E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন গড়ি 

২০২১ জুন ২৬ ১৪:১৭:১২
মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন গড়ি 

জান্নাতুল মাওয়া শশী


মাদকের প্রতি আসক্তির বর্তমান পৃথিবীতে প্রধান একটি সামাজিক সমস্যা। যা একটি আত্মঘাতী আসক্তি। মাদকাসক্তির দেশের প্রাণ শক্তি যুব সমাজকে ধ্বংসের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের পথ কে বাধাগ্রস্ত করছে। মাদকের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে অপরাধপ্রবণতা। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে মাদক। বর্তমান বাংলাদেশের ১০ জন তরুনদে মধ্যে ১ জন তরুণ মাদকাসক্ত। প্রতিদিন হাজারো তরুণ মাদকাসক্ত মামলায় আসামি হচ্ছেন। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমান বাংলাদেশের সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত যার ১৫ শতাংশ মানুষ উচ্চশিক্ষিত।

বাংলাদেশ মাদকের উৎপাদন হয় না তবে সারা দেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার কোটি টাকা মাদকের লেনদেন হয়ে থাকে। দেশের সীমান্তে ৫১২ পয়েন্ট দিয়ে আসছে ২৪ ধরনের মাদক। দেশের ৩০-৩৫ হাজার লোক মাদক আদান-প্রদানের কাজে জড়িত। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনা হয় প্রতিদিন ৩০ লক্ষাধিক। ভেজাল মাদক তৈরি, মাদক সরবরাহ, মাদকবিরোধী নামের নানারকম কার্যক্রম চালিয়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য মেতে উঠেছে। মাদক ব্যবসায়ী মাদক গ্রহণের সাথে সাথে বিভিন্ন দুর্নীতিতে সাথে জড়িত। ৬৫ লাখ মাদকাসক্তের মাঝে ৮৭ভাগ পুরুষ ১৩ভাগ নারী মাদকগ্রহনকারী। ভারত ও মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত হাজারো মাদক প্রবেশ করছে বাংলাদেশে যা প্রগতিতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। সারাদেশে মাদক বর্তমানে একটি সংকট পূর্ণ রূপ নিয়েছে বেশি করে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশ সমূহ যেখানে অর্থনৈতিক অভাবে ভুগছে বহু সংখ্যক মানুষ। নিরাপত্তার অভাবে আটকানো যায় না বহু অপরাধ, এই পরিস্থিতিতে অপরাধের পথ অনেক বেশি সহজ হয়ে ওঠে। যার ফলে মাদক পাচার বাড়ে ও শিক্ষার ব্যবস্থা ব্যাহত হয়।

মাদক গ্রহণ করছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত। মাদকাসক্তের প্রথম পদক্ষেপ যেখানে সিগারেট সেখানে বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষই সিগারেট গ্রহণ করে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মাদক ও ধূমপান করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি মারাত্মক বলে উল্লেখ করেছেন। ধূমপান করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে ১৪ গুণ বাড়িয়ে তোলেন ও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সাধারণত ধূমপান দিয়েই নেশা শুরু হয়। এরপর যথাক্রমে গাঁজা ফেনসিডিল ইয়াবা, এলএসডি অন্যান্য মাদক গ্রহণ করে থাকে। সমাজের তরুণ ও শিশুরাও মাদক গ্রহণের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। পথ শিশুদের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ পথশিশুরা মাদকে আসক্ত। মাদকের সংস্পর্শে আসার পেছনে বৃহৎ কারণ রয়েছে মাদকের সহজলভ্যতা, সমবয়সীদের চাপ, বেকারত্ব ও সামাজিক অবক্ষয়, সমাজের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে মা বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়া।

রাজধানী থেকে শুরু করে প্রতন্ত্য গ্রাম পর্যন্ত মাদকের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে। মাদক এখন বেশিরভাগ অপরাধ ‌সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ সামাজিক বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডের সাথে মাদক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত। দৈনিক পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ পিতা-মাতা খুন ও মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে ২৫০ স্ত্রী খুন। মাদকাসক্ত সন্তানদের কারনে পরিবারে নেমে আসে কালো ছায়া। অনেক পিতা মাতাকে দেখা যায় মাদকাসক্ত সন্তানের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও করতে হয়। মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য অনেক বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। চুরি, ডাকাতি, লুট, রাহাজানিতে লিপ্ত হয়। মাদকাসক্ত তরুণেরা সমাজে কিশোর গ্যাং তৈরি করে ও চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি করে সমাজের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ইদানীং প্রায় সড়ক দুর্ঘটনার কারণ চালকের মাদক গ্রহণ।

মাদকের কারণে সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হাফিজ মাদকের প্রতিক্রিয়ায় নিজের গলা কেটে মৃত্যু, সিলেটে এমসি কলেজে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে কেড়ে নিয়ে ধর্ষণ, বস্ত্রহীন মহিলাকে নির্যাতন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরারকে পিটিয়ে হত্যা সহ যতগুলো ঘৃন্য, লোমহর্ষক অমানুষিক এই ধরনের কর্মকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তারা সবাই মাদকাসক্ত।

পৃথিবীর কোন ধর্মই মাদক গ্রহণের অনুমোদন দেয়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে সকল প্রকার মাদক দ্রব্যের ব্যবহার একটি জঘন্য ধর্মীয় ও সামাজিক অপরাধ। আর ইসলামের দৃষ্টিতে সকল প্রকার মাদক দ্রব্যের ব্যবহার একটি জঘন্য ধর্মীয় ও সামাজিক অপরাধ। তাই ইসলামী শরীআতে মদ্যপান সম্পূর্ণ ভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে। হাদীস শরিফে বর্ণিত আছে মদ ও ঈমান একত্র হতে পারে না (নাসাঈ শরিফ)। অর্থাৎ কোন মুসলমান মদ গ্রহণ ও বহন করতে পারে না। মাদক দ্রব্য গ্রহণের ফলে, ফুসফুস ও মস্তকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকে। হৃদয় স্পন্দন ও নাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়, চোখ রক্ত বর্ণ হয় এবং মুখ ও গলা শুকিয়ে আসে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এতে হজম শক্তি বিনষ্ট হয়, খাদ্যস্পৃহা কমে যায় মানবদেহে ক্রমাগত অপুষ্টি বাসা বাধতে থাকে। স্থায়ী কফ, কাশি এবং যক্ষারোগের সৃষ্টি হয়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে মানুষের বিবেক বুদ্ধির ওপর দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। একজন মাদকাসক্তের জন্য দৈনিক প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়।

মদ্যপানে প্রচুর ধন-সম্পদ অপব্যয় ওঅপচয় হয়। অপব্যয় মারাত্মক অপরাধ। ইসলামে সর্বপ্রকার অপব্যয় বর্জনীয়। আল্লাহ তা’আলা অপব্যয়ীকে শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন: “নিশ্চয়ই অপব্যয়কারিগণ শয়তানের ভাই (বনী ইসরাঈল: ২৭) আর অপচয় থেকেই শুরু হয় অবৈধ উপার্জনের লোভ লালসা। মাদকাসক্ত তার মাদকের ব্যয় সংকুলানের জন্য নানা রকম দুর্নীতি, অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়ে। মদ পান করে মানুষ নিকৃষ্টতর কর্মকাে ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। অধিকাংশই বিষধর মমাদকের ফলে পরিবেশ দূষিত, যৌনশক্তি লোপ, দুঃখ-দারিদ্র্য বৃদ্ধি, ইবাদতে বাধা সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন, “নিশ্চয়ই শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত হতে বিরত রাখতে চায়। তবুও কি তোমরা তা থেকে নিবৃত হবে না? (আল-মায়িদাঃ৯১) মহানবী (সঃ) বলেন মাদকাসক্তি ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না। মহানবী (স) অন্যত্র বলেন: “আল্লাহ তা’আলা লানত দিয়েছেন মদকে, তার পানকারীকে, পান করানকারীকে, বিক্রেতাকে, ক্রেতাকে, তৈরিকারীকে যা, দ্বারা তা তৈরি করা হয় তাকে, বহনকারীকে, যার কাছে তা বহন করা হয় তাকে (আবু দাউদ, ইবনে মাজা)।

সচেতনতা বৃদ্ধি মাদক নিয়ন্ত্রণে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখবে। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রাপ্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, অপসংস্কৃতি বন্ধের আহ্বান করতে হবে। বর্তমানে সরকার বাংলাদেশে ডোপ টেস্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যা যুবসমাজকে মাদক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। মাদকাসক্তগ্রস্তদের নিরাময়ের জন্য সরকারি ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো ভালো মানের করা জরুরি। আজ মাদক সেবন ও পাচার বিরুদ্ধ দিবসে আমাদের একটাই দাবি, "নেশা ছেড়ে কলম ধরি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি"।

পরিবারেই একটি শিশুর প্রথম বিকাশ ঘটে তাই সন্তানের প্রতি পিতা মাতার ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তাদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হবে। সন্তানকে সঠিক পর্যাপ্ত সময় দিয়ে ও মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের শরীক হয়। সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করি ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার বিষয়গুলোর সম্পর্কে বোঝায় যেনো মাদকের ক্ষতিকর সামাজিক প্রভাব থেকে আগামী ভবিষ্যত শিশুরা মুক্তি পায়।


লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test