E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’ শেষ পর্ব

২০১৪ আগস্ট ০৩ ১৬:০৯:২৯
‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’ শেষ পর্ব

প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

অনেক চেষ্টা তদবির করেও কিছু হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএত ভর্তি হওয়া গেল না। সিদ্ধান্ত নিলাম কুমিল্লা চলে যাবো। যাবার আগে হল থেকে ফোন করেছিলাম ‘স’কে। স্বপনের কাছ থেকে টেলিফোন নাম্বার নিয়েছিলাম। বললো, ‘বংশালে আসার জন্য। একটি পর্দাঢাকা চায়ের দোকানে বসে ঘন্টাখানেক আলাপ হলো। কিছুটা নরোম হয়ে এসেছে কিন্তু ‘গ’এর বিষয়ে বিশ্বাস আগের মতোই কোনো নড়চড় নেই।

বললো, ‘ওকে কষ্ট দেবেন না। ভবিষ্যতে বিয়ে করে সুখী হন। মেয়েটা ভালো, দেখতেও সুন্দরী দু’জনায় মানাবে খুব। আমাদের সম্পর্কটা স্বল্পায়ু ছিল তাতে কোনো দুঃখ নেই, একটা সিরিয়াস কিছু ঘটার আগেই সরে এসেছি, এটাকে মঙ্গলজনকই বলতে হবে। তবুও তো কিছু চমৎকার স্মৃতি, কিছু আনন্দমুখর সময়, ভালোলাগার মুহূর্ত পেলাম এটাইবা কম কিসে! এর বেশি হয়তো আমাদের ভাগ্যে ছিল না।’ ‘স’ একটা বিষণ্ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে বিদায় দিল। কুমিল্লায় ফিরে আসতে আসতে মনে মনে বললাম, ‘আমার আর কারো প্রয়োজন নেই। কারো প্রয়োজনেও আমি নেই।

এবার আমি মুক্ত স্বাধীন। নির্বিঘ্নে আকাশে উড়ে বেড়াবো। মুক্তবিহঙ্গ। বালির খেলাঘর ভেঙ্গে বালির সঙ্গে মিশে গেছে।’ লতিফমামা ঠিক ঠিক সুখবর নিয়ে এসে হাজির হলেন একদিন। বললেন, ‘স্টুডেন্ট হিসেবে উচ্চশিক্ষার্থে জাপানে যাওয়া যাবে।’ সার্টিফিকেট এবং পাসপোর্ট জমা দেওয়া হলো। আবার মফিজও বললো, ‘দোস্ত টেনিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যাবে। ওখানে গিয়ে টোফেল কোর্স করতে হবে। ভিসা দেবে কোনো ভুল নেই। কি করবি এক মাসের মধ্যে জানাবি আমাকে।’ এক মাসও লাগেনি ১৫ দিনের মধ্যেই জানিয়ে দিলাম তাকে, তুই যা আমি টোকিও যাচ্ছি।’ এবং আমার আগেই মফিজ চলে গেল আমেরিকাতে।

১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে বিদেশযাত্রার সিদ্ধান্ত হলো। ‘স’কে খবর দিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় এলো। একদিন দুপুরের পরে নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরে এলো। সন্ধ্যে পর্যন্ত বেশ হাসিখুশি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে সময় কাটালাম। ওর প্রিয় সুমন কল্যাণপুরের গানটা বাজালাম, ‘পায়ের চিহ্ন নিয়ে / পড়ে থাকা পথটা যার / তার আসার দিনের কথা/ লেখা বুঝি........।’ আমার সামনে বিছানায় বসেছিল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কেঁপে উঠলো। টপ টপ করে ঝরে পড়া তার চোখের তপ্ত জলে আমার বাঁ হাত ভিজে গেল। কিন্তু না। এপ্রিল মাসে চেষ্টা করেও জাপানে প্রবেশ করা গেল না। যে স্কুল স্পনসর হয়েছিল তার বাজে রেকর্ড আছে সরকারের জাস্টিস মিনিস্ট্রিতে। জাস্টিজ মিনিস্ট্রি ইমিগ্রেশন নিয়ন্ত্রণ করে। কি আর করা? ফিরে এসে পরে অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে জাপানে প্রবেশ করলাম জাপানে আমি।

এই ক’মাস আর কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি। তখন আমাদের বাসা ছিল উজির দীঘির পাড়ে। ফলে বিষ্ণু, স্বপনরাও জানে না। বাসা থেকেও বেরোলাম না। বরং বই পড়া ও লেখালেখি করে সময় কাটালাম। লতিফমামা নতুন স্কুল খুঁজে বের করলেন। ভিসা তো ক্যান্সেল হয়নি। জাপানে গিয়ে কি করবো সব পরিকল্পনা করেছি। ‘স’ও জানে না যে আমি দেশেই ছিলাম আরও চার মাস। এখনো মনে পড়ে, সেই দিনটির কথা যেদিন খুব সকাল বেলা বাবা-মাকে প্রণাম করে যাত্রা করলাম লতিফমামার সঙ্গে, তিনি আমাকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন। তাঁর মাধ্যমে টাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।

সেই টাকা পরে পরিশোধ করেছি। আমি কোনোদিন আমার বাবার চোখের জল দেখিনি। গতবারও যখন বিদায় নিয়ে গিয়েছিলাম, এত বিহবল ছিল যে, কোনো কিছু অনুভব করতে পারেনি। হেসে বিদায় দিয়েছিল। এবার প্রণাম করতে গেলে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাঙা গলায় বললো, ‘বিদেশ গিয়ে অমানুষ মানুষ, আবার মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। তুমি যাই করো, দেশকে ভুলে যেও না। দেশকে ভুলে গেলে আমাদেরও ভুলে যাবে। দেশই তোমার শেষ আশ্রয়।’ আজ ৫০ বছরের বেশি সময় ফেলে এসে বাবার মৃত্যুতে পেছনে ফিরে যখন তাকাই দেখতে পাই আমার জীবনের অর্ধেক সময়ের বহু দুঃখসুখ আর ঘটনাবলির সঙ্গে বাবা নীরব সাক্ষী হয়ে জড়িয়ে আছে। কতভাবেই না ঋণী তাঁর কাছে! আমার এই পর্যন্ত এসে দাঁড়ানো তার পেছনে বাবা ও মার অবদান অসামান্য।

মা আমার অস্তিত্বের ধারক আর বাবা আমার আত্মপরিচয়। আজকে জীবনজীবিকার তাগিদে বন্ধু-বান্ধবী সবাই বিচ্ছিন্ন। শিখা বাংলাদেশে, ‘স’ বিয়ে করে আজকে আমেরিকাতে, ‘গ’ স্বামীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে আর আমি জাপানে। জাপানে আসার পর আজ পর্যন্ত এই তিনজনের সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। কে কেমন আছে জানি না। কিন্তু যখনই এদের কারো মুখ মনে পড়ে তখন বাবার ছায়া দেখতে পাই। আবার যখনই বাবার স্মৃতি স্মরণ করি তখন এরা মনের সামনে এসে দাঁড়ায়। ....সমাপ্ত।

আলোকিচত্র: ২০১২ সালে জাপান থেকে স্বদেশে ফিরে যাই। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে বাবা শেষ পেনশনের টাকা তুলে ঘরে ফেরার সময় অটোরিকশোতে একসঙ্গে। সেদিনটি এত বেশি বেদনাদায়ক ছিল যার ব্যাখ্যা পৃথিবীর কোনো প্রকার গ্রন্থেই থাকার কথা নয় একমাত্র অনুভব ছাড়া।

লেখক : জাপান প্রবাসী

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test