E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ধর্মান্ধ-মৌলবাদ এবং ভাস্কর্য 

২০২০ নভেম্বর ২৭ ১৬:২১:২৯
ধর্মান্ধ-মৌলবাদ এবং ভাস্কর্য 

ফজলুল হক খান


পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ সুন্দর ও সত্যের পথে এগিয়ে চলেছে। অন্ধকার ও অসভ্যতা এবং বর্বরতাকে দূরে ফেলে দিয়ে মানুষ দিন দিন আলোর পথে এগিয়েছে যুগ-যুগান্তর ধরে। এ এগিয়ে চলা মানুষের চিরন্তন। যদিও একশ্রেণীর মানুষ অন্ধকারকে জাপটে ধরে আরো গহীনে প্রবেশ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরত। আর তা তারা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ধর্মকে ব্যবহার করে। অথচ প্রগতির পথে উন্নয়নের মশাল জ্বালিয়ে মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার করে সভ্যতায় এনে দিচ্ছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

প্রযুক্তির ব্যবহার করে এ মানুষই উন্নত জাতেরকৃষি পণ্য, অধিক আমিষ সমৃদ্ধ মৎস্য চাষ, বিপুলসংখ্যক মানুষের আমিষ ও প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে উন্নত জাতের গবাদি পশুর জাত উদ্ভাবন, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তির জন্য মানুষ চালিয়ে যাচ্ছে তার গবেষণা কর্ম। স্বল্প সময়ে ও অল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের দ্বার করে যাচ্ছে উন্মোচন।সাগরের তলদেশ থেকে মানুষের মঙ্গলে সম্পদ আহরণ থেকে শুরু করে স্থল এবং আকাশে প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে মানুষ ছুটে চলেছে নিরন্তর। এসবই মানুষের জন্য সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কে সাথে নিয়ে। কিন্তু ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুন্দরতম ও সঠিক ব্যবহার যেমন ব্যক্তিজীবনে করছে - তেমনি গোষ্ঠী ও সাংগঠনিক জীবনেও এর সুফল তারা নিচ্ছে গুনে গুনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার দিন দিন বাড়ছে যেভাবে তা নিয়ে সচেতন মহল শঙ্কিত হয়ে পড়ছে।

এ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও তার ব্যবহার আরো বাড়ছে। মানুষ হওয়ার চেয়ে শুধু লোক দেখানো ধার্মিক হওয়া যেন বড় কাজ। মানুষ হয়ে ওঠার তাড়না বোধহয় তাদের মধ্যে নেই। নৈতিক মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ তৈরি যে কত প্রয়োজন তা অনেক ক্ষেত্রেই হচ্ছে উপেক্ষিত। নৈতিক মানবিক মানুষ তৈরি ও শিশু মননের বিকাশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও সৃষ্টিশীল কর্মের প্রশ্ন যেখানে আসছে সেখানে ওরা ধর্ম নিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সাধারণ শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে শিশু মনকে অনুপ্রাণিত ও বিকশিত করে ,শিশুর মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়, সুন্দর মন নিয়ে শিশু-কিশোররা বেড়ে ওঠে এমন কবিতা ,গল্প ,প্রবন্ধ , ছড়া সন্নিবেশনও ওরা বাধা দেয়ার সাহস দেখায়।

সভ্যতার দৃশ্যমান সৌন্দর্যের দেশগুলোতে সমাজের এমন চিত্র লক্ষ্য করা যাবে কিনা জানিনা। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এ দেশটিতে দৃশ্যমান হচ্ছে তা দিন দিন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রক্ত গঙ্গা পেরিয়ে স্বাধীনতা আনার দেশটিতে স্বাধীনতার ৪ বছরের মাথায় যা ঘটেছে ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। সত্য ও সুন্দরের খোঁজ করতে গিয়ে এমন নির্মমতার শিকার হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক - জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মনে প্রানে যা লালন ও বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে তারই প্রতিফলন ঘটাতেন ।

সে বিশ্বাস কে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই তাকে জীবন দিতে হয়। পৃথিবীর বর্বরতম উদাহরণ সমূহকে পেছনে ফেলে এক অন্ধকার অধ্যায়েরই সূচনা ঘটায় ঘাতকেরা ১৯৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট। অথচ ধর্ম -বর্ণ, গোত্রভেদ ভুলে একটি সুন্দর সোনালী বিনির্মাণ করতে যিনি ছিলেন আপোষহীন, স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা ছিল যার একমাত্র চাওয়া, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে যিনি ছিলেন বিশ্বের মডেল, সমাজে সাম্যতা আনতে তিনি দুর্নীতিমুক্ত ও শোষনহীন একটি সমাজের স্বপ্ন কে এগিয়ে নিতে নেন অনিয়ম ও অরাজকতার বিরুদ্ধে এক কঠিন শপথ । ফলশ্রুতিতে অমানুষেরা দেশটিকে অন্ধকার যুগে পাঠিয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটিয়ে জাতিকে ইতিহাসের উল্টো পথে হাঁটা শেখাতে প্রস্তুত করার চেষ্টা করতে থাকে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা শুধু একজন মুজিবকে হত্যা করতে চায়নি -তারা হত্যা করতে চেয়েছিল একটি সভ্যতাকে, একটি ইতিহাস ও একটি জাতির সত্তাকে। পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়ে তারা কলঙ্কিত করে এ মাটিকে। জাতি এ কষ্ট বয়ে বেড়িয়েছে বহুদিন।

জাতির মুক্তির জন্য সকল যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে ক্ষরণের ভেলায় চড়ে যাত্রা শুরু করেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা। ইতিহাসের অনেক পথ পেরিয়ে বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তিনি জাতির হাল ধরেছিলেন । ফিরে আনার চেষ্টায় মগ্ন থেকেছেন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা জাতির সত্তাকে আলোতে ফেরানোর। এরই ধারাবাহিকতায় যে সময়ে তিনি যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার, ১৫ই আগস্ট হত্যাকারীদের বিচার রোধ করার জন্য প্রণীত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার, ৩রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যাকারীদের বিচারসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি, বয়স্ক নারী -পুরুষ, স্বামী পরিত্যাক্তা, বিধবা, গৃহহীন, প্রতিবন্ধী, অসচ্ছল, অচল ও গর্ভবতী মায়েদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন সে সময়ে সমাজের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী, অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কিছু মানুষ সরকারের এমন অর্জনকে ম্লান করার চেষ্টায় লিপ্ত। শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা, এমনকি দলের ভেতরে জায়গা করে নেয়া অনেক নেতা- কর্মী নিজেদের পকেট ভারি করতে এমন মহোৎসব চালিয়ে যাবার মিশনে নেমেছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ না করেই লোকদেখানো বঙ্গবন্ধু প্রেমিক সেজে আখের গোছাতে তারা ব্যস্ত। এরা পদ পদবী নিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং জয় বাংলা স্লোগান কে পুঁজি করে তারা সরকার ও দল অপ্রস্তুত হয়ে যায় এমন সব কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে বীরের মতো। এদের হাত ধরে দলের অভ্যন্তরে দলে দলে প্রবেশ করছে সুবিধাবাদী ও অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়া মানসিকতার লোকজন ।

দীর্ঘদিন যাবৎ দলীয় সভানেত্রী এ সকল বিষয়ে কঠোর বার্তাসহ জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করলেও এদের কর্ণকুহরে তা খুবই কম প্রবেশ করছে। এত সবের পরেও নতুন করে আবারো যুক্ত হয়েছে ধর্মের লেবাসে থাকা কতিপয় রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড । সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের উসকে দেওয়ার ময়দান তৈরি করছে।বঙ্গবন্ধু ও জাতির সত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য না করে একাকার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই তারা আসলে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। সারা মুসলিম দুনিয়ায় দার্শনিক ও মনীষীদের ভাস্কর্য থাকলেও আপত্তি তাদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে।

ভাস্কর্য নিয়ে তারা আসলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে হয়তো মাঠে নামাতে চাচ্ছে। সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার উদারনীতিকে তারা বোধহয় দুর্বলতা মনে করছে। তারা ইতোপূর্বে বিমানবন্দরের সামনে ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা প্রদান করেছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়েছিল হেফাজতসহ মৌলবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী গুলো । সরকার তাদের দাবির প্রতি সম্মান জানানোই ছিল বোধহয় প্রথম দুর্বলতা। আর সে দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তারা ভাস্কর্য নিয়ে এখন হুংকার ছাড়ছে। আসলে ওরা যাই বলুক, ওদেরকে যেভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করা হোকনা কেন - বেলাশেষে কিন্তু ওরা যা, তা -ই। মানুষকে মানুষ হিসেবে তৈরির অনুপ্রেরণা না দিয়ে মানুষকে দিকভ্রান্ত করার নেশায় মেতেছে। মানুষকে অন্ধকারে নিয়ে যাবার যত রকমের ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন ওরা তার সবটাই করে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো লাখো শহীদের রক্তে ভেজা এ মাটিতে জাতি সেটা করতে দেবো কিনা।? ওদের ঢালা পানি আর বোধহয় সামনের দিকে এগিয়ে দেবার সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। যদি তা হয় তার জন্য চরম মূল্য পরিশোধের জন্য জাতিকে হয়তো প্রস্তুত থাকতে হতে পারে।

লেখক :ফজলুল হক খান, মোবাইল নম্বর :-০১৭১২-২১১৮১১, ই-মেইল নম্বর:[email protected]

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test