E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বপ্নের পদ্মার সেতু: ধন্যবাদ জননেত্রী শেখ হাসিনা 

২০২২ জুন ০৯ ১৫:১৫:০২
স্বপ্নের পদ্মার সেতু: ধন্যবাদ জননেত্রী শেখ হাসিনা 

রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ


১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতুর প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই করে। সেই বছর থেকেই সেতু নির্মাণের আশা তৈরি হয়। ২০০১ সালের ০৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল স্বপ্ন নিয়ে প্রথম পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেতুর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বিএনপি-জামাত সরকার ও ১/১১ এর সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার পদ্মা সেতুর নিয়ে কাজ শুরু করে।

তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ। তারপরই মুলতঃ শুরু হয় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। বিশ্বব্যাংক প্রথমেই অভিযোগ তোলে প্রকল্পে আগাম দুর্নীতি হয়েছে। শুধু বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে কোনো ধরনের প্রমাণ না থাকা সত্বেও প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে যেন কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হয় সে জন্য বীনাদোষে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও প্রকল্প পরিচালককে। এমনকি সংশ্লিষ্ট সচিবসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানকে প্রকল্প থেকে সরে যেতে দেয়া হয় বিদেশে লোভনীয় চাকুরী ও অর্থনৈতিক প্রস্তাব।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক বাংলাদেশকে ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি সংকট উত্তরণের হাতিয়ার হিসেবে। দেখানোর চেষ্টা করেন সুশাসনের জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর। তাই বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের বিরুদ্ধে যার পাশে অন্যকোনো দেশ প্রতিবাদে এগিয়ে আসবে না। কিন্তু ভুল ভাঙিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘যেখানে একপয়সাও ছাড় হয়নি সেখানে দুর্নীতির কথা বলে ঋণ বন্ধ করে দেয়া, উন্নয়ন বন্ধ করা, অর্থাৎ আমাদের উন্নয়ন যেন আমরা করতে না পারি সেদিকে আমাদের পিছিয়ে নেয়া। এটা আমরা কি করে মেনে নেবো, এটা আমরা কখনোই মেনে নিতে পারি না। কোনো বাঙালি এটা মেনে নিতে পারবে না।’

আসল ঘটনা হলো ইউনূস তার কোম্পানিগুলো থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে এরই মধ্যে ৩ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে বন্ধুত্বের উপহার হিসেবে এই অনুদান দেখানো হলেও এর বিনিময়ে তিনি হিলারির মাধ্যমে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো শক্তিশালী জায়গা থেকে বাংলাদেশের সরকারকে হুমকি দিয়েছেন তার দুর্নীতি মামলা প্রত্যাহারের জন্য এবং বয়স না থাকলেও ড. ইউনুসকে গ্রামীন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাখতে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। মার্কিন দৈনিক ডেইলি কলার, অনুসন্ধানে এই তথ্যের সত্যতা খুঁজে পেয়েছিলো।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো হিলারি ক্লিনটন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস ও বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়ে ড: ইউনূসকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সতর্ক করে হিলারি ক্লিনটন বলেছিলেন পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্ব ব্যাংক তার ১২'শ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুত ঋণ থেকে সরে আসতে পারে।

অতঃপর কোন যাচাই বাচাই ছাড়াই বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিটি বাতিল করে দেয়। এ সময় দেশে দেশ-বিরোধী অপশক্তি ও বিদেশের ষড়যন্ত্রের খেলার চুড়ান্ত রুপ দেখে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের চাপে জাইকা, এডিবিসহ দাতাসংস্থাগুলোও সরে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার আগের বিএনপি-জামাত জোট সরকারের দূর্নীতিতে পাঁচবার দূর্নীতির চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো বাংলাদেশ। তাই শেখ হাসিনার সরকারকেও একই পরিচয় দিয়ে বিশ্বেদরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করানো হয় থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে। এই অপপ্রচারে যোগ দেয় খোঁদ নিজ দেশের আন্তর্জাতিক তকমা পাওয়া কিছু বুদ্ধিজীবী, যারা আবার তথাকথিত সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং বিশেষ বিএনপি-জামাতের মতো কিছু রাজনৈতিক দল, এবং সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগ সরকারের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ ও কলঙ্কিত করা হয়। বিএনপিসহ দেশের সুশীল সমাজ সরকারের সমালোচনায় মেতে ওঠে।

বিএনপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে যেসব টাকা দিয়েছিল, সব টাকা খেয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার কখনোই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারবে না।’ তি আরো বলেছিলেন, 'জোড়া তালি দেয়া সেতুতে উঠবেন না।' বড় সেতু তৈরী কিভাবে করতে হয় সেটা বেগম জিয়া ঠিকঠান জানেন তো! যাহোক, খালেদা জিয়া সম্ভবত বুঝে উঠতে পারেন নাই যে, শেখ হাসিনার সরকার তার সরকার নয়, আর ব্যক্তিটিও তিনি নন, ব্যক্তিটির নাম শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা।

দেশের একটি দৈনিক পরের দিন শিরোনাম করেন, 'পদ্মা সেতু হচ্ছে না!' কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর স্বপ্ন দেখা বন্ধ করেন নাই। স্বপ্ন সারথি হয়ে তিনি দেশের মানুষের পাশে দাড়ালেন। দেশের আত্মমর্যাদার সংকটের কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী। নিজেই পথ দেখিয়ে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে তুলে ধরেন কীভাবে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ সম্ভব। তিনি বলেন, ‘একই সময়ে একসাথে টাকা লাগছে না, আমাদের উন্নয়নের যে পঞ্চান্ন হাজার কোটি টাকা আছে, সেখান থেকে আমরা আমাদের কাজ শুরু করতে পারি।’ স্বপ্ন হলো সত্যি! কারো কাছে মাথানত না করে, বাংলাদেশের মতো একটা ছোট অর্থনীতির দেশের প্রধানমন্ত্রী হবার সীমাবদ্ধতার সীমানা ছাড়িয়ে, মাথাউঁচু করে লড়তে জানা বাঙালি জাতির প্রকৃত নেতার সাহস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন- কারও কাছে ভিক্ষা চেয়ে নয়, হাত পেতে নয় আমরাও যে পদ্মা সেতুর মতো এ রকম একটা বিশাল সেতু নিজস্ব অর্থায়নের নির্মাণ করবেন তিনি এবং সেই সক্ষমতা যে বাংলাদেশ অাছে তা প্রমাণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষনার পরপরই শুরু হয় নিজস্ব অর্থানে পদ্মা সেতুর কাজ।

কিন্তু তখনও ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। কানাডার আদালতে প্রকল্পের চুক্তিভিত্তিক কোম্পানি এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে একটি মামলা হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে গ্লোব অ্যান্ড মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্টারিও কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাননি।

অপর দিকে বেড়িয়ে আসতে থাকে পদ্মা সেতু ষড়যন্ত্রের মীর জাফরদের নাম। ওকাম্পোর ফাঁস হওয়া ই-মেইল এবং কূটনৈতিক বার্তায় দেখা যায় যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তত তিনবার ইমেইলে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধের জন্য বিশ্বব্যাংককে চাপ দেয়ার অনুরোধ করে লিখেছেন, ‘পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ হলে সরকার গ্রামীণ ব্যাংক প্রশ্নে নমনীয় হবে। ড. ইউনূসের এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে হিলারি বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী ও নতুন প্রেসিডেন্টকে ন্যূনতম অভিযোগ থাকলেও অর্থায়ন বন্ধ করার পরামর্শ দেন। ভাবতে অবাক লাগে, কীভাবে একজন নোবেলজয়ী নিজস্বার্থে নিজ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, দেশের মানুষকে কষ্টে রাখতে চায়। বিএনপি-জামাতের আপনজন এই চক্রের দেশপ্রেম বলে কিছুই নেই, দেশের মানুষের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। তারা শুধু সুদ, স্বার্থ ও টাকাই চিনে। দেশ ও জাতির কথা কখনোই ভাবে না।

যাহোক, সেই বছরই অর্থাৎ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসিয়ে উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানে শেখ হাসিনার শ্রেষ্ঠত্ব বিদেশিদের চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। আর তাঁর নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা দেশের মানুষের কাছে সকল সময়ের সব সীমা অতিক্রম করে যায়। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা নিজ আত্নবিশ্বাসে, দেশের নিজস্ব অর্থায়নের নিজেদের পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত করেছেন। যা আগামী ২৫ শে জুন'২০২২ ইং তারিখে উদ্ভোদন হতে যাচ্ছে। দেশী বিদেশের সকল ষড়যন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রমাণ করেছেন, আমরা বীরের জাতি, আমরা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। দরকার শুধু দেশপ্রেম, সাহস, ইচ্ছা, সততা, এবং সময়পোযোগী সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের সক্ষমতা সম্পুর্ণ নেতৃত্বের।

এবার, পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ বাতিল করা বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এর সমীক্ষা ও জরিপ বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে পদ্মা সেতু থেকে। আর এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) জরিপ বলছে, দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১.২ শতাংশ আর পদ্মা সেতুতে রেল চলাচল শুরু করলে প্রবৃদ্ধি হবে প্রায় ২ শতাংশ। এই সংস্থার গবেষণা মতে সেতুর বিনিয়োগ রিটার্ন উঠে আসবে বছরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ এবং বছরে দারিদ্র্য কমবে ২.৯ শতাংশ। গড়ে ১০০ কিমি দূরত্ব কমবে রাজধানীর সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের। এই সেতু দিয়ে একদিকে সমুদ্রপথের নতুন দ্বার পায়রা বন্দরের সঙ্গে ঢাকার অপরদিকে এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সরাসরি সংযুক্ত করবে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো নতুন শিল্পকারখানা, উঁকি দিচ্ছে শিল্প বিপ্লবের নতুন সম্ভাবনা। কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবে প্রায় দুই কোটি মানুষ।

পরিশেষে, সংসদে পদ্মা সেতু নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা বক্তব্যটি পাঠকদের স্বরণ করে দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন, "আমার দক্ষিন অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেলবে, অন্তত আমি শেখ হাসিনা জাতির পিতার কন্যা থাকতে সেটা আমি হতে দেবো না। জানি এই জন্য হয়তো আমাকে আমার পিতার মতো জীবন দিতেও হতে পারে, তবুও আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও পিছু হটবো না।"

তিনি পিছপা হননি, তাই আজ মাথাউঁচু করে বাঁচতে শিখেছে বাংলাদেশ। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে আরও এক বিস্ময়! বিদেশি কোনো দেশ বা দাতাসংস্থার সাহায্য ছাড়া বিশ্ব রেকর্ডসহ বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ও অনন্য বৈশিষ্ট সম্পন্ন সেতু বানিয়েছে বাংলাদেশ! বাংলাদেশ এখন সাফল্যের প্রতীক, সামর্থ্যের প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক সম্মানের প্রতীক। এ এক অসম্ভব সাফল্য, যা অনেকের কাছে অকল্পনীয় আবার অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। আর এই পদ্মা সেতুর সব সাফল্যের একমাত্র কৃতিত্বের দাবিদার আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার। যিনি কথা দিয়েছিলেন, কথা রেখেছেন। স্ব গৌরবে সম্মানিত করেছেন দেশ ও জাতিকে। আপনকে স্যালুট গণমানুষের নেত্রী। ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

লেখক : সাংবাদিক।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test