E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘ভবন নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করে বাঁচানো যেত নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের

২০২১ জুলাই ১২ ১৭:১৬:১৩
‘ভবন নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করে বাঁচানো যেত নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের

করোনা প্রকোপে ধুঁকছে দেশ। সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট বিপর্যয়ে প্রাণহানী এবং প্রিয়জন হারানোর মর্মন্তুদ আহাজারী। মগবাজারে অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণে প্রাণহানির রেশ কাটতে না কাটতেই ৮ জুলাই নারায়নগঞ্জের হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিকের। ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট প্রায় ২৪ ঘন্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়। ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করেছে ৫২টি তাজা প্রাণ।

গত দুই সপ্তাহে রাজধানী ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ এ পৃথক পৃথক একাধিক অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬০ জন, আহত হয়েছেন আরো শাতাধিক মানুষ। এদের বেশিরভাগই কলকারখানার শ্রমিক। একদিকে করোনা অন্যদিকে কলকারখানায় অনাহূত অগ্নিকাণ্ডে নিভে যাচ্ছে শ্রমিকের জীবন প্রদীপ। অগ্নিনির্বাপক যানের সাইরেন আর অসহায় মানুষের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষের অবিবেচক সিদ্ধান্তের বলি হচ্ছে সাধারণ শ্রমিক।

২০১৩’র রানাপ্লাজা ধ্বস ও তাজরীন ফ্যাশনের কারখানায় অগ্নিকান্ডের মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার এর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফ) , আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), বাংলদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সমন্বিত উদ্যোগে গ্রহণ করা হয় জাতীয় ত্রিপাক্ষিক কর্মপরিকল্পনা (এনটিপিএ)। ২০১৮ সালে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান সমুহের সমন্বয় এর জন্য রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করা হয়েছিল। বায়ার জোট ভিত্তিক সংগঠনের বহির্ভুত অধিক ঝুকিপুর্ণ দেড় হাজার এর অধিক তৈরী পোশাক কারখানার দুর্ঘটনা রোধকল্পে কাজ করছেন সরকারি কারেক্টিভ অ্যাকশন প্ল্যান (ক্যাপ) বাস্তবায়ন প্রকল্পের ৬০ জন বিশেষায়িত প্রকৌশলী। নাজুক অবকাঠামো, ঝুকিপুর্ণ বৈদ্যুতিক ব্যাবস্থা , যথাযথ অগ্নিনির্বাপন ব্যাবস্থা, কারখানার ডিজাইন ড্রয়িং, তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষ এর অনুমোদন ইত্যাদি তদারকি করে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা কেন্দ্রিক তৈরী পোষাক কারখানার পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন ক্যাপ বাস্তবায়ন প্রকল্পের প্রকৌশলীরা। তাদের নিবিড় তদারকিতে এই ১,৫০০ তৈরী পোশাক কারখানায় করোনাকালীন সময়সহ গত ০৩ বছরে শুণ্য-প্রাণহানী বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে আরসিসি।

জাতীয় উদ্যোগের আওতায় আরসিসিতে ন্যস্ত কারখানার সংখ্যা ১৫৪৯টি। এর মধ্যে ঢাকা জেলাতে ৬৪৮টি, নারায়ণগঞ্জ জেলাতে ২৯৯টি, গাজীপুরে ৩৭২টি, চট্টগ্রামে ১৯৩টি এবং অন্যান্য জেলাতে ৩৭টি কারখানা অবস্থিত।
২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকৌশলী কর্তৃক প্রস্তাবিত সংস্কারকাজের ৫০ শতাংশ বা এর কম অগ্রগতি হয়েছে ৩৭১টি কারখানার, ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে ৬৭টি কারখানা এবং ১১১টি কারখানার ৭০ শতাংশ এর বেশি অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্কারকাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে ১৫টি কারখানার, তন্মধ্যে ১টি কারখানা সকলক্ষেত্রে সংস্কারকাজ শতভাগ সম্পন্ন করেছে। আরসিসি প্রকৌশলীদের নিয়মিত পরিদর্শন এবং ডাইফের নিবিড় তদারকির ফলশ্রুতিতে সংস্কারকাজ অগ্রগতি দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় ৬২০টি কারখানা কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে এবং ১০৪টি কারখানা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে।

ডাইফের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯-২০ অনুযায়ী, বর্তমান প্রকল্পের সংস্কারকাজের সার্বিক অগ্রগতি (জুন, ২০২০ পর্যন্ত) প্রায় ৪০ শতাংশ। যা শুধুমাত্র জাতীয় উদ্যোগের আওতাধীন চলমান কারখানাসমূহ বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। আরসিসি এর পরিদর্শন কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে জাতীয় উদ্যোগের আওতাধীন ৬২০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে বিধায় কারখানাসমূহে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে বিবেচনায় সার্বিক অগ্রগতি প্রায় ৬০ শতাংশ বলা যায়।
কলকারখানার দুর্ঘটনার হতাহতের ঘটনা যথাযথ পূর্বসতর্কতা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সঠিক কর্তৃপক্ষের যাচাইকৃত অনুমোদন, সঠিক দুর্ঘটনাকালীন জরুরী ব্যাবস্থা পুর্বনিশ্চিতকরন এবং শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ এ ধরনের পদক্ষেপগুলো কলকারখানার দুর্ঘটনা প্রতিরোধের নিয়ামক।

যেমন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানা ভবনটি ছয়তলা। প্রতিটি ফ্লোর ৩৫ হাজার বর্গফুটের। সম্পূর্ণ ভবনটিতে সিঁড়ি ছিল মাত্র দুটি।

এই আয়তনের একটি ভবনে অন্তত চারটি সিঁড়ি বা বহির্গমনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। যে কারণে অগ্নিকাণ্ডের সময় এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক মাত্র দুটি সিড়ি ব্যবহার করে বের হতে পারেননি এবং ফলশ্রুতিতে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানি হয়, যা সহজেই এড়ানো যেত।

প্রথম আলোর খবরে ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘বিল্ডিং কোড’ মেনে পর্যাপ্ত সিঁড়ি রাখা হলে এত প্রাণহানি হতো না।

দেশজুড়ে এমন অসংখ্য অনিরাপদ কারখানা ভবন রয়েছে যেগুলোকে যথাযথ তদারকির অধীনে নিয়ে সেগুলোর সার্বিক নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষিত ও বিশেষায়িত জনবল দিয়ে কলকারখানা সমুহের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি করাই একমাত্র সমাধান। ক্যাপ বাস্তবায়ন প্রকল্পের অধীনে পারদর্শী প্রকৌশলী তথা জনবল সরকারের অধীনেই রয়েছে। শুধু তৈরী পোষাক নয়, ফায়ার সার্ভিসের নিরাপত্তা পরিকল্পনা, প্রকৌশল জ্ঞান আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের তদারকির সমন্বয়ে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সকল ধরনের কলকারখানাকে সংস্কারকাজ সমন্বয় কেন্দ্র আরসিসি এর অধীনে এনে দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী সমাধান করতে হবে। যদিও সম্প্রতি প্রকল্পের মেয়াদ ও অর্থ বরাদ্দ সক্রান্ত জটিলতার জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাজ স্থগিত রয়েছে। অনিশ্চয়তায় আছে সংস্কার কাজ তদারকি।

নিরাপদ ও শ্রমিকবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কলকারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নয়ত অপার সম্ভাবনার দেশ অপার দুর্ঘটনার দেশে রূপান্তরিত হবে যা দেশের শিল্পখাত এবং রপ্তানিখাতকে ব্যহত করবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে।

লেখক : অমিত পাল, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ও মনজিল হাসান, ফায়ার সেফটি ইঞ্জিনিয়ার।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test