E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

নারীর নিরাপত্তা ও হালের বাংলাদেশ

২০২২ আগস্ট ২২ ১৮:১৮:১৫
নারীর নিরাপত্তা ও হালের বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র


ইদানীং নারীর নিরাপত্তা ও বাংলাদেশ যেন দুটি পরস্প-বিরোধী শিবিরে অবস্থান করছে। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই রোজই বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নারী অপহরণ, নারীকে বিবস্ত্র করা, তাকে নানাবিধ দৈহিক নির্য্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এতই বেশী যে, তা দেখতে দেখতে সেগুলি যেন সকলেরই গা-সহা হয়ে গেছে। তাই প্রতিবাদের ভাষাও অত্যন্ত সীমিত-প্রতিরোধ প্রচেষ্টাও দৃশ্যত: অস্তিত্বহীন। আমি সামাজিক প্রতিবদ ও প্রতিরোধের কথা বলছি। 

বাংলাদেশের বিপুল উন্নয়নের কথা আমরা হামেশাই শুনছি। উন্নয়ন অবশ্য হচ্ছেও। বিশাল মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু নিজেদের তহবিলে নির্মাণ করে মাত্র দেড়মাস আগে তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন দেশের উন্নয়নের এক অনস্বীকার্য্য নজির। পদ্মা সেনতু ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্প কার্যকর করা হয়েছে-নির্মানাধীনও রয়েছে বহু প্রকল্প।

বাংলাদেশে এখন আর খড়ের ঘর খুঁজেপাওয়া যায় না। টিনের ঘর গ্রামে গঞ্জে হাজারে হাজারে দৃশ্যমান। বহু দালানকোঠা উঠেছে-চোখ ধাঁধানো বহু বাজার-বিপণী, বহুতল বিশিষ্ট দালান-কোঠা, ফ্ল্যাট ইত্যকার গড়ে উঠেছে। ব্যক্তি মালিকাধীন প্রাইভেট কার যেন ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত অসংখ্য যানবাহনের তুলনায় সংখ্যাগত দিক দিয়ে কম নয়। এজাতীয় আরও অনেক কথা তুলে ধরা যেতে পারে।

তবে উন্নয়নের আরও একটি দিকও রয়ে গেছে যে দিকটি সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকা অপরাধ। এ জাতীয় চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতির রেকর্ড প্রমাণ প্রসার ঘটেছে। সম্পদ জাতির মালিকানায় নয়-বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার কোটিপতি ছিল এবং তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল ব্যাপক গণ-আন্দোলন। আজ বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা হাজারেও বেশি এবং এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

ব্যাংকের পর ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে। বিদেশী ভ্যাংকগুলিতে হাজার হাজার কোটি টাকা অনবরত পাচার হয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও মিন মিন করে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার কথা বলা হলেও তার কোন বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিরিয়ে আনার কথাগুলি স্তোকবাক্য মাত্র-তা এ সংক্রান্ত দীর্ঘ ইতিহাসই সন্দেহাতীভাবে প্রমাণ করে।
অপর ব্যাংকগুলি ও অপরাপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ খেলাপির সংখ্যা রীতিমত উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে উঠেছে। বাড়ছে অব্যাহত গতিতে কিন্তু তা পরিশোধের কোন লক্ষণ নেই-নেই ন্যূনতম উদ্যোগও। উল্টো ঋণখেলাপিদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন সরকারিভাবে দেখানো হলেও খেলাপি ঋণ গ্রহিতারা তাতে আদৌ সাড়া দিচ্ছেন না-উল্টো খেলাপি ঋণের অংকের পরিমাণ প্রতি বছরই লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে অপ্রতিহত গতিতে।

অপরদিকে ঋণ খেলাপি হওয়া বা ঋণের টাকা পরিমোধ করা রীতিমত একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্বেও ঋণ গ্রহীততাদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের তরফ থেকে বিশেষ একটা মামলাও দায়ের করা হচ্ছে না কারণ সম্ভবত: এই যে যাঁরা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন তাঁরা সরকার ঘেঁষা কেউ কেটা। তাই তাদের গায়ে হাত দেওয়ার সাধ্য ব্যাংকেরও নেই-হয়তো বা আইনেরও নেই। পরিণতি দাঁড়াচ্ছে সংকটগ্রস্ত জাতীয় অর্থনীতিতে সংকটের মাত্রা আরও গভীরতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

পদ্মাসেতু সহ যে সকল মেগা প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়েই যেন ঋণ খেলাপির সংখ্যা, বিদেশে অর্থ পাচারকারীর সংখ্যা ও অপরাপর অপরাধে অপরাধীদের সংখ্যাও দিব্যি স্ফীত হচ্ছে।

অপরাপর অপরাধ যেমন বিদেশে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দিব্যি নিরাপদে পাচার, লুটপাট, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা-প্রভৃতিও অবাধে চলছে। কোন অপরাধীর কোন শাস্তি নেই। সুতরাং সকল অপরাধীই নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে একের পর এক অপরাধ করেই চলেছে ক্লান্তিহীনভাবে। এরই মুখে আজ সর্বাধিক ভয়াবহ রূপ নিয়ে বাংলাদেশের সমাজের নানা স্তরে আবির্ভূত হয়েছে যৌন অপরাধ। নারী দেহ আজ এক শ্রেণীর পুরুষদের কাছে সীমাহীন লোভের শিকারে পরিণত হয়েছে।

সেই পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নারী-পুরুষের সমমর্য্যাদা ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই দাবী নিয়ে আন্দোলন করেছেন যেমন নারী সংগঠনগুলি, তেমনই তা ছিল সকল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার কামী দল ও সংগঠনের অন্যতম প্রধান দাবী। এই দাবী পাকিস্তান আমল থেকেই ক্রমশ: জোরদার হতে হতে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের নারী সনমজাও রাইফেল হাতে নিয়ে পাকিস্তান সেনা ও তাদের এ দেশীয় লেজুড়দের বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেছেন।

এ সকল কিছুর পরিণতিতে নারী সমাজ অতীতের তুলনায় অনেক অধিকারও অর্জন করেছেন। যেমন চাকুরী-বাকুরীর ক্ষেত্রে। এখন নারী হাইকোর্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে, প্রশাসনিক নানা উচ্চপদে যেমন সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জেলা প্রশাসক, ইউ.এন.ও, পুলিশ সুপার, ব্যাংকগুলির নানা দায়িত্বশীল পদে তাঁরা নিয়োগ পাচ্ছেন। অবশ্য চাকুরীতে নারীদের এখন পর্য্যন্ত স্বীকৃত পদের সংখ্যা ৩০ ভাগ হলেও প্রশাসনিক ও নানাবিধ টালবাহানায় সেই নিরিখ পর্য্যন্ত নিয়োগ নারীরা এখনও পান নি। তবু দেশের নিম্ন থেকে সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবী এবং তাঁদের সহকারী পদে, বিভিন্ন অফিস-আদালতে নানাস্তরের কেরানীর পদে বেশ ভাল সংখ্যক মহিলা কাজ করে চলেছেন। এ ছাড়া এখন বাজার-বিপণী সমূহে মোটামুটি বেশ সংখ্যক নারী ঝবষং এরৎষ হিসেবেও কর্মরত।

এইভাবে যে হাজার হাজার কর্মরত মহিলা আমাদের সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন-তার শতকরা ৯৫ ভাগই, বা তারও বেশী পায়ে হেঁটে, বা রিক্সায়, বা স্কুটারে, বা বাসে চজড়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের স্বামী, ভাই বা বাবা কেউই থাকেন না-থাকা সম্ভবও না। নিজ নিজ অফিসের কাজকর্ম সেরে এঁদের অনেকেরই ফিরতে সন্ধ্যা বা রাতও হয়ে যায় অনেক সময়। ফলে ফিরতি পথের যাত্রাকালে মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে হয় তাঁদের। বাসে দেখা যায় চালন, হেলপার এবং এক শ্রেণীর পুরুষ যাত্রীর লোলুপ দৃষ্টি, কেউ বা সুযোগ পেলে নারী দেহের স্পর্ষকাতর কোন অঙ্গ স্পর্শ করে বা যাত্রী হীন অবস্থায় পেলে বিবস্ত্র করা ও ধর্ষণ, গণধর্ষণ করার কাহিনী এখন সংবাদপত্রের প্রষ্ঠায় প্রায় নিয়মিতই স্থান পাচ্ছে। খবরগুলিই যেন আতংকের সৃষ্টি করে।
আরও ভয়াবহ অনেক খবরের মুখোমুখি সংবাদপত্রের পাঠকদের প্রায়শরই হতে হয়। যেমন মাদ্রাসা শিক্ষক তার নাবালক ছাত্রীকে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তার সহপাঠিনীকে, শিক্ষক তাঁর ছাত্রীকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করছেন। এমন কি, কোন কোন শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রকে বাসায় ভিন্ন কথা বলে ডেকে এনে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হতে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে ছাত্রটিকে শেষ পর্য্যন্ত তাতে বাধ্য করার কাহিনীও প্রকাশ হতে দেখা যায় ।

এ ছাড়া অফিস আদালতে কর্মরত নারী সমাজের কাউকে কাউকে পুরুষ সহকর্মী বা তাঁদের উচ্চতর কর্মকর্তা দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার কাহিনীও একেবারে কম নয়। এইসব ক্ষেত্রে অবশ্য চাকুরীর নিরাপত্তা, সমাজের চোখে হেয় হওয়ার আশংকাজনিত কারণে শতকরা প্রায় ৯৮ ভাগ ঘটনাই ভুক্তভোগী হন। ফলে অপরাধীদের শাস্তি বা তাদের বিচারও সব কিছুর আড়ালেই থেকে যায়। কিন্তু এর ফলে ভূক্তভোগী নারীরা একাধিক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে বাধ্য হন। যেমন ডৌন লালসাগ্রস্ত ওই কর্মকর্তারা বা পুরুষ সহকর্মীরা প্রায়শ:ই দেহ উপভোগে লিপ্ত হতে পারেন-কিন্তু বিষয়গুলি গোপন না রেখে চাকুরীর বা আর্থিক নিরাপত্তা হারানোর আশংকা থাকে। এ ছাড়াও অধিকতর মারাত্মক যা হতে পারে, এবং হয়ও কখনও কখনও, ভূক্ত ভোগী নারী অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়তে পারেন। শেষোক্ত ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীদের বিয়ের ক্ষেত্রে, আর বিবাহিতদের স্বামী ও অন্যান্যদের আস্থা হারিয়ে তাঁদের অজানা ভবিষ্যতের যাত্রীতে পরিণত হতেও হতে পারে ঘর সংসার পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে। সন্তান থাকলে এ ক্ষেত্রে সমস্যা সংকট আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে।
কাজেই নারী জীবনের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারটি একদিকে যেমন জটিল-অন্যদিকে তেমনই তার জন্যে উপযুুক্ত উদ্যোগও এখন পর্য্যন্ত নেওয়া হয় নি। আদালতের মনোভাব কঠোর হলেও বিচার প্রক্রিয়া জটিল এবং সময় সাপেক্ষ হওয়ায় মামলা চলাকালীন পথে ঘাটে নিগৃহিত হতে হয় অনেক ভূক্তভোগী মেয়েকেই।

এগুলি প্রতিরোধে আদালকে অধিকতর কার্য্যকর ভূমিকা পালনে সহায়তার জন্য সি আর পি সির প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে বিচার প্রক্রিয়া নারী বান্ধব করার অপরপক্ষে আমাদের পরিবার, শিক্ষায়তন, কর্মস্থল, রিকসা, স্কুটার বাস প্রভৃতির চালকদের নৈতিক শিক্ষা এবং তার প্রয়োগে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য্য।

মনে রাখা প্রয়োজন, যত দিন না আমরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব-ততক্ষণ আমরা নিজেদেরকে সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্বের মর্য্যাদাও দাবী করতে পারব না।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test