E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিক্ষক নির্যাতনের শেষ কোথায়?

২০২২ জুলাই ১৭ ১৬:৩৫:১৪
শিক্ষক নির্যাতনের শেষ কোথায়?

প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার 


দেশে শিক্ষক লাঞ্ছনা যেন শেষ হচ্ছে না বরং দিন দিন বেড়েই চলছে এ নির্যাতন। বেশ কয়েকদিন থেমে থাকার পর যখন আমরা ভুলতে শুরু করি তখন আবার নতুন আরেকটি ঘটনার জন্ম হচ্ছে। সাভারের ঘটনার পর আমরা যখন স্তব্দ হয়ে যাই তার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার রাজশাহীতে এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাজবাড়ী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে চড়-থাপ্পর, কিল-ঘুষি এবং হকিস্টিক দিয়ে পেটানোর অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে মার খাওয়ার পরও চাপে রয়েছেন এ শিক্ষক। মার খাওয়ার পরের দিন এমপি শিক্ষককে নিয়ে যান তার কার্যালয়ে। সেখানে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে শিক্ষককের মুখ থেকে বের করে নেন ‘ এমপি ওমর ফারুকের কোনো দোষ নেই।’ শিক্ষকদের সাথে বিচিত্র সব কান্ড ঘটছে সমাজ ব্যবস্থা। মনে প্রশ্ন জাগে এতসব নির্যাতনের পরও শিক্ষক সমাজ নিরব কেন ? যেখানে এসব এমপিরা দেশের মানুষকে ভালো রাখার জন্য আইন প্রনয়ণ করার কথা সেখানে আইন এভাবে হাতে তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করা কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না।

রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা যেখানে বলে বেড়াচ্ছেন শিক্ষা ব্যবস্থার সাফল্য সবোর্চ্চ সেখানে প্রশ্ন জাগে এই কি তার নমূনা ? এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন হাতেগুনা যে কয়েকজন শিক্ষার্থী দেখে তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এখন পর্যন্ত যেসব এমপি এসব কান্ড ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি। এর ফলে এমপিরা শিক্ষক পেটানোর মহোৎসবেই নেমেছে বলে মনে হয়। সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত কত সব পরিবর্তন ঘটছে ? কি শেখার কথা কি শিখছি ? কি দেখার কথা আর কি দেখছি ? শিক্ষক শিক্ষর্থীদের মাঝে বিরাজ করতো অভিভাবক ও বন্ধুত্ব সুলভ সম্পর্ক। আজ বদলে যেতে শুরু করেছে আচরণ এমনকি তৈরি হচ্ছে বৈরিতা। মাইকে গলা ফাঁটিয়ে আওয়াজ তুলছি শিক্ষা হলো শ্রেষ্ঠ সম্পদ শিক্ষক হলো জাতি গড়ার কারিগর। এসব বক্তব্য শুনে এখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে। কাঁদতে চাইলেও কাঁদা যায় না। জাতির আগামী দিনগুলো আমরা কিভাবে দেখবো। শিক্ষা ব্যবস্থায় দিনের পর দিন পরিবর্তন করছি আধুনিক করছি শিক্ষা কারিকুলাম। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা অর্জনের প্রক্রিয়াটায় কি পরিবর্তন ঘটছে তা কি আমরা খতিয়ে দেখছি?

কেবলমাত্র জিপিএ অর্জন আর চাকুরির পিছনে চলতে চলতে আমরা অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বনাতে এত ব্যস্ত হয়েছি যে সন্তানকে মানুষ বানাতেই ভুলে যাচ্ছি। ভুলে যাচ্ছি সামাজিকতা সভ্যতা আর সংস্কৃতি। মুখে বলছি শিক্ষক হচ্ছে সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ তার বিপরীতে আমরা কিসব কান্ড ঘটাচ্ছি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা আমাদের বিবেক কে কাঁপিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে আজ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। আমরা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কিভাবে কি শিখাচ্ছি ? হাজারো প্রশ্নের সম্মুখিন হলেও উত্তর মিলছে না। উত্তর মেলার কথাও নয় কারন আম গাছে কখনও জাম হয় না। যেভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে তা থেকে সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা অর্জিত হওয়ার সুযোগ নেই। যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে তা শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষা হচ্ছে এটা বলার অবকাশ রাখে না। যে লোকটা আওয়াজ করছে শিক্ষক হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সে লোকটাও তার সন্তানকে শিক্ষক হিসেবে দেখতে চায় না। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিকট ভবিষৎত নিয়ে প্রশ্ন করলে শিক্ষক হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছে না শিক্ষার্থীরা।

প্রশ্ন হলো সমস্যা কোথায় বা এর জন্য দায়ী কে ? নির্দিষ্ট ভাবে কেবলমাত্র শিক্ষা পদ্ধতিকে দায়ী করা যায় না। সমাজ ব্যবস্থা শিক্ষক শিক্ষার্থী রাষ্ট্রযন্ত্র সকলের কারনেই আজ বারোটা বেজেছে শিক্ষা ব্যবস্থার। তাই উত্তোলন ঘটাতে হলেও সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমেই করতে হবে। সম্প্রতি সাভার আশুলিয়া হাজী ইউনুছ আলী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করে তার প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্র অন্যদিকে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে গলায় জুতার মালা পড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে শিক্ষককে কানে ধরে উঠ বস করানো, মাফ চাওয়ানো, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অজুহাতে হেনস্তা করা, চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা ও অপমান করার মতো বিষয়গুলো এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন এবং সদস্যদের অত্যাচার এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নরকে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সভাপতি নির্বাচন থেকে আমরা এখন সরে আসতে পারিনি।

সাভারে ঘটে যাওয়া বিষয়ের দিকে একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমানে ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়া মারফত জানা যায় ওই শিক্ষক প্রতিষ্ঠানের আইনশৃংঙ্খলা কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের আইন শৃংঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে দিতে হলো নিজের জীবন। পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী জিতু প্রেমিকার নিকট হিরোইজম দেখানোর জন্য নাকি এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আশরাফুল ইসলাম জিতু নামের ছাত্রকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয় । প্রশ্ন হলো জিতু কিভাবে এবং কেন তৈরি হচ্ছে ? জিতুর শাস্তি হলেই সমাধান হয়ে যাবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। প্রতিনিয়ত সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারনে জন্ম নিচ্ছে হাজারো জিতু। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মাঝে গ্রপিংও এর জন্য কম দায়ী নয়। স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয়ে তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। এই কিশোর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অস্থিতিশীল করে রাখছে। এদের স্থানীয় রাজনৈতিক সাপোর্ট একটি ওপেন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে অপকর্ম করে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এসব শিক্ষার্থী। সম্প্রতি করোনাকালে এসব শিক্ষার্থীদের হাতে এসেছে দামী এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট।

এসব সেট অপকর্ম করার একটি বিস্বস্ত মাধ্যম হিসেবে দেখা যাচ্ছে কারন এর অপব্যবহারই আমরা বেশি করছি। কিন্তু এসব অপকর্মের পিছনে কেবল কি শিক্ষার্থীরা দায়ী ? প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণের পর বের হয়ে আসে যেসব তথ্য তা আরো ভয়ানক। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নড়াইলের অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর সামনে। যে শিক্ষকের গলায় উঠার কথা ফুলের মালা। এই শিক্ষকের শারীরিক মরণ না হলেও একপ্রকার মৃত্যুই ঘটেছে শিক্ষক সমাজের ও শিক্ষা ব্যবস্থার। জানা যায় প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে নিয়োগ দ্বন্ধ ঘায়েল করতে না পেরে সাম্প্রদায়িকতায় আবরণে যুক্ত করা হয়েছে। লজ্জায় পলায়ণ করেছেন এই অধ্যক্ষ। কিন্তু প্রশ্ন হলো এভাবে পলায়ণ করেই কি লজ্জা নিবারণ করা গেছে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এসব ঘটনার কারন অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কিংবা সহকারীদের দ্বন্ধ, নিয়োগ বাণিজ্য, পদের লোভ, প্রতিষ্ঠানের অর্থের ভাগবাটোয়ারা, স্থানীয় প্রভাবশালীদের কর্তৃত্বের বিষয়গুলোই চলে আসবে। এসব ঘটনাগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছে তা স্বীকার না করে উপায় নেই।

এসব বিষয় কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানকে অস্থিতিশীল করছে না ভালো শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আসতে বাঁধা তৈরি করছে। শিক্ষকতা পেশাকে সম্মান এবং শান্তিতে কর্ম সম্পাদনের পেশা হিসেবে ধরা হলেও এসব অস্থিতিশীলতার কারনে অনেক মেধাবীরাই এখানে আসার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তবে এসব সমস্যার বাইরেও যে বিষয়টি চিহিৃত করা যায় তা আরো জটিল। বেশ কয়েকটি ঘটনার সাথে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধও পাওয়া যায়। কাউকে কোন ভাবে ঘায়েল করতে না পারলে তাকে সাম্প্রদায়িকতার দোষে দোষী করে দাও। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি নাম সামনে এসেছে যা থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। শ্যামল কান্তি, হৃদয় মন্ডল, অমোদিনী পাল, স্বপন কুমার বিশ্বাস, সঞ্জয় সরকার, উমেষ রায়, উৎপল কুমার সরকার। ঘটনা বিশ্লেষণ দেখা যাবে যে বেশির ভাগ নামই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। প্রশ্ন হলো নামগুলি এরকম কেন হচ্ছে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নাহলে এগুলির মূলে প্রবেশ করা যাবে না। আর মূলে প্রবেশ না করতে পারলে সমাধানও আশা করা যায় না। তাহলে দেখা যাবে স্বাভাবিকভাবেই এসব নিয়ে বেশ কয়েকদিন চলবে আন্দোলন আর আলোচনা। সমস্যা সমাধানতো হবেই না বিপরীতে সমস্যা আরো ঘনীভূত হবে। এটা কি কেবলই বিশেষ কোন শ্রেণিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত নাকি সঠিক সময়ে সঠিক বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি। যেভাবেই প্রশ্ন করি বা বিশ্লেষণ করি না কেন তাতে কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার অশনি সংকেতই পাচ্ছি। এথেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কেবল বিশেষ কোন শ্রেণিই নষ্ট হবে না ক্ষতি হবে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিষ্ঠান প্রধান, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষমতা কমিটির হাতে রেখে দেওয়া এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোকদের দিয়ে কমিটি করা বন্ধ না করতে পারলে এ থেকে বেরিয়ে আসা কষ্টকর।

লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test