E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

দেবী দুর্গা : আলোর দিশারী

২০২২ সেপ্টেম্বর ১৮ ১৬:০৯:৪৫
দেবী দুর্গা : আলোর দিশারী

পীযূষ সিকদার


কয়েকদিন ধরে মন জানি কী যেন বলতে চায়! বলা হয়ে উঠে না। কিছু তো বলতে চাই। কী বলবো কিইবা বলার আছে! মন কেবলি সপ্তমে গিয়ে ঠেকে। সুর এগোয় না। সুর আর অসুরের দ্বন্দ্ব বাধে। আমারই ভেতর। সেই দ্বন্দ্বকে কোন ভাষায় সঙ্গায়িত করা যায় না। শরতের কাঁশফুল চারিদিকে সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। শিউলি ফুলে গাছতলা হলুদ সাদায় মাখামাখি। দেবী দুর্গা আসছে। মা দুর্গা প্রতি বছরই আসে। অসুর বিনাশ লাগি। প্রতি বছর যায় অসুর দমন করে। সত্যিই কি অসুর দমন হয়! তাহলে চারিদিকে এতো অসুর কেনো! সুর আর অসুরের দ্বন্দ¦ সেকাল থেকে স্বকালে! স্বকালে দাঁড়িয়ে দেখি সুর আর অসুরের দ্বান্দ্বিক অবস্থান। দুর্গা আসে। অসুর নিধন লাগি। সুরদের রক্ষা আর অসুরদের নিধন। ভাবি, তারপরও এতো অসুর কেনো চতুর্দিক। সুর নামধারী অসুরের সংখ্যা কম না। মন কী জানি কি বলতে চায়! বলা হয়ে উঠে না। সুর আর অসুরের দ্বন্দ্ব সেই সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে। কখনো সুর পরাজিত হয় কখনো অসুর পরাজিত হয়। জয় পরাজয়ের মধ্যে সুর অসুরের দ্বান্দ্বিক অবস্থান প্রকট হয়ে উঠে। হে, মা দেবী দুর্গা তুমি আসো। প্রতি বছরই তোমাকে আসতে হয়। লোকসৃত, বাবার বাড়িতে বেড়াতে। সঙ্গে আসে কার্তিক, গণেশ, লক্ষী, সরস্বতী। আর আসে আসতে হয় তাকে বাবা ভোলানাথ। অসুর নিধন হয়। অসুর দেবী দুর্গার কাছে বর চায়। আমি তোমার সাথে যুগে যুগে পূজিত হতে চাই। 

মনটা উচাটন। বুঝতে পারি না। দেবী দুর্গার সাথে পূজা পায় অসুর। কেনো? এ প্রশ্নবোধক চিহ্নটি নিয়ে মা দুর্গার দিকে তাকাই। তিনি রক্ত চান না। অসুরের বুকের কাছে ক্ষত কেন? নানাবিধ ভাবনারা আমাকে গ্রাস করে। সেই চিন্তারাশি আমাকে যে দগ্ধ করে না তা কিন্তু নয়! আমি কাঁদি আর বিষন্ন হই। মা দুর্গা আসছে গজে চড়ে আর চলে যাবে নৌকায়। এই মিথলোজিক্যাল মানে আমি বুঝি না। না বুঝলেও বোঝার দায় এড়ায় না। ঢোল বাজছে ঢাক বাজছে। চারিদিক আনন্দের বন্যা ভাসিয়ে দিয়ে মা আসছে। আসতে হয় মাকে। অসুর বিনাশে। নিজের ভেতর যে সুর ও অসুর আছে। সেই দ্বন্দ্বের অবসানই দুর্গা পূজা। আক্ষরিক অর্থে অসুরকে আমরা চিত্রায়িত করি সেই অসুরকে দেখা যায়। কিন্তু নিজের ভেতর যে অসুর আছে তাকে দেখি না। অনুভবে বাজে। ভেতরের অসুরকে নাশ করাই দুর্গা পূজার সার কথা।

নিশ্চয়ই মা দুর্গা রক্ত চান না। সবাই তো তারই সৃষ্টি। তাই তো যুগে যুগে পূজা পান অসুররুপী মহিষাসুর। সুর আর অসুরের দ্বন্দ্বটা অন্তর্গত, বহিরাগত নয়। বাইরে আমরা যুদ্ধের যে দামামা দেখি বিশ্ব জুড়ে। বারুদের ঘ্রাণ নিই। এ যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধটা নিজের সাথে নিজের। সেই যুদ্ধে জিতবে সুরই। ভেতরের অসুরকে বিনাশ করতে পারলে আমরা জয়ী হবো। নির্ঘাত জয় আমাদের। বাহিরে যে অসুর নাই তা কিন্তু নয়। বাহিরের অসুরকে দমন করতে পারলেই আমরা সুন্দর একটি পৃথিবী পাবো। সেই সুন্দর কল্যাণে মা দুর্গা এ ধরায় আসেন বারবার। আমরা প্রতিবারই তাঁকে গ্রহণ করি মঙ্গলমন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে। দেবী দুর্গা দিন দিন বিষন্ন হন। মর্ত ছেড়ে চলে যাবেন অমর্ত্যধামে কৈলাশে। যাবার বেলা দেবী দুর্গার চোখের কোণে জল জমে উঠে। আমরাও চোখের জলে কপোল ভিজাই। দেবী দুর্গার চলে যাওয়া যে কষ্টের তা সনাতনধর্মীরা হাড়ে হাড়ে টের পান।

আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা করা হয়। আশ্বিনের নবরাত্রি পূজা শারদীয় পূজা এবং বসন্তের নবরাত্রি পূজা বাসন্তীক দুর্গা পূজা নামে পরিচিত। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাষষ্ঠী, দুর্গাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়াদশমী নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষটিকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম ‘মহালয়া’।

যিনি দুর্গতি ও সংকট থেকে আমাদের রক্ষা করেন তিনিই দেবী দুর্গা। মা দুর্গা দুর্গমনামক এক অসুরকে বধ করেছিলেন। তাই তো তিনি হয়ে উঠেন দুর্গতিনাশিনী। পার্বতীর এক উগ্ররুপই দেবী দুর্গা। হিন্দু সনাতনধর্মীরা তাকে মহাশক্তির একটি উগ্ররুপ মনে করেন। তাঁর বাহন সিংহ। কোনো কোনো মতে বাঘ। মহিষাসুরমর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর অনেক রুপ তার মধ্যে কালী রুপটিই অধিক জনপ্রিয়।
মা দুর্গা আসছেন। আনন্দ আর ধরে না। ঘরে ঘরে আনন্দের ধূম লেগেছে। নতুন জামা কাপড় কেনার এক মহোৎসব চলছে। মা দুর্গা আসছে। পাড়ায় পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে দেবী দুর্গার মূর্তি গড়া হচ্ছে। হরমোহন পালেরা এবারো ব্যস্ত দুর্গা গড়ায়। কেউ বোঝে আবার কেউ বোঝে না দেবী দুর্গার মাহাত্মকথা ! দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। তারপরও আমাদের দুর্গতি যায় না। সুর ও অসুরের দ্বন্দ্ব চলে। সেই দ্বন্দ্বে সুর জয় লাভ করে! আমার মধ্যে এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে যায়! তাহলে এতো রেষারেষি কেন? চারিদিকে যুদ্ধের ঢোলডগর বাজে। কোন দিকে যাচ্ছি আমরা। আমরা কি যুদ্ধকে এগিয়ে দিচ্ছি! আপন মানুষকে দূরে ঠেলে দিই! পরকে করছি আপন।

ভালোবাসার নামে উজাড় করে বিষ ঢালছি। বিষে বিষাক্ত হচ্ছি। বাঁচার আশা যখন ক্ষীণ তখন চারিদিকে দামামা বাজিয়ে দেবী দুর্গা আসছে অসুর বিনাশে। অসুররুপ অসুরে নাকি মনুষ্যরুপ অসুরে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। কাউকেই চেনা যায় না। মুখোশে মুখোশে ভরে গেছে দেশ। মানুষ মানুষকে চিনতে পারছে না। কে যে সুর আর কে যে অসুর চেনা দায়! অন্ধকারে ছেয়ে গেছে দেশটা। যাকে সুর ভাবি পরক্ষণেই সে অসুর হয়ে হুংকার দিয়ে পৃথিবী কাঁপায়। আশার কথা দেবী আসছে। দেবী আসছে গজে। পৃথিবীকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে আলোর দিশারী হয়ে। হে দেবী তুমি সুর আর অসুরের দ্বন্দ্ব বোঝো। সেই দ্বান্দ্বিক মা আমার পৃথিবীকে শস্য-শ্যামলা করো। সুরে সুরে ভরে দাও আমাদের সাজানো সংসার। তুমি আলোর দিশারী হয়ে আর কটা দিন থাকো আমাদের মাঝে। যেন তোমার দেয়া আলোতে আলোতে বাঁচি সহস্রযুগ। মা আসছে। এই তো তোমার ভক্ত সকল -সোনার সিঁড়িতে চরণযুগল রাখো। আমাদের বাঁচাও। আমরা তো বাঁচতে ভুলে গেছি। এসেছিলে একবার পার্বতীরুপে। পরের বার কালীরুপে। বারবার দুর্গারুপে এসে তোমার সন্তানদের দশ হাতে আলোর ঠিকানা দাও। যেনো মরে মরে বেঁচে উঠি আরবার।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test