E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এ কষ্ট ভুলবার নয়

২০২১ অক্টোবর ১১ ০৯:১২:১১
এ কষ্ট ভুলবার নয়

পীযূষ সিকদার


আফসার স্যারকে মনে পড়ছে খুব! মনে পড়ারই কথা! কারণ সে কথা দিয়েছিলেন, কানাইপুরের আমার বাড়ি ভাঙা টিনের ঘরে এসে থাকবেন। তাঁর মাকে (আমার স্ত্রী তপতি) কষ্ট দেবেন। তাঁর হাতের রান্না খাবেন। জানতেন তিনি, আমি অনেক কষ্টে দিন গুজরান করি। শতো হোক বাবাতো!

তাইতো আমার বাবাকে খুঁজছি সারা বাংলাদেশে। বাবাকে দেখিনি। মনেও নেই আমার। মনে থাকার কথাও না। কেবল ৬ মাস বয়স আমার। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের বৃদ্ধাঙ্গুলি বাবার ওপর পড়ে। বাবাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। বাবার লাশটা এখনো খুঁজে পাই নাই। তাইতো আমাদের বাবার লাশ খুঁজতে খুঁজতে পুরো বাংলাদেশই বাবার কবরভূমি হয়ে যায়।

ছোটবেলা থেকেই একটি প্রশ্ন? মা কেন অন্য মায়েদের মতো না! এখন জানি উত্তর! সময় যে চলে যায়। ১৯৮৯ সালে আমি বিএসসিতে ভর্তি হই সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে। ভেবেছিলাম ভালো ছাত্র নই। এখান থেকে এমএসসি পড়বো না। এমএসসি পড়বো জগন্নাথ কলেজে। সেই সঙ্গে অভিনয়ও করবো! বিধি বাম। 'তোমারই' নাটকের রিহার্সাল শেষে ফিরছিলাম বাড়ি। এখনো আমার কপালের ডান পাশের ক্ষত হয়ে বাজে।

আমার বড় ভাই নাটক পড়তে পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। বুদ্ধদেব ঘোষ তখনকার নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান। অধ্যাপক বৌদি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ড. বিপ্লব বালার একটি চিঠি নিয়ে খুঁজতে থাকি রহমত ভাই ও রশিদ হারুন স্যারকে। দেখি ওপরে রশিদ হারুন স্যার একা ছায়া ও সূর্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তখন তার দুজনই ছাত্র! হারুন স্যারের জিভাস্য মনে আমার জবাব নেই কোনো!

ভর্তির প্রায় সকল প্রস্তুতি শুরুর আগেই চলে এলাম আমার গ্রামে। বড় ভাই সাংবাদিক প্রবীর সিকদার সে কি রাগ! পরে জানতে পারলাম বাংলাদেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ চালু হয়েছে বাংলা বিভাগের অধীনে। গল্পকার কায়েস আহমেদের একটা চিঠির ওপরে ভর করে দাদা এবং আমি চলে আসি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেলিম স্যার দাদার চিঠিটা লুফে নিলেন। আমাকে থাকতে বলে। আমি থেকে যাই। দাদা চলে আসেন। আমার চান্স হয় না। সেলিম স্যার আমাকে ডেকে তাঁর সামনের চেয়ারে বসতে বলে। সভাপতির কাছে একটা দরখাস্ত লিখতে। আমি টানা লিখে দিলাম। আফসার স্যার আসলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সেলিম স্যার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন ওকে (ওনাকে) ধরো। আমি তাই করলাম। ১০ নম্বরের ভাইবা। আমি অ্যাটেন্ড করলাম। ড. অধ্যাপক সোমা মুমতাজ। আমাকে ফুল মার্ক দিলেন। তারপরও হয় না। আফসার স্যারের কৃপা দৃষ্টি আমার মাথায় সাহস যোগায়। ছায়া দিলেন বটবৃক্ষ। ভর্তি হতে পেরে আমার আনন্দ আর ধরে না। পীর বাবা ড. আফসার আহমদ। তাকে ভয় পেতাম। ক্লাসে গ্রীস সাহিত্য ও ভারতীও সাহিত্য নিয়ে পড়াতেন। মনে হতো আকাশ থেকে দৈব বাণী হয়ে উছলে পড়ত ভাষা। ভয় পেতাম তাঁকে। যেমন এখনো বাঘের মতো ভয় করি সে দাদা প্রবীর সিকদারকে। তাঁর চেয়েও ভয় পেতাম ড. আফসার আহমদকে। তিনি ছায়া দিতেন। আমার আদি পিতা আচার্য সেলিম আল দীন ও অনাদি আদিরও আদি পিতা ড. আফসার আহমদ।

জাবির নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমদ ও লেখক। ছবি: লেখক

এতো কিছু লিখছি! তার কারণ আমার অনাদি পিতা নেই! কষ্ট হচ্ছে খুব! কান্নাও ভুলে গেছি! বিস্ময় ভরা চোখে খুঁজতে থাকি অনাদি পিতাকে! কই গেলেন, এইতো সেদিন ফোনে কথা হলো! খুলনা যাবেন। ফিরে ১৮ অক্টোবর রাত আটটায় কথা হবে। ওই দিন আসলে আমার বই দুটোর প্রকাশনা উৎসবের তারিখ নির্ধারণ হবে। স্যার ভাবতেই পারছি না আপনি নেই! তবে ১৮ তারিখ বড় এক শূন্য একে দিয়ে গেলেন অসীম থেকে সসীমে। আমার মা বেগমজাদী ঝরনা সৈয়দ। কষ্ট পাচ্ছে। বোন কষ্ট পাচ্ছে। কষ্ট পাচ্ছে সারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিমনা মানুষজন! এ বেদনা ভোলার মতো না! স্যার নিজেই বলেছেন, এক সর্বনাশা অভিযাত্রায় ছুটে চলেছি, তাতে বেদনার ভাগ অধিক মাত্রায় আমাকে আবৃত করে রেখেছে-কৃপাহীন কঠোর লিখনলোকে।

তাঁর জন্ম ১৯৫৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার উত্তর জামশা গ্রামে। পিতা মরমী কবি ও সুফি সাধক মরহুম সৈয়দ আলী। মাতা নুরুন্নেহার সৈয়দ। বাংলা ভাষা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। মধ্য যুগের বাঙলা আথ্যান কাব্যের আলকে বাংলাদেশের নৃ-গোষ্ঠী নাট্য শীর্ষক অভিসনদরভ জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তাঁর লেখা নাটক, গান, কবিতা, উপন্যাস অমর হয়ে থাকবে। বাংলা সাহিত্যের মাহাত্ম বর্ণনায় আপনি তো অমর। উমর হয়ে থাকবেন হৃদে-হৃদে!

আমি প্রায়ই স্যারকে ফোন দিতাম। স্যার ফোনটা ধরলে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে যেতাম! ভয়ে কণ্ঠ কাঁপা কাঁপা! বলতাম স্যার আমাকে একটা চাকরি দেওয়া যায় না স্যার, স্যার বলে তথাস্থু! আমার বয়স যায় যায়! ওপার থেকে কণ্ঠ আসত দেবদূতের কণ্ঠে! বয়স যায় না।

স্যার, পিতা, বাবা, শিক্ষক যে নামেই ডাকি! যাই বলি না কেনো ঐ চরণেই ভক্তি পায়। স্যার বুঝতে পারছেন, ওই স্বর্গের সিংহ দরজা গড়গড় করে খুলে যাচ্ছে! এ কষ্ট ভুলবার নয়।

লেখক: অভিনেতা, শিক্ষক ও লেখক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test