E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

হারিয়ে যাওয়া ‘দাস কেবিন’ : মানিকগঞ্জের ‘কফিহাউজ’

২০২১ অক্টোবর ১০ ১৫:৪৯:০৭
হারিয়ে যাওয়া ‘দাস কেবিন’ : মানিকগঞ্জের ‘কফিহাউজ’

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু


সূর্যোদয় থেকে মধ্যরাতে ঝাঁপ নামা পর্যন্ত প্রতিটি টেবিল প্রাণবন্ত, চলছে সতের থেকে সত্তর বয়েসী নানা গ্রুপের সর্টকাট অথবা ম্যারাথন আড্ডা। জমেছে মার্কস-লেনিন অথবা চারুমজুমদার-চেগুয়েভারা, প্রেম-বিরহ থেকে জীবনানন্দ-চন্ডীপাঠের বিতর্ক। 

এ ছবি প্রায় তিন যুগ আগের। গোয়েন্দাদের রেডবুকের জ্বলজ্বলে নাম মানিকগঞ্জের মধুরক্যান্টিন, কিংবা মান্নাদের “কফি হাউস” খ্যাত দাসকেবিনের। অথচ বিস্ময় আর বেদনা জাগিয়ে অলক্ষ্যে, নিরবেই হারিয়ে গেল মানিকগঞ্জ শহরের দাসকেবিন।

চলতি সময়ের কলেজ পড়ুয়া কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় দাসকেবিন কোথায়? বিস্ময়ভেজা মুখে নিশ্চিত নির্বাক থাকবে সে, চেনে না দাসকেবিন। রাজণীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জানবাজ কর্মী, শহরের তুমুল আড্ডাবাজ তরুণের মত ঝাঁনু গোয়েন্দাও এখন চেনে না দাসকেবিনকে। অথচ মাত্র দুই যুগ অাগে এ ছিল বিস্ময়কর ঘটনা।

এই দাসকেবিনকে মানিকগঞ্জের পার্লামেন্ট অথবা মধুর ক্যান্টিন বলে ডাকতাম । রোম্যান্টিকরা বলতো কফিহাউস। চরিত্র-বৈচিত্রে মান্নাদের গানের কফিহাউজের কার্বনকপি হলেও দাস কেবিনে কফি বিক্রি হয়নি কখনোই। নিখাঁদ ‘চা’ আর আড্ডাই টানতো সবাইকে। আর টানতেন দাসকেবিনের প্রাণভোমরা নারায়ন চন্দ্র দাস, সবার নারায়ন দা।

বৃটিশ শাসনের শেষ দশক । পূর্ণযৌবনা কালীগংগা। এ নদী তীরের বেউথা ঘাটে ছিল আশু দাসের চা-মিস্টির দোকান। জমজমাট স্টীমার ঘাট রাতদিন শ’শ’ যাত্রীর আসা-যাওয়া। এ দোকানের প্রিয়মুখ সুঠাম দেহের সৌম্যকান্তি কিশোর নারায়ন চন্দ্র দাস । চা তৈরীর হাতেখড়ি এখানেই । বাড়ি শহরের দাশড়ায়। আজ থেকে ৬০/৬৫ বছর আগে নারায়ন চন্দ্র দাস মানিকগঞ্জ শহরের মেইন রোডের (বর্তমানে শহীদ রফিক সড়ক) পাশে নিজেই চালু করেন চায়ের দোকান, নাম "দাসকেবিন"। সে সময়ের তুলনায় আধুনিক ছিল এই নাম, অন্ততঃ মানিকগঞ্জ শহরে ।

বেউথা ঘাটের সৌম্যকান্তি কিশোর নারায়ন চন্দ্র দাস সময় পেড়িয়ে দাসকেবিনে হয়ে উঠেন নারায়ণদা । প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও মন-মননে নারায়ণদা ছিলেন আধুনিক মানুষ । চা বিক্রি হোক আর নাই হোক টেবিল চাপড়ানো রাজনীতির তুমুলতর্ক , দিনভর রকমারি আড্ডা-বৈঠক অবলীলায় হজম করতেন তিনি।

সবার অলক্ষ্যেই নিত্য আড্ডাবাজদের অভিভাবক হয়েছিলেন তিনি। কে, ক’দিন দাসকেবিনে গড়হাজির তাও নির্ভুলভাবে বলে দিতেন । আড্ডাবাজ অনেকেরই চিঠি আসতো দাস কেবিনের ঠিকানায়, নারায়নদার প্রযত্নে । ধারকর্জ থেকে শুরু করে বাকি-বকেয়াতেও ভরসা ছিলেন তিনি। বাকির খাতার স্বাস্থ্য ছিল নাদুসনুদুস । কেউ কেউ একযুগ পরে বাকি শুধেছেন, কেউবা আজো শুধেননি।

৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন, ৯০এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মহকুমার রাজনীতির গতি প্রকৃতি আবহাওয়া সব কিছু সহজেই আঁচ করা যেত দাস কেবিনে বসে। শহর কাঁপানো মিছিল-সভা, আন্দেলনের ছককাটা, গোপন সলাপরামর্শ-রণকৌশল নির্ধারণ সবই চলতো দাসকেবিন থেকে ।

৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দেলনের সূতিকাগার ছিল এই দাস কেবিন। দলের অফিস যার যেখানেই থাকুক মিছিল শুরুর ভেন্যু থাকতো দাস কেবিন। পুলিশের তারা খেয়ে ফিরে আসার ঠিকানাও ছিল এখানেই। পাকিস্তান আমল থেকে এরশাদের ৯ বছরে অসংখ্যবার পুলিশী হানা হয়েছে দাসকেবিনে।

দাসকেবিনের আড্ডাবাজদের অনেকেই, এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, চীফ হুইপ হয়েছেন, হয়েছেন ডাক্তার, প্রকৌশলী, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, ডাকসাইটে আমলা, উকিল।

এরশাদ জামানার শেষ দিকে এসে স্থানীয় সরকারী দেবেন্দ্র কলেজে নাটক দেখা নিয়ে সৃষ্ট ছাত্র সংঘর্ষের জের গড়ায় শহরে। দাসকেবিনের সামনের রাস্তার সংঘর্ষে নিহত হয় যুবসংহতির নেতা মোশারফ হোসেন । ঐ রাতেই বিনাদোষে পুড়িয়ে দেয়া হয় দাসকেবিন, পুড়েছিল সর্বংসহা নারায়নদা’র অন্তর। এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি তিনি। ১৯৯১’র ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবী ছেড়েছেন।

দাসকেবিনের মরণযাত্রা মূলতঃ সেই থেকেই শুরু। নারায়ণদার ছেলে বিভূতি, রতন, মানিক শত চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারেননি দাসকেবিন আর তার প্রাণময় দিনরাত্রিকে।

নারায়নদাসের শূণ্যতা, রাজনীতির পতন, মাস্তান-মাদক প্রভাবিত জেলা শহরে প্রাণ হারিয়েছিল দাসকেবিন, টিকে ছিল শুধু দোকানঘর, কাপ-পিরিচ। পাশের বটবৃক্ষটি আরও বড় হয়েছিল আরও বেশি ছায়া দিয়েছিল তবে আড্ডা ছিল না, রাজনীতি ছিল না, কবিতা ছিল না, গোয়েন্দাদের রেডবুক থেকে নামটাও উঠে গিয়েছিল।

দাসকেবিনের সোনালী যৌবনের বেঁচে থাকা অড্ডাবাজরা এখনো এর সামনে দিয়ে যায় , ফিরে তাকায় , বুকচিড়ে শুধু নেমে আসে দীর্ঘশ্বাসের ভারী পাথর । দাস কেবিন নেই, পাশের বটবৃক্ষটিও নেই।

বছর দশেক আগে, সনটা ঠিক মনে নেই, তারিখটা মনে আছে ৪ জুন। একটি একটি করে খুলে নেয়া হয়েছে দাস কেবিনের দরজা, টিন, কাঠ। অভাবের তীব্র দহনে দগ্ধ নারায়ণদার সন্তানদের বিক্রি করে দেয়া এ জমিনের নতুন মালিক গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। হারিয়ে গেছে অজস্রস্মৃতি, আমাদের স্বপ্নময় জীবনের বাতিঘরের চিহ্ণ।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test