E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই : খবর আছে, মন্ত্রী সাহেব!

২০২০ ডিসেম্বর ১৬ ২১:৩৮:০২
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই : খবর আছে, মন্ত্রী সাহেব!

আবীর আহাদ


মুক্তিযোদ্ধা তালিকা । এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্ন । এটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের প্রশ্ন । জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন । এটা নিয়ে ছলচাতুরি, তালবাহানা, হেলাফেলা ও জালজালিয়াতি চলবে না । চলতে দেয়া হবে না ।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্যুপরি আন্দোলন, সংগ্রাম ও লেখালেখির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আগামী ৯ জানুয়ারি শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেটধারীদের যাচাই বাছাইয়ের যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, সেটির ওপর আমরা তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছি । যদিও গৃহীত যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই, তারপরও আমরা চাই যাচাই বাছাই হোক । তবে আমাদের কাছে খবর আসছে, তাদের মনোনীত নতুন যাচাই বাছাই কমিটিতে ২০১৭ সালের বিতর্কিতরা ধর্ণা দিয়ে পুনরায় অবস্থান নিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যাদের অধিকাংশই হাজার হাজার ভুয়াদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ নিয়ে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সুপারিশ করেছিলো ।

অপরদিকে এ তালিকার ভুয়ারা অর্থ নিয়ে ভারতীয় ও লাল তালিকার মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরঘুর করছে ! এ অবস্থায় বাণিজ্যিক ধান্দায় যদি এ যাচাই বাছাই ভেস্তে গিয়ে ভুয়ারা আবার মুক্তিযোদ্ধা হিশেবে পুনর্বহাল হয়, তার সব দায়-দায়িত্ব মন্ত্রী মহোদয়কেই নিতে হবে । এ অপ্রীতিকর অবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেজন্য মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, যাচাই বাছাই এলাকার মধ্যে এনএসআই এসবি, ডিবি, ডিজিএফআই ও দুদকের গোয়েন্দা জাল বিস্তার করুন----যাতে কমিটির কোনো সদস্য, অমুক্তিযোদ্ধা ও সাক্ষীরা আর্থিক লেনদেন করতে না পারে । এছাড়া যাচাই বাছাইয়ের দিন ও স্থলে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনসহ আইন-শৃঙ্খলারক্ষাবাহিনী মোতায়েন রাখুন । কেউ ভুয়া প্রমাণিত হলে বা মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেফতার ও তার গেজেট বাতিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । এ রকম ২/১টা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারলে দেখবেন, কোনো ভুয়া ও সাক্ষ্যদাতা যাচাই বাছাই স্থলে হাজিরই হবে না । আর কেউ যদি উপযুক্ত কারণ ছাড়া যাচাই বাছাই স্থলে গরহাজির থাকে তাহলে তাৎক্ষণিক তাকে অমুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে । যেমন আমার জানা মতে, অতীতে যতোবার যাচাই বাছাই হয়েছে ততোবারই একজন প্রভাবশালী অমুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আত্মীয় মারফত 'গুরুতর হৃদরোগে'র প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে দিয়ে যাচাই বাছাই বোর্ডে অনুপস্থিত থেকে পার পেয়ে এসেছে ! এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায় সে-বিষয়টির দিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে ।

শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেট যাচাই বাছাই করে ক্ষান্ত দিলে হবে না, পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সব তালিকার অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের জন্যে উপরোক্ত প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে । মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র বেসামরিক গেজেট নয়, অন্যান্য সব তালিকার মধ্যে বিপুলসংখ্যক অমুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে ।

এতো দাবি, এতো প্রতিবাদ ও এতো সুপরামর্শ দেয়ার পরও যদি প্রকাশিতব্য মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার থেকে যায় তাহলে কিন্তু খবর আছে, মন্ত্রী সাহেব ! আমাদের হিসেব মতে দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কোনো অবস্থাতেই দেড় লক্ষের ওপর নয় । দেখি, আপনার তালিকার সংখ্যা কতো দাঁড়ায় ?

দুই .

বর্তমান মন্ত্রী মহোদয় ও জামুকার অতীত ও চলমান কার্যক্রম দেখে-আসার ফলে আমাদের কাছে এটাই প্রতিভাত হচ্ছে যে, তাদের এ চলতি যাচাই বাছাই ফলপ্রসূ হবে না ! সে জন্যে আমরা আমাদের দাবিতে অটল । অমুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করতে হলে বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ভিত্তিতে যাচাই বাছাই ছাড়া অন্য প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা (1972) : Freedom Fighters (FF) means any person who had served as member of any force engaged in the War of Liberation.

এটাই হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সংজ্ঞা । বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার ভেতর সংঘবদ্ধ (ফোর্স ) বাহিনীর কথা রয়েছে-----যেসব বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের সাথে সম্পর্ক ছিলো । এ-সংজ্ঞার আলোকে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন সেক্টরভিত্তিক গণবাহিনী (এফএফ), মুজিববাহিনী, সামরিক বাহিনী, ইপিআর-পুলিশ-আনসার বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ দেড় লক্ষ ।

অপরদিকে-------
আকম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকার)-এর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা (2016) : The people who were involved in the liberation war in response to the call of the Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman in between March 26 and December 16, 1971.

এটা কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা হতে পারে না । এটা হলো মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনো-না-কোনোভাবে জড়িত লোকদের সংজ্ঞা-----যাকে প্রচ্ছন্নভাবে মুক্তিকামী জনতার সংজ্ঞা বলা যেতে পারে । জামুকা প্রণীত এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের কথা নেই-----নেই কোনো সংঘবদ্ধ বাহিনীর (ফোর্স ) অস্তিত্ব !

জামুকার ঐ সংজ্ঞার আলোকে মুক্তিকামী সবাই মুক্তিযোদ্ধা ! এদের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ-----কোটি কোটি ! এ-জন্য যখন-তখন যে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন । কেউ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে গণ্য হবে না !

সুতরাং মুক্তিযোদ্ধা নামের এই ধাপ্পাবাজির সংজ্ঞার বাণিজ্যিক লীলাখেলায় অমুক্তিযোদ্ধাদের বহাল রেখে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা করা হলে তা কোনোভাবেই কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না । তবে মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রেখে চলতি যাচাই বাছাইয়ে যদি কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনে, তাহলে সেটিকে আমরা অবশ্যই স্বাগত: জানাবো ।

অতএব, সাধু, সাবধান !

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test