E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

বিশ্ব মিডিয়া ও রাষ্ট্র নায়কদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

২০২২ আগস্ট ১৬ ১৫:১৭:২৫
বিশ্ব মিডিয়া ও রাষ্ট্র নায়কদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

মোহাম্মদ ইলিয়াস


পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন নেতা থাকেন যেমন রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) লেনিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাওসেতুং, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ভিয়েতনামের হো-চি মিন, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো, ঘানার পেট্রিস লুমাম্বা ও কওমী নক্রুমা, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর অসামান্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের চিরঞ্জীব উদাহরণের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি শুধু বাঙালির বঙ্গবন্ধু নয়, বিশ্ববরেণ্য ও বিশ্বনন্দিত এক রাজনীতিবিদ।

বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্য সাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এই বাংলাতে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু দুর্বার এক উন্মাদনায় কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধি দয়েছে, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা কোনদিন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের এক সম্মোহনী শক্তি ও যাদুস্পর্শে বাঙালিদের জাগিয়ে তুলে উদ্দীপ্ত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে।

১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই প্রতিবেদনে তাকে অভিহিত করা হয় 'রাজনীতির কবি' হিসেবে। তবে সেদিন যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মতে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণ কোনো ভাষণ নয়, বরং একজন দক্ষ, সুনিপুণ কবির ছন্দময় কবিতা। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য বিতরণ করা হয়েছিল। তবে সেদিন বাংলায় কবির মতো বক্তব্য রাখলেও বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ‘রাজনীতির কবি’ এর মতো একটি সুন্দর উপাধিতে ভূষিত করে নিউজউইক ম্যাগাজিন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ম্যাগাজিনটি তাদের প্রচ্ছদজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে লিড নিউজে তাঁকে অভিহিত করে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যই তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়।

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসটি শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেই নয় বরং সামগ্রিকভাবে আমাদের জাতীয় জীবনেও একটি ভয়ঙ্কর বেদনার মাস। বিগত সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কীভাবে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের প্রেক্ষাপটে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নির্মমভাবে কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিবরণ এখন পৃথিবীর সবাই জানে এবং এখন তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেই থেকে আগস্ট মাস আমাদের কাছে, বাঙালি জাতির কাছে শোকের মাস।

নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের কাছে সারা বছরের মধ্যে আগস্ট মাসের মতো এমন ভয়ঙ্কর মাস আর নেই। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের ২১ তারিখ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপরে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, যে হামলায় শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছিলেন কমপক্ষে ২৫ জন হতভাগ্য মানুষ। সে আরেক মর্মস্পর্শী হৃদয়বিদারক ইতিহাস।

একাত্তরে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এসব দুঃস্বপ্নময় মর্মান্তিক ঘটনার বিবরণ রক্তাক্ষরে লেখা আছে বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায়। স্মরণ করা যেতে পারে, বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার এক দিন পরে ১২ জানুয়ারি তিনি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করেন। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রণীত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান। এরপর থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশেকে একটি সম্ভাবনাময় সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু আত্মনিয়োগ করেন।

কিন্তু কিছুদিন পর থেকে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী, সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতা, অসৎ ব্যবসায়ী এবং সেইসঙ্গে কিছু বিপথগামী সামরিক কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের ইন্ধনে এক অনাকাক্সিক্ষত ভয়াবহ সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে। এবং তার ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেষ রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে নিহত হন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সময়ের হিসাবে এই সামান্য কয়েকটি বছরে বঙ্গবন্ধুর যে অসাধারণ কর্মতৎপরতার পরিচয় আমরা পাই তাতে তার অনন্যসাধারণ রাষ্ট্রনায়ক সুলভ প্রতিভা এবং দক্ষতার স্বাক্ষর রয়েছে।

পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত নানা পত্রপত্রিকা এবং সে সঙ্গে পাওয়া যায় আরও অনেক অজানা তথ্যাদি যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ এবং জাতির পিতার বিরুদ্ধে সবার চোখের আড়ালে বিভিন্ন সময় তৈরি হওয়া নানা ধরনের নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের খতিয়ান।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত শাসনামলে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যাদি, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএসহ অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থার গোপন দলিলপত্র, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছেন এমন কিছু ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার। বিদেশি বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপস্থাপিত এবং পর্যালোচনা করা গেলে তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সহজেই অনুধাবন করা যায়।

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ধারণা করা যায়, বঙ্গবন্ধু এসব ষড়যন্ত্রের কিছুটা হলেও জানতেন, কিন্তু বিশ্বাস করতেন না। আর হয়তো সে জন্যই অসীম সাহসের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে জানা-অজানা ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তিনি বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন।

‘মুজিবই উপমহাদেশের একমাত্র রাজনীতিক, যার বিচার হয়েছিল এমন অভিযোগে, যার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। একবার নয়, দুবার। প্রথমবার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তখন পশ্চিম পাকিস্তানের গোপন বিচারে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। কনডেম সেলের সামনে শেখ মুজিবকে দেখিয়ে কবর খোঁড়া হয়। তখন দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র খবর ছিল না বঙ্গবন্ধুর কাছে। সেই মুহূর্তেও পাকিস্তানিদের আপস প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বুক চিতিয়ে বলেছিলেন, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, যারা একবার মরে, দুইবার মরে না।’

বঙ্গবন্ধুর এই অসাধারণ সাহসের উৎস কী? কীভাবেই বা ৪৬৮২ দিন কারাভোগ করলেন, দু-দুবার ফাঁসির মঞ্চে গেলেন?

১৯৭২ সালে এক বিদেশি সাংবাদিকের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ তার লক্ষ্যের জন্য কষ্ট করতে পারে। আমি আমার জনগণের জন্য কষ্ট করেছি, আমার বাংলাদেশের জন্য দুঃখ সয়েছি। আমার জনগণ আমাকে ভালোবাসে, আমি তা জানি, আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, আমরা তাকে আল্লাহ বলি। তিনি যেন আমাকে এই কষ্ট সহ্য করার শক্তি দেন, তিনি মহান।’

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাম কেমন করে বাংলাদেশ হলো সে সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধুর চমৎকার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থ আর সে সময়ে প্রকাশিত নানা পত্র-পত্রিকাসহ বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বিভিন্ন সময়ের ভাষণ থেকে।

‘বাংলাদেশ’ নামকরণের ব্যাখ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে ‘বাংলা’, এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে ‘দেশ’। এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়। ওইদিন ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা। বঙ্গবন্ধু সেই সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীদের জিজ্ঞেস করেন, এই ভূখণ্ড স্বাধীন হওয়ার পর নাম কী হবে? উপস্থিত নেতারা এ অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব করেন ‘বাংলাদেশ’। পরে ‘বাংলাদেশ’ নামটি সবাই এক বাক্যে মেনে নিলে বঙ্গবন্ধু ওই সভায় এই অঞ্চলের নাম ঘোষণা দেন ‘বাংলাদেশ’।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের সংক্ষিপ্ত সময়কালকে তাঁর নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম অনুসরণ করে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে যেমনÑ ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, দেশে ফিরেই জনগণের হাতে ক্ষমতা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ, দ্রুততম সময়ে মিত্রবাহিনীর সেনা প্রত্যাহার, শরণার্থী পুনর্বাসনে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন, ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ত্রাণ কর্মসূচি গ্রহণ, কৃষি ও কৃষকের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে জাতিকে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা, মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়কালে দেশ পুনর্গঠনের প্রথম ধাপ সম্পন্ন, ১৫ মাসেই প্রশাসন পুনর্গঠন, নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, জনগণের জন্য পৌর স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ, সামাজিক সুবিচার। টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করা, ব্যাংক খাত পুনর্গঠন, স্বয়ম্ভর অর্থনীতির ভিত প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, জাতি গঠনে গণমুখী শিক্ষার প্রবর্তন, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি। এসব কার্যক্রম বঙ্গবন্ধুর সর্বতোমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে শুরুতেই বঙ্গবন্ধু পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। এই পুনর্বাসন কর্মসূচি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ এইচটি ইমাম বলেছেন, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যার মুখে উদ্বাস্তু ও স্থানচ্যুত হয় দুই কোটি বাঙালি। পাকিস্তানি বাহিনী পুড়িয়ে দেয় প্রায় ৪৩ লাখ বসতবাড়ি, ৩ হাজার অফিস ভবন, ২৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ১৯ হাজার হাট-বাজার। ফলে কৃষি উপকরণ ও পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন প্রায় ২২ লাখ কৃষক। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পুনর্বাসন কর্মসূচির অভাবনীয় সাফল্যে বেঁচে যায় কয়েক লাখ প্রাণ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এবং এই অসামান্য সাফল্য সে সময়ে বিস্মিত করেছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞদের। ১৯৭২ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্যের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যে পরিস্থিতিতে শেখ মুজিব দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন, সেই পরিস্থিতি তিনি যেভাবে আয়ত্তে এনেছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।’

সে সময়ের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টন খাদ্যশস্য, এক লাখ টন সিমেন্ট, ৫০ হাজার টন ঢেউটিন ও কাঠ এবং এক লাখ টন ওষুধ প্রয়োজন ছিল। আপন ব্যক্তিত্বের অসাধারণ ক্ষমতা এবং শক্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে তখন ঋণ এবং সাহায্য সংগ্রহ করে এই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবে খুব কম সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা।

এরপর তিনি দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। সময় চেয়েছিলেন মাত্র তিন বছর। একেবারে শুরু থেকে দেশ পুনর্গঠন ও সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ শুরু করতে হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং সেখান থেকে মাত্র ১৫ মাসের মধ্যেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন কর্মসূচিরর প্রথম ধাপ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।

বাহাত্তরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পয়সা নাই, চাল নাই, ডাল নাই, রাস্তা নাই, রেলপথ ভেঙে দিয়ে গেছে, ফেরাউনের দল সব শেষ করে দিয়ে গেছে। এই মানুষ এবং তাদের শক্তি দিয়েই আমি বাংলাকে পুনরায় নতুন করে গড়ে তুলতে চাই।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই স্পষ্ট হয় তখনকার বাস্তবতায় দেশের সার্বিক অবস্থা কেমন ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠনের চেয়েও কঠিন কাজ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ সম্পন্ন করা। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের বিশালতা ও গভীর দূরদৃষ্টির কারণে তখন সেই পুনর্গঠন কর্মসূচি ভালোভাবেই সফল করতে পেরেছিল বাংলাদেশ সরকার।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অতি স্বল্প সময়ের শাসনামল কেমন ছিল তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন সময়ের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত শত শত রিপোর্ট, ছবি এবং প্রতিবেদন থেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেই সব রিপোর্ট এবং প্রতিবেদনের কিছু শিরোনাম ছিল এ রকম- ‘বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ/বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২); ‘বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গঠন করতে চাই’- সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু (দৈনিক বাংলা, ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭২); নাগরিক সংবর্ধনায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী উক্তি : ‘একটি মানুষের পেছনে সমগ্র জাতিকে এমন ঐক্যবদ্ধ হতে দেখি নাই’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ মার্চ, ১৯৭২); নববর্ষে জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর বাণী : ‘মানবতার সেবাই হোক আমাদের পরম ধর্ম’ (বাংলার বাণী, ১৪ এপ্রিল, ১৯৭২); ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ- এই চারটি স্তম্ভের উপরই আমার নীতি প্রতিষ্ঠিত : বন্দুকের নল নয়, জনগণই আমার শক্তির উৎস ... বঙ্গবন্ধু।’

কিছু বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ছিল এই রকম- The Peoples Republic of Bangladesh came into existence on 16 December 1971. It faced staggering difficulties.With a per capita annual GNP bellwo $100, at least 75 million people crowded into an area roughly the siæe of Arkansas and periodic ravages of natural calamities, it had long been one of the worlds most impoverished region. এটা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী ৬ মাসের সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে সিআইএ’র নিজস্ব গোপন প্রতিবেদন। (২৭ জুন, ১৯৭২)

স্বাধীনতার পরে মাসের পর মাস একটার পর একটা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছিল সিআইএ, যা থেকে সহজেই বোঝা যায়, আমাদের বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তখন তারা কতটা চিন্তাক্লিষ্ট এবং গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।


লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test