E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

করোনাকালে বাজেট বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ 

২০২০ জুলাই ০২ ১৫:০৪:১৮
করোনাকালে বাজেট বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ 

নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


নির্দিষ্ট সময় সাধারণত একবছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের সম্ভাব্য হিসাবকেই বাজেট বলা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে ১৭৩৩ সালে সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যে বাজেট দেওয়া হয়। সরকারি বাজেটে একদিকে সরকারের আয়ের উৎস এবং অপরদিকে সরকারের ব্যয়ের খাত সমূহ প্রদর্শিত হয়ে থাকে। একেক দেশের বাজেটের ধরণ একেক রকম হয়ে থাকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। অর্জিত আয় এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বাজেটকে একটি আর্থিক পরিকল্পনাও বলা যেতে পারে। সুষম এবং অসম এ দু’রকমের বাজেট সাধারণত হতে পারে। যে সব বাজেটে আয় ব্যয় সুসম হয় তাকে সুষম বাজেট অপরপক্ষে যেখানে অসমান হয় তাকে অসম বাজেট বলে। এই অসম বাজেটের মধ্যেই উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি বাজেট দেখা যায়।

দেশের পূর্ণ কর্মসংস্থানের স্তর বজায় রাখা ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন প্রভৃতির জন্য উন্নয়নশীল দেশ সমূহে প্রচুর পরিমাণে ব্যয় হয়ে থাকার কারণে বাজেটের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেয়। তাই এ ঘাটতি বাজেট ব্যবস্থায় আমরা পরিচিত এবং অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ৭’শ ৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পাস হয়েছে ২০২০-২১ সালের ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট।

সারা পৃথিবীতেই করোনার কারণে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। তাই এবারের বাজেট অন্যান্য বছরের চেয়ে একটু ভিন্ন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কাছে জিডিপি, রিজার্ভ বা প্রবৃদ্ধির হার কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। যদিও এসব মানুষের কর্মের উপর ভিত্তি করেই এসব অর্থনৈতিক সূচক তৈরি হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষ চায় দু’বেলা পেট ভরে ভাত খেতে এবং শান্তিতে ঘুমাতে। আর এ করোনা পরিস্থিতিতে সব খাতই বিপর্যস্ত। জিডিপিতে যোগান দেয়া সব খাতেই চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এখন দেখা যাক এবারের বাজেটে যেসব আয়ের খাত গুলো দেখানো হয়েছে তার বৃহৎ দিক গুলো। বাজেটের আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হলো রাজস্ব।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ছাড়াও এর বাইরে থেকে টাকা আসে। এছাড়াও ব্যাংক ঋণ, সঞ্চয়পত্র, বৈদিশিক অনুদান, অন্যান্য ঋন,কর ছাড়াও প্রাপ্তির জায়গা রয়েছে। এ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে রাজস্ব বোর্ডের আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব বোর্ড বর্হিভূত কর ১৫ হাজার কোটি টাকা। কর বর্হিভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা । সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে এনবিআরকে। সারা পৃথিবীতে করোনার প্রভাব থাকায় প্রায় সব কিছুই বন্ধ রয়েছে। বন্ধ থাকার ফলে এনবিআর তাদের লক্ষ্যমাত্রা আদৌ পূরণ করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

১ জুলাই বাজেট কার্যকর হওয়ার দিন থেকেই করোনাকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। আর কোনদিন এ করোনা থেকে মুক্ত হবো এ বিষয়েও নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তাছাড়া করোনা মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আগের মতো হয়ে যাবে এটাও বলা যাবে না। তাই সত্যিকার অর্থে এ বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আহরণ। বিভিন্ন ঋণের মাধ্যমে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতে হবে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক সূত্র থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১লাখ ৯হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ,বৈদেশিক ঋণের সুদ, মূলধনের ব্যয়, সুদ ভুর্তকি ও পেনশন এবং অন্যান্য ব্যয়তো রয়েছেই। একটি বাজেট হচ্ছে রাজনৈতিক সরকারের দর্শন। থাকে অগণিত প্রতিশ্রুতি। আর সরকারের দর্শন এ বাজেটে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। আর এই বাজেট সঠিকভাবে বাস্তবায়ন নির্ভর করে সরকারের ব্যবস্থাপনার উপর। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে মানুষের মুখে আহার তুলে দিয়ে উন্নয়নের পথে ধাবিত করাই বাজেটের মূল লক্ষ্য তাই এ বারের করোনা কালের বাজেটে বিভিন্ন দিক থেকেই সরকারকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা, বিনিযোগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান তৈরি করা এ বাজেটের মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। কারন লক ডাউন থাকার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যে নেমে এসেছে স্থবিরতা এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক হারিয়েছে তাদের চাকুরি। তাই তাদের পুর্নবাসন করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।

জিডিপিতে বিশেষ অবদান রাখা এবং দেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম খাত হচ্ছে কৃষি। ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এবাজেটে মানুষের চাহিদা বিবেচনা করে সবচেয়ে বেশি সামনে আনা হয়েছে স্বাস্থ্য খাত কে। যদিও এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্ধ হয়েছে একথা বলা যাবে না। কারণ বৈদেশিক এ মহামারিতে মানুষকে টিকিয়ে রাখার স্বাস্থ্যখাতের ভূমিকা বড় চ্যালেঞ্জ। দুর্নীতি কমিয়ে এনে বাজেটের অর্থ যথাযথ ব্যবহার করলে সুফল পেতে পারে দেশের জনগণ। করোনা মোকাবেলায় এবছর স্বাস্থ্য খাতের জন্য থোক বরাদ্ধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্ধ রাখা হয়েছে।

মহামারিকালে এ বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। এবার করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের যে বেহাল দশা বেরিয়ে এসেছে তা থেকে উত্তোরনের পথ খুঁজে বের করতে হবে এবং বরাদ্ধকৃত বাজেটের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। প্রতি বাজেটের ন্যায় এবছরও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। এবারও শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বাজেটের ১৫দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। যার বেশির ভাগই অবকাঠামো উন্নয়ন ও বেতন ভাতাতেই ব্যয় হয়ে থাকে তাই এ খাতে বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে। প্রতি বছরই বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির একটি অনুমান করা হয়।

দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে উৎপাদিত সব রকমের দ্রব্য ও সেবার আর্থিক মূল্যকে জিডিপি বলা হয়ে থাকে। মোট দেশজ উৎপাদন হিসাবের সময় দেশের ভেতরে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ থেকে উৎপাদিত সকল প্রকার দ্রব্য ও সেবাকর্মকে ধরা হয়। বাজেটে ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু করোনাকালে আদৌ এ জিডিপির হার বাস্তবায়ন সম্ভব কি না ? করোনা কালে দেশের চাকা অনেকাংশেই বন্ধ থাকার কারণে জিডিপির এই প্রাক্কলন আজও অর্জিত হবে বলে মনে করা দুরুহ।

জিডিপির সাথে আমদানি এবং রপ্তানির ব্যবধান যোগ করা হয়ে থাকে কিন্তু করোনাকালে কার্যত পৃথিবী অচল থাকায় আমাদানি এবং রপ্তানির ভারসাম্যটা চরম আকার ধারণ করেছে। এবিষয়ের আলোকে দেখা যাবে জাতীয় উৎপাদনে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। মুদ্রার যোগান বৃদ্ধি, উৎপাদন হ্রাস, উদার ঋণ নীতি, খাদ্য ঘাটতি ও আমদানি দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবছর মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা দেখা যাব্ েএখন দেখার বিষয় মুদ্রাস্ফীতি কতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সরকার। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের চাহিদারও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন বাড়ছে এক শ্রেণির মানুষের আর্থিক সক্ষমতা তেমনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো যাতাকলে পিষ্ট হয়ে জীবন হয়ে যাচ্ছে বিভিষিকাময়।

এসব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার মাধ্যমে মূল ¯্রােতে রাখার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বৃদ্ধির প্রস্তাব করাও রাখা হয়েছে এবছর। এখাতে এবছর বরাদ্ধ রাখা হয়েছে ৪.৭ভাগ। মোট কথা হচ্ছে বাজেটের সার্বিক বিষয়ই মানুষের কল্যাণে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের বেলায় যে বাজেট বরাদ্ধ হয়ে থাকে তা যদি সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানুষের অনুকূলে নিয়ে আসা যায় তাহলে নির্ধিায় বলা যায় অর্থনৈতিক ভীত হবে মজবুত। সময়ের প্রেক্ষাপটে কিছু মানুষ আজ বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে শিখেছে। আর এ বাজেটকে পূজি করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সমাজ বাজার ব্যবস্থাকে করে তোলে অস্থিতিশীল। এসব ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের তীক্ষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।

অন্যদিকে এনবিআরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করের আওতা বৃদ্ধি করা জরুরি। যেসব ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান আয়কর দেয়ার যোগ্য কিন্তু এখনও আওতায় আসেনি তাদেরকে আয়করের অর্ন্তভূক্ত করতে হবে। এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে এনবিআরের কার্যক্রমকে করদাতাদের দোড়গোড়ায় নিয়ে আসতে হবে যাতে হয়রানি মুক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় করদাতারা কর প্রদান করতে পারে এটা এনবিআরের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

এসব দিক বিবেচনায় সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন করা গেলে বাজেট হবে জনবান্ধব। পেশকৃত বাজেটের আকার চলতি বছরে করোনা কালে বড় দেখালেও অবাস্তব নয় তা অবশ্যই বাস্তবায়ন যোগ্য বলেই মনে হয়। পক্ষে বিপক্ষে রাজনৈতিক বিবেচনায় সমালোচনা করলেও বাস্তবতায় সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে যাবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সকল বাঁধা এড়িয়ে করোনাকালে মানুষ রক্ষার এ বৃহৎ বাজেট বাস্তবায়নই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test