চার মাস। খরচও কম নয়। মাটির ঘর নির্মাণে গুনতে হয় প্রায় এক থেকে দুই লাখ টাকা। একটি ঘর নির্মাণ করার যথেষ্ট কষ্টের কাজ।

দ্বিতল মাটির ঘরের মালিক রাসেল মিয়া জানান, এ গ্রামে অনেকের এই মাটির ঘর ছিলো। অনেকে বাঁশ, মাটি, টিন সংগ্রহ করে নিজেরাই মাটির ঘর তৈরী করেন। এক্ষেত্রে সময় বেশী লাগে। তবে খরচ কম পড়ে। শ্রমিক না নিলে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। শ্রমিক সংকটের কারণে যারা নিজেরাই মাটির ঘর তৈরী করতে পারেন এ অঞ্চলের গ্রামগুলোতে এখনও তাদেও কিছু মাটির বাড়ি-ঘর রয়েছে। এই মাটির ঘর ভুমিকম্প বা বন্যা না হলে এর স্থায়িত্ব শতবছরও হতে পারে বলে জানালেন মাটির ঘর ব্যবহারকারীরা।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। এলাকার প্রায় সকল গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। জেলা সদর এবং উপজেলা নিকটে হওয়াতে এবং সদরের সাথে যোগাযোগের সুব্যবস্থা, বিভিন্ন এনজিও কর্তৃক ঘর তৈরির জন্য ঋণ প্রদানের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির গতি সচল হওয়ায় মাটির ঘরের পরিবর্তে তৈরি হচ্ছে পাকা ঘর। তাছাড়াও ইদুঁরের উপদ্রব একটি মূখ্য কারণ। চার থেকে পাঁচ বছর পর পর মাটির ঘর সংস্কারের ঝামেলা ও ব্যয়বহুল দিক পর্যবেক্ষণ করে মাটির ঘরের পরিবর্তে দালান-কোঠা বানাতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন এই অঞ্চলের মানুষ। তাছাড়া বর্তমানে একটি মাটি ঘর ভালোভাবে বানাতে গেলে সমপর্যায়ের পাকা ঘরের দেড়গুণ পয়সা খরচ হয়। জায়গাও লাগে বেশি। তাই এখন মাটির ঘর তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে এখনো গ্রামের অনেকেই বসবাসের জন্য মাটির ঘরই পছন্দ করেন। অনেকে পূর্বপুরুষের রীতির প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভাঙ্গেননি মাটির ঘর। তারা স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে চায়, ভাঙতে চায় না কেউ কেউ। এক সময় মাটির ঘরের কথা ইতিহাস হয়ে থাকবে। স্মৃতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে। হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক বাহক মাটির ঘর টিকিয়ে রাখবে কি আমাদের নতুন প্রজন্ম?

(এসএম/এসপি/অক্টোবর ১১, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test