E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি হীনমন্যতা

২০২০ ডিসেম্বর ২৫ ১৩:২৭:২৭
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি হীনমন্যতা

আবীর আহাদ


আমরা মুক্তিযোদ্ধারা একটা সর্বাত্মক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মহাসমরে অপরিসীম শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্ব দিয়ে পৃথিবীর বুকে একটা স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেছি । একটা জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতিসত্তা উপহার দিয়েছি । আমাদের সেই ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতি আমাদের জাতীয় সংবিধান, রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার ও সরকারি নীতিমালায় থাকবে না----রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে না----এটা কী করে হয় ?

আমরা দেশটি স্বাধীন করেছিলাম বলেই বাঙালিরা স্বপ্নেও যা কল্পনা করেনি তাই হচ্ছেন । তারা আজ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, এমপি, সমরপ্রধান, সচিব, বড় শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী প্রভৃতি হচ্ছেন ।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে যে, যাদের বৌদলতে, বলা চলে অবদানের কারণে সমাজ-রাষ্ট্রের উপরোক্ত স্তরে যারা উঠে আসছেন, তারা সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি একধরনের হীনমন্যতায় ভোগেন ! তাদের কৃত-ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতি দিতে যেনো তাদের আঁতে ঘা লাগে ! 'মুক্তিযোদ্ধা' নামটি তাদের বুকে যেনো শেলের আঘাত হানে ! অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা সমাজের দরিদ্র মানুষ বলে তাদের প্রতি একধরনের হিংসায় ভোগেন ! দরিদ্ররা আবার কিসের সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হবে ? এটা হলো পরশ্রীকাতরতা । তাদের সৃষ্ট দেশের ক্ষমতা ভোগ করবো----ক্ষমতা খাটিয়ে লুটপাট করে দেশ-বিদেশে অগাধ সম্পদ কুক্ষিগত করবো, কিন্তু তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিবো না ! এটাই হলো চরমতম অকৃতজ্ঞতা ।

তাই যদি না হবে, তাহলে কেনো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়া হলো না ? কেনো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা অকার্যকর করে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় যখন তখন যারে তারে, এমনকি রাজাকারদেরও 'মুক্তিযোদ্ধা' বানিয়ে দেয়া হচ্ছে ? এর অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে ভাগ বসিয়ে, অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হচ্ছে, তাদের মর্যাদা ধ্বংস করে জাতির সামনে তাদের হালকা করে দেয়া হচ্ছে !

কোনো কোনো অকৃতজ্ঞ অর্বাচীন ক্ষমতাবান রাজনৈতিক সুবিধাবাদী নেতা মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা স্থান পাওয়ার জন্য সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদেরকেই দায়ী করছেন । এটা আংশিক সত্য । মূল সত্য এই যে, 'মুক্তিযোদ্ধা' নির্ধারণে সরকারি পলিসির দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক টাউট, প্রশাসনিক আমলাসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও তাদের অধীনস্থ জেলা উপজেলা ও ইউনিয়নের তথাকথিত কমান্ডাররা । এরাই রাজনৈতিক বিবেচনা, ব্যক্তিস্বার্থ, আত্মীয়তা ও অর্থের বিনিময়ে ভুয়া এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে !

আমি বারবার বলেছি, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আশি হাজারেরও উর্দ্ধে যেসব অমুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে, তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা কোনোই কঠিন কাজ নয় । বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তর সালের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিশনের নেতৃত্বে ইউনিয়নভিত্তিক যাচাই বাছাই করা হলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে । শুধু একটা আইন করে দিতে হবে যে, মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মধ্যে কেউ ভুয়া প্রমাণিত হলে তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ, যার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জরিমানা । ব্যস, তাতেই কেল্লাফতে, ভয়ে-ডরে একজনও ভুয়া তদন্ত কমিশনের সামনে হাজিরই হবে না । অপরদিকে যাদের সুপারিশের ভিত্তিতে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে । এভাবেই একটি নির্ভুল তালিকা বেরিয়ে আসবে । এসব বিষয়ে সর্বাগ্রে সরকারের সদিচ্ছাই মুখ্য । সরকার চাইলে কিনা হয় ।

আমাদের দু:খ হলো এখানে যে, আমাদেরকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা তথা সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের জন্যে পুন:পৌণিক দাবি তুলতে হচ্ছে । অথচ এটি ছিলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগে সৃষ্ট দেশের সরকারসহ জাতীয় বিবেকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য ।

মুক্তিযোদ্ধাদের বহু কষ্ট ও ত্যাগে প্রতিষ্ঠিত দেশটির যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দু'হাতে লুটবেন, অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাহীন করে রাখবেন, তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রদর্শন করবেন-----এটা কোন ধরনের সভ্যতা ভব্যতা ও নৈতিকতা ?

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test