E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

হারানোর পথে ‘খাড়িয়া ভাষা’ জানেন শুধু দুই নারী

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ২৪ ১৯:০০:৩৫
হারানোর পথে ‘খাড়িয়া ভাষা’ জানেন শুধু দুই নারী

মো: আল-আমিন, শ্রীমঙ্গল : ভেরোনিকা কেরকেটা (বাঁয়ে) ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা (ডানে)। বহু জাত-পাত, বহু সংস্কৃতি, বহু ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। সাংবিধানিকভাবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ দেশের অসংখ্য জাতিসত্তা রয়েছে, যারা বাংলা ছাড়াও নিজেদের জাতিগত ভাষায় কথা বলেন। বিশেষ করে দেশের চা শিল্পাঞ্চলে রয়েছে বহু ভাষাভাষীর লোকজন, রয়েছে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। তাদের মধ্যে চা বাগানগুলোতে অনেক জাত-পাত রয়েছে, যারা নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে, লিখতে বা পড়তে পারেন না। চা বাগান শ্রমিকদের তেমনি এক জাতিসত্তা ‘খাড়িয়া’। তাদের ভাষার নাম ‘খাড়িয়া ভাষা’। 

খাড়িয়া ভাষাটি একসময় বাংলাদেশের চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত অসংখ্য খাড়িয়া শ্রমিকের প্রাণের ভাষা ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে দেশের চা বাগান থেকে ভাষাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন দেশের মাত্র দুই নারী ঐতিহ্যবাহী এই ‘খাড়িয়া’ ভাষায় কথা বলতে পারেন। তারা হলেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার দ্য কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (ফিনলে টি কোম্পানি) রাজঘাট চা বাগানের ফাঁড়ি বর্মাছড়া বাগানের ৮০ বছর বয়সি ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়সি খ্রিস্টিনা কেরকেটা। সম্পর্কে তারা বোন।

এ দুই বোন ছাড়া দেশে আর কেউ এ ভাষায় কথা বলতে, পড়তে বা লিখতে পারে না। এমনকি তাদের পরিবারের কোনো সদস্যেরও ভাষাটি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। দুই বোন একই বাগানে পাশাপাশি সেকশনের কলোনিতে সপরিবারে বসবাস করার কারণে প্রায় প্রতিদিনই তারা একত্রে বসে আড্ডা দিতেন। আড্ডায় তাদের নিজেদের মধ্যে খাড়িয়া ভাষায় আলাপ হতো। দুই বছর ধরে ছোট বোন খ্রিস্টিনা কেরকেটা অসুস্থ্। ফলে বড় বোন ভেরোনিকা ছোট বোন খ্রিস্টিনাকে নিয়ম করে দেখতে গেলেও তাদের মধ্যে আড্ডাচ্ছলে খাড়িয়া ভাষায় খুব একটা আলাপচারিতা হয় না। এ কারণে খাড়িয়া ভাষাটি অনেকটা মৃত্যুর মুখে। যেহেতু এই দুই বোন ছাড়া দেশে আর কেউ ভাষাটি জানে না, বোঝে না বা চর্চা করে না; তাই সহজেই অনুমেয় যে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভাষা ‘খাড়িয়া’।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিজস্ব ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। এর মধ্যে বম, কোল, চাক, শো, খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, লালেং বা পাত্র ও লুসাই ভাষাগুলো বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক ভাষা সমীক্ষায়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এ ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম। এসব ভাষাভাষী লোকেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

‘বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার’ নামের খাড়িয়া ভাষা শিক্ষা সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা পিওস নানোয়ার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন বর্মাছড়া চা শ্রমিকের সন্তান নানোয়ার। খাড়িয়া ভাষা সম্পর্কে আলাপকালে তিনি বলেন, “আমি নব্বইয়ের দশকে স্কুলশিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় দাদির কাছ থেকে প্রথম কিছু খাড়িয়া শব্দ শিখেছিলাম। আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে ২০১৭ সালে আমাদের বর্মাছড়া বাগানের উত্তরণ যুব সংঘের মাধ্যমে আমরা ‘বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার’ নামের একটি খাড়িয়া ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র গঠন করি। প্রাথমিকভাবে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মাধ্যমে কিছু শিশুকে খাড়িয়া ভাষা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা চলে।”

পিওস নানোয়ার বলেন, মূলত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা এবং হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চা বাগানগুলোর ৪১টি শ্রমিক কলোনিতে খাড়িয়া জাতিগোষ্ঠীর বাস। সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় খাড়িয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা দেশের চা বাগানগুলোর ওই ৪১টি শ্রমিকপাড়া চষে বেড়িয়ে হাজারের মতো খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাই এবং তাদের নাম তালিকাবদ্ধ করি। অনুসন্ধানে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাইনি। খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্রণ বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে তৎকালীন তরুণ প্রজন্মকে খাড়িয়া ভাষা রক্ষায় ভাষাটি শেখানোর চিন্তাভাবনা করি। কিন্তু দেশে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকায় আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

একই বাগানের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভিনসেন্ট কেরকেটা বলেন, ‘আমাদের দেশের চা বাগানগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। চা বাগানগুলোর অনেকগুলো ভাষা সংরক্ষণ ও পরিচর্চার অভাবে আজ বিপন্ন। খাড়িয়া ভাষায় কথা বলেন মাত্র দুজন। বাকি খাড়িয়া জনগোষ্ঠী সাদ্রিবাংলা, দেশোয়ালী ও খাড়িয়া ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলে। দুই বোনের মৃত্যুর পর প্রকৃত খাড়িয়া ভাষা হারিয়ে যাবে। এটি সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক।’

তাদের সঙ্গে আলাপকালে খাড়িয়া ভাষা জানা ভেরোনিকা কেরকেটা বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর আগেও এ দেশে আমি, আমার স্বামী ও ছোট বোন; এই তিনজন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারতাম। ২০১৯ সালে আমার স্বামী আব্রাহাম সোরেং মৃত্যুবরণ করলে ভাষাটি নিয়ে টিকে আছি আমি ও আমার ছোট বোন খ্রিস্টিনা কেরকেটা। ছোট বোনও এখন অসুস্থ। মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে দেখা হলে আমরা নিজেদের খাড়িয়া ভাষায় টুকটাক কথা বলি। আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি কেউ এ ভাষা না জানায় তারা কেউই এ ভাষায় কথা বলতে পারে না, দুয়েকটি শব্দ জানে মাত্র। শেষ বয়সে এসে মনে চায় নিজেদের ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলি। তবে আর কেউ খাড়িয়া ভাষাটি না জানা, না বোঝায় তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করা সম্ভব হয় না।

(এএ/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪)

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test