E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

২১ অগাস্ট : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের ১৮ বছর 

২০২২ আগস্ট ২০ ১৬:৩৩:৩৭
২১ অগাস্ট : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের ১৮ বছর 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত নৃশংস সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনা অন্যতম।২১ আগস্ট ২০০৪ শনিবার সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকার ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশ। কিন্তু তারাই সেদিন দলীয় কার্যালয়ের সামনে ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসের শিকার হন, যার মূল লক্ষ্য ছিলেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।

ছিন্নভিন্ন লাশ, বিস্ফোরণের শব্দ, আহতদের আর্তনাদ, রক্তাক্ত নেতা-কর্মীদের ছুটোছুটিতে সেদিন ওই এলাকা হয়ে উঠেছিল বিভীষিকাময়।

১৮ বছর আগের সেই দিনটি ছিল শনিবার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেটাও ছিল ভয়ঙ্কর আরেক আগস্ট।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ওই গ্রেনেড হামলা ছিল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত।

আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে সময় ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা। আর সেই সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে হত্যার ওই ঘটনা স্তব্ধ করে দিয়েছিল জাতিকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও আহত হয়েছিলেন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা এই হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী আইভী রহমান অন্যতম। শনিবার বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে।

কী ঘটেছিল সেদিন?

২০০৪ সালের সেই ভয়াল বিকাল ৩টা থেকে দলের মধ্যম সারির নেতারা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। ৪টার দিকে শুরু হয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার পালা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আসেন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। নেতা-কর্মীরা তখন অধীর আগ্রহে নেত্রীর বক্তৃতা শোনার অপেক্ষায়।

যে ট্রাকে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তার পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল উপরে ওঠার জন্য। ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা।

দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।

পুরোটা সময় ওই টেবিলের পাশে বসেছিলেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুন। মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কয়েক গজের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ গাড়ি। সেখানে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক, যিনি এখন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা।

৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়।

ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর বসিয়ে দেন।

এর পরপরই আরও তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়; চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নামিয়ে আনতে বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।

মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার সবাই ট্রাকের ওপর বসে পড়তে বাধ্য হন।

নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে।

শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন।

সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে আহত নেতাকর্মীদের ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না শেখ হাসিনা। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হয়।

শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন তখনো গ্রেনেড ফাটানো হচ্ছিল; পাওয়া যাচ্ছিল গুলির শব্দ।

ওই হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতা-কর্মীরা। ওই অবস্থায় রিকশা, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।

ঝরে যায় ২৪ প্রাণ

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

২১ অগাস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হন তারেক আহমেদ সিদ্দিক, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শোয়েব মো. তারিকুল্লাহসহ নেতাকর্মীদের অনেকে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা।

তার গাড়ির কাচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের চিহ্ন আর পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির চাকা সে কথাই প্রমাণ করে।

সুধা সদনে শেখ হাসিনার বাসভবনে গাড়িটি দেখিয়ে দলের তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী পরদিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থার গাড়িটিই শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার পরপরই নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। আর তখনই গাড়ির সামনের জানালা লক্ষ্য করে অনেকগুলো গুলি ছোড়া হয়। দেহরক্ষী মাহবুব গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মারা যান।

শেখ হাসিনা গাড়িতে ওঠার পরপরই পেছন থেকে বাঁ দিকের সিট লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হয়। সব শেষে চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে হামলাকারীরা।

কিন্তু চালক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন সচিবালয়ের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদ মিনার, পলাশী, নিউ মার্কেট হয়ে পিলখানার ভেতর দিয়ে নিরাপদেই ধানমণ্ডিতে সুধা সদনে পৌঁছে দেন শেখ হাসিনাকে।

কর্মীদের মানবঢাল

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার পর সেদিনই টেলিফোনে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি সেদিন বলেন, “আমার কর্মীরা জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। গ্রেনেড যখন বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন নেতা-কর্মীরা আমাকে ঘিরে রেখেছিল। তাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। এখনো আমার কাপড়ে তাদের রক্ত লেগে আছে।”এ কথা বলতে বলতে সেদিন কেঁদে ফেলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

পরিশেষে বলতে চাই, আজ দীর্ঘ ১৮ বছর পার হলেও সেই নৃশংস গ্রেনেড হামলার বিচার শেষ হয়নি। প্রখ্যাত মহিলা নেত্রী আইভী রহমান সহ সকল নিহত ও আহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে একটাই দাবী, অনতিবিলম্বে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট পৈচাশিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে তার রায় কার্যকর করতে হবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test