E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার যুদ্ধ দিনের কথা

২০২২ এপ্রিল ২৪ ১৮:০৮:৪১
আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার যুদ্ধ দিনের কথা

বন্দনা সান্যাল


বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় পিতৃদেব। তাঁর সন্তান হিসেবে জন্ম গ্রহণ করায় আমরা গর্বিত। আমরা দুই বোন ও এক ভাই। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রতন কান্দি গ্রামের বীর সন্তান তিনি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণা কারীদের কাছ থেকে জানতে পারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ বিজয়ী হলে বাঙালিরা পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকদের নিপীড়ন আর বৈষম্যের শিকার হতে রক্ষা পাবে। দেশের সম্পদ দেশে থাকবে। দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক নীতিতে পরিচালিত হবে । 

সব জেনে শুনে তিনি আওয়ামীলীগ মনোনীত এমএনএ ও এমপিএ প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণা দলের সাথে কাজ করতে থাকেন। এই সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি গণপরিষদ (জাতীয় পরিষদ) পদের ১৬৭টির অধিকারী হয়ে আওয়ামীলীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানের সামরিক শাসক বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, ১লা মার্চ’৭১ ৩ মার্চের আহুত সংসদ অধিবেশন স্থগিত করায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। ৭ মার্চ’৭১ জাতির পিতা-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সহ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন।

পরবর্তীতে ২৫ মার্চ’৭১ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানী বাহিনী ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক নারকীয় গণহত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড শুরু করলে জাতির পিতা ২৬ মার্চ’৭১ প্রথম প্রহরে রাত ১২.২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও শেষ বানী প্রদান করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পর পর পাকিস্তানী হায়েনারা জাতির পিতাকে বন্দি করে প্রথমে সেনানিবাসে ও পরে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। জাতির পিতার পূর্ব ঘোষিত আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে। সাধারণ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামী দলের মনোনীত পরাজিত প্রার্থী, সমর্থকেরা ও এদেশের বিহারীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ নেয়। ডেমরা ও করঞ্জা গণ হত্যা এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ৭জন নিকট আত্মীয় হারান। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি আরো ২২ জনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যান। তিনি তখন রতন কান্দি আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। প্রথমত মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট দল তাঁকে ভর্তি করতে চান না। পরে সকলের অনুরোধে কামার পাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হন। কামার পাড়া, কুড় মাইল, মালঞ্চ, প্রতিরামপুর ও শিলিগুড়ির পানি ঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাঁর ভারতীয় প্রশিক্ষণ এফ.এফ. নং-৪৭৪২। তিনি ৭নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ভারতের পশ্চিম বঙ্গের তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে একটি গ্রুপের সদস্য হিসেবে মানিকার চর, রৌমারী হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসেন। তখন ৭নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্ণেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান। তাঁর গ্রুপের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এম এ মান্নান। তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে রাজাকারদের আলটিমেটামে জীবনের নিরাপত্তার জন্য গোটা পরিবারকেই অনেক ঝুঁকি ও কষ্টে বাড়ি-ঘর সব ফেলে ভারতের আসামের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।

গ্রুপের সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে তিনি বিভিন্ন গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার অংশগ্রহণ করা ভয়াবহ যুদ্ধ গুলোর মধ্যে (১) বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ, (২) কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশন ব্রীজ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প এ্যাম্বুস, (৩) কল্যাণপুর যুদ্ধ ও (৪) শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ অন্যতম। তিনি ছিলেন এক অকুতোভয় দুঃসাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি অসম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর নাম শুনলে পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা আঁতকে উঠতো। কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কাধে থ্রিনট-থ্রি রাইফেল ও অসম সাহসিকতার জন্য স্থানীয় লোকেরা তাঁর গ্রুপকে ‘বিচ্ছু বাহিনী’ বলে সম্বোধন করতো। রণাঙ্গনে মৃত্যু বরণ করলে তাঁর লাশ নেওয়ার লোক ছিলনা। তবুও তাঁর কোন মৃত্যু ভয় ছিলো না। তিনি “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” ধ্বনি দিয়ে পাকিস্তানি হায়েনা সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। বাংলার বাঙালির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ইতিহাস হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবার মতো স্বাধীনতা প্রিয় লোকেরা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীনের সংকল্পে ব্রতী হয়েছিলেন। সেই মহান মুক্তিযোদ্ধারা কোনো দিনই ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাবে না।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, দিনাজপুর।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test