E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাদককে ‘না’ বলি, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি

২০২২ আগস্ট ০৬ ১৬:০৫:৫১
মাদককে ‘না’ বলি, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি

মোহাম্মদ ইলিয়াস


তরুণরাই দেশ, জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র, জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে জাতির মূল চালিকাশক্তি হলো তরুণরাই। তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশ-জাতিকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে টেনে নেয়ার বিরাট ভূমিকা রাখে এবং রেখে আসছে যুগে যুগে। তবে আমাদের দেশের তরুণ ও যুব সমাজের একাংশ নানাভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে মরণ নেশা মাদকের সঙ্গে। এ নেশা এমনই এক নেশা ধীরে ধীরে বিবর্ণ করে দিচ্ছে আমাদের সবুজ তারুণ্যকে। নষ্ট করে দিচ্ছে দেশের ভবিষ্যত। আমাদের দেশের রয়েছে পর্যাপ্ত তারুণ্যনির্ভর জনশক্তি। দেশের এ মূল্যবান সম্পদ মাদকের চোরাচালান ও অপব্যবহারের কবলে পড়ে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। নেশার ছোবলে পড়ে এ যুবসমাজ কর্মশক্তি, সেবার মনোভাব ও সৃজনশীলতা হারিয়ে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করছে। 

দেশ গড়ার কারিগর সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মাদক। মাদকের কারণেই বুক ফাটা কান্নায় পৃথিবীর আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়। রাতের অন্ধকার আরও নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে পরিবারগুলোতে। এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। কোন কোন সংস্থার মতে ৭০ লাখ। নব্বইয়ের দশকে যার পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১০ লাখেরও কম এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবাতে আসক্ত। সম্প্রতি ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ যুবসমাজকে গ্রাস করেছে।

প্রতিদিন যেমন ইয়াবা ধরা হচ্ছে তেমনি প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে। আমাদের তরুণরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তরুণদের সঙ্গে তুলনা করলে কোন অংশেই মেধা, মনন ও উন্নত চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে কম নয়। এক কথায় নিজ দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ভাল অবস্থান দখল করে আছে; তথ্যপ্রযুক্তিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও নতুন নতুন আবিষ্কার করে চমকে দিচ্ছে বিশ্বকে। আর আমাদের এসব অগ্রগতি-গৌরবকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে কতিপয় দেশ পেছনে লেগে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব দেশ বিভিন্ন অপকৌশলে আমাদের তরুণ সমাজের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে এমন কিছু মারাত্মক ক্ষতিকর অপসংস্কৃতি যা আমাদের সন্তানদের মেধাকে ধ্বংস করে বিপথগামী করার পাশাপাশি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে নামে বেনামে মাদককেই প্রথম সারির একটি বলতে হবে।

বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্যের কারণে অপরাধ বাড়ছে। তাই অপরাধ হ্রাস করতে হলে অবশ্যই মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। অন্যথায় দিন দিন অপরাধ বাড়তে থাকবে।

বাংলাদেশের মাদক ব্যবসা ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকছেও বেশি। এই ভয়াল মাদক তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালবাসা, পারিবারিক বন্ধন। কয়েক বছর পূর্বে ঢাকার উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার একমাত্র মেয়ে ঐশী মাদকে আসক্ত হয়ে বাবা মাকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি। সন্তান শুধু মাদকে আসক্ত হওয়ার কারণেই জীবন দিতে হয়েছে নিজ সন্তানের হাতে বাবা মাকে।

ইয়াবায় আসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছেন। নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন করছেন। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। তরুণ প্রজন্মই মাদক ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমি মনে করি। তারাই পারবে দেশকে মাদকমুক্ত করতে। এজন্য তরুণ-যুবকদের শুধু মাদকবিরোধী কার্র্যাবলীতে অংশ নিলেই চলবে না, বরং প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মাদকের পাচার রোধ ও এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিসংঘের মাদকবিরোধী সংস্থা ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী দিবস পালন করে আসছে।

এ সংস্থাটি ‘বিশ্বব্যাপী মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা’ কার্যক্রম চালু করেছে। মিডিয়াকে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকা- ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রাখা প্রয়োজন সীমান্তে মাদক-চোরাচালান রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ, আমাদের দেশ মাদক-চোরাচালানের রুটগুলোর মাঝামাঝি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর যথাযথ প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা গেলে মাদকের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। মাদক-ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকাসক্ত অভ্যাস নির্মূলের জন্য যুব সমাজের একটি সিদ্ধান্ত যথেষ্ট। যুব সমাজের একটি দৃপ্ত শপথই পারে তাদের মাদকের অন্ধকার থেকে ফেরাতে। মাদকাসক্ত হয়ে পৃথিবীতে কেউ কিছুই করতে পারেনি নিজেকে ধ্বংস ছাড়া।

বিশ্বায়নের যে কয়টি উপসর্গ ঘৃণিত ও কলঙ্কিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম, সব অপরাধের জনক মাদক। এটি চুরি, ডাকাতি, খুন ও যৌন হয়রানির মতো অপরাধের নেপথ্যের অন্যতম কারণ। ছিনতাই কিংবা খুনের ঘটনা মাদকাসক্ত লোকের মাধ্যমে ঘটছে- এমন নজির বহু রয়েছে। মাদক নির্মূল না করতে পারলে, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। কেননা অধিকাংশ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের পেছনে রয়েছে মাদকের কালো থাবা। মাদকাসক্তদের মধ্যে ছাত্র, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, রিকশাচালক ও অন্যান্য পেশার মানুষও রয়েছে। বাদ যাচ্ছে না নারীরাও। এক সমীক্ষায় জানা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ মাদকাসক্তের বয়স ১৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের মূল চালিকাশক্তি তরুণদের একটি বিরাট অংশ মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে; যা দেশের প্রগতি ও সমৃদ্ধির অন্তরায়।

মাদকাসক্তি বলতে মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশাকে বোঝায়। যেসব দ্রব্য সেবন করলে আসক্তির সৃষ্টি হয়, জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ও স্মৃতিশক্তি কমে যায় সেগুলো মাদকদ্রব্য। ব্যাপক অর্থে, যে দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উলেস্নখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং ওই দ্রব্যের প্রতি নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমেই বাড়তে থাকে এমন দ্রব্যকে মাদকদ্রব্য বলে। ব্যক্তির এ অবস্থানকে বলে মাদকাসক্তি। মাদকদ্রব্য আসলে কি কি তার নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নাম বলা সম্ভব নয়। মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদকদ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে কোনো মাধ্যম। বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে- সিগারেট, বিড়ি, তামাক, তাড়ি, গাঁজা, হিরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, মরফিন, মদ, বিয়ার, কেটামিন ইত্যাদি।

মাদকের সঙ্গে অপরাধ ও অপরাধীর একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত মাদকসেবীরা মাদক সংগ্রহের জন্য অর্থের ওপর নির্ভর করে। আর এই অর্থ জোগাড় করতেই ছিনতাই এমনকি খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না তারা। কিছু গবেষণায় দেখে গেছে, মাদকদ্রব্যের ব্যবহারের ফলে মানুষের মধ্যে অপরাধ করার সাহস বেড়ে যায়। বায়োলজিক্যাল তাত্ত্বিক ও গবেষকরা এটিকে 'মাদকের প্রতিক্রিয়া' বা 'ফার্মোকোলোজিকাল ইফেক্ট' বলে অভিহিত করেছেন। এর ফলে একজন ব্যক্তি যখন মাদক ব্যবহার করেন তখন মাদকের প্রতিক্রিয়ায় তার ভেতর সাহস বেড়ে যায় এবং সে তখন অপরাধ করতে ভয় পায় না। আর এ কারণে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে হত্যা, মাকে জবাই করা, নেশাখোর বাবা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন, কিংবা আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার মতো সব অমানবিক ঘটনা।

খোদ রাজধানীতেই মাদকসেবী মেয়ের হাতে পুলিশ অফিসার বাবা ও মা খুনের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়। অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন- ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্যের কারণে অপরাধ বাড়ছে। তাই অপরাধ হ্রাস করতে হলে অবশ্যই মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। অন্যথায় দিন দিন অপরাধ বাড়তে থাকবে। একজন মানুষ মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়, অবরুদ্ধ হয়ে যায় বিবেক, যার ফলে মাদকাসক্ত ব্যক্তির দ্বারা যে কোনো ধরনের অপরাধ মুহূর্তের মধ্যেই সংঘটিত হয়ে যায় কোনো অনুশোচনা ছাড়াই।

ইউনাইটেড নেশনস অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) বলেছে- মাদক গ্রহণের ফলে সাময়িক স্বস্তি পাওয়া গেলেও এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ফাঁদ। এ ফাঁদে একবার জড়ালে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, সৃজনীশক্তি শেষ হয়ে যায়। সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি ধীরে ধীরে শুরু হয়। অনেক কিশোর-কিশোরী কৌতূহল বা আনন্দের বসে কিংবা কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাদকসেবন করে থাকে। মাদকের নেশায় একপর্যায়ে তারা মদে আসক্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ কোনো পার্টিতে, অনুষ্ঠানে, বন্ধু-বান্ধবীর জন্মদিনে মদ পান করে। এছাড়া মাদকাসক্তির নানাবিধ কারণ রয়েছে- মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, স্মার্ট হওয়া সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব, কর্মবিমুখতা ও ভ্রান্ত জীবনদর্শন, অপসংস্কৃতি, ভালোবাসার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা উত্তীর্ণ না হতে পারা ইত্যাদি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে- পৃথিবীতে প্রতি ৮ সেকেন্ডে শুধু ধূমপানজনিত কারণে একজন ব্যক্তির মৃতু্য হচ্ছে। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসসংক্রান্ত সমস্যা, ফুসফুস ও গলায় ক্যান্সার হতে পারে। মদ বা অ্যালকোহল আসক্ত হয়ে পড়লে ব্যক্তির ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা কমে যায়। যারা বহুদিন ধরে সিগারেট বা তামাক সেবন করে তাদের ফুসফুস এবং শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয়। অর্থিকভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নেশার টাকা জোগাতে গিয়ে সংসারে অভাব ও অশান্তির সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তির চলাফেরায় অসংলগ্নতা প্রকাশ পায়, মনোযোগের ক্ষমতা হ্রাস পায়, ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, বস্নাড প্রেসার বৃদ্ধি পায়, চামড়ায় ফুসকুড়ি দেখা যায়, স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা যায়, খাদ্য গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়, ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কমে যায়, যৌন অনুভূতি কমে যায়, মস্তিষ্কে কোষের ক্ষয়ক্ষতি হয়। মাদকের নেশা এমনই এক নেশা যা একটি সুন্দর জীবনকে নষ্ট করে দেয়। তরুণরাই দেশ, জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র, জাতির আগামীদিনের কর্ণধার। কিন্তু তারাই যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তাহলে দেশ কি করে সমৃদ্ধির দিকে এগোবে! মনে রাখতে হবে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়া ছেলে মেয়েরা আর কেউ নয়, আমাদের ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন এবং সমাজেরই অংশ।

মাদকাসক্তি যেহেতু কোনো অপরাধ নয়, একটি রোগ। সেহেতু তারা অপরাধী নয়, রোগী। ভুল সঙ্গের ফাঁদে পড়ে মাদকে আসক্ত হয়ে যাওয়া এই ছেলেমেয়েদের আমরা এ মরণনেশা ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান করা তো দূরের কথা, উল্টো তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় আচরণে বুঝিয়ে দিই যে, এরা নিকৃষ্ট ব্যক্তি, সমাজে এদের স্থান নেই, এদের প্রতি শুধুই ঘৃণা। ফলে আসক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা মানুষও নিজেদের সংশোধন করতে সক্ষম হয় না। হয়ে ওঠে আরও বেপরোয়া আরও উচ্ছৃঙ্খল। এটি যেহেতু সামাজিক ব্যাধি তাই এ সমস্যা সমাধানের উপায় আমাদেরই বের করতে হবে। মাদক নিরাময়ে চাই পরিবারের আন্তরিকতা ও পারস্পরিক ভালোবাসা। সন্তান তার পরিবারের পরিবেশ দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়। তাই পারিবারিক পরিবেশ হতে হবে ধূমপানমুক্ত।

পিতামাতাকে অবশ্যই তাদের সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তাদের কার্যকলাপ ও তারা কাদের সঙ্গে চলাফেরা করে, কোথায় যায় এসব ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে হবে। সর্বোপরি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে পরিবারের কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তাকে সেই অবস্থা থেকে বের করে আনার সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। প্রয়োজনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। মাদক এক ভয়াবহ ব্যাধি। এটি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদক ব্যবসা, চোরাচালানের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে। মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে নিয়মিত সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।

এছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ, ছাত্রদের কাছে শিক্ষক আদর্শস্বরূপ। শিক্ষকদের আদেশ-উপদেশ তারা রাখে। সাংস্কৃতিক-বিনোদন ও খেলাধুলার পরিবেশ সৃষ্টিসহ স্কুল-কলেজের মাঠগুলোকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া অপরিহার্য। আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশে সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, কৃষ্টি-কালচার চর্চার প্রতিবন্ধক হিসেবে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদক বিরাজ করছে। আসুন, মাদকের ভয়াবহতা রোধে আজই শপথ গ্রহণ করি। এই মরণব্যাধির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আওয়াজ তুলি- 'মাদককে না বলি, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সমাজ গড়ি'।

লেখক :সহকারী অধ্যাপক ও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test