E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুক্তমত

জনবসতিপূর্ণ গ্রামটি এখন ক্রিমিনালদের নিরাপদ চারণ ভূমি!

২০২৩ জানুয়ারি ১৫ ১৪:৪৪:৫৫
জনবসতিপূর্ণ গ্রামটি এখন ক্রিমিনালদের নিরাপদ চারণ ভূমি!

রহিম আব্দুর রহিম


সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার হয়েছে। প্রতিবেদনের মূলসুর ছিলো "ভারতের বিএসএফ ও ডাকাতদের অত্যাচার, নির্যাতনে পঞ্চগড়ের চান্দারপারা নামক গ্রামটি এখন জনশূন্য। ঘটনা সত্য, তবে কোনকালে, কখন, কি প্রেক্ষাপটে এমনটা ঘটেছে তা ওই প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়নি। স্পষ্ট হয়েছে মানবতা আজ কোথায়! একজন লেখক হিসেবে বিবেকের তাড়নায় ঘটনার আদিপ্রান্ত উৎঘাটনে সরেজমিন পরিদর্শন করেছি, কথা বলেছি অনেকের সাথেই। মূলত যা জানা গেছে, 'পঞ্চগড় সদর উপজেলার জনশুন্য চান্দারপাড়া গ্রামটি বর্তমানে ক্রাইমজোনে পরিনত হয়েছে। এক সময়কার জন বসতিপূর্ণ গ্রামটি এখন বিভিন্ন এলাকার ক্রিমিনালদের নিরাপদ চারণ ভূমি হয়ে ওঠেছে। গা ছমছম গ্রামটিতে দিবারাত্রি চলে মাদকসেবী, মাদক প্রচার ও অনৈতিক চরিত্রের মানুষদের আনাগোনা।ফেন্সিডিল, প্যাথেডিন, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকসেবীরা গ্রামটি নিরাপদ জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সুযোগ পেলেই জনশূণ্য এই গ্রামকে কেন্দ্র করে চোরাকারবারি একটি গোষ্ঠী ভারতের চা-চাষীদের চা পাতা কেটে সাবাড় করছে, কাটা তারের বেড়া কেটে নিয়ে আসছে ছাগল গরু। একসময়কার নৈস্বর্গীয় বাংলাদেশ-ভারতে'র জনমানুষের ভ্রাতৃত্ব-বন্ধুত্বের মিলনস্থল চান্দারপারা গ্রামটি জনশুণ্য হওয়ায় এলাটিতে ভূঁতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে নানাবিধ কারণে ওই গ্রামের অধিবাসীরা বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে। ফলে চিহৃিত চোরাকারবারীরা এই গ্রামটিকে তারা নিরাপদ ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করছে। সম্প্রতিকালে ওই গ্রাম সরেজমিন পরিদর্শনকালে ওঠে এসেছে দীর্ঘ ৫০ বছরের ব্যবধানের ৪ ধাপের নানা কাহিনী। 

পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার পশ্চিম-উত্তরে সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের শেষ সীমান্ত "চান্দারপারা" গ্রামিটি একই উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের শেষ পূর্ব-উত্তরের সীমান্তে অবস্থিত। চান্দারপারা এই গ্রামটি পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের একটি ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম। যে গ্রামটির উত্তরাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার গোয়ালগজ অংশ। 'ভারত-বাংলাদেশে' যৌথ চান্দারপারা গ্রামটিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন শরনার্থীদের নিরাপদ আবাসস্থল ছিল।যেসময় সীমান্তে কাটাতারের বেড়া ছিলোনা, ঠিক ওই সময় 'বাংলাদেশ-ভারত' অংশের চান্দারপারা গ্রামের শিশু-কিশোররা একই সাথে একই মাঠে খেলাধুলা করতো। এই গ্রামেই বসতো "তারাপুকুরী" নামের গ্রাম্য বাজার। যা চলেছে ২০০২ সাল পর্যন্ত। সময়ের বিবর্তে যা বিলুপ্ত।

গ্রামের সাবেক বাসিন্দা মো. তরিকুল ইসলাম (৭০) জানান, "৭১এর মুক্তিযুদ্ধকালে এই গ্রামে শরনার্থীরা নিরাপদে বসবাস করেছে। ২০০২ সালের প্রথম দিকে এই গ্রাম বিভিন্ন এলাকার দুষ্কৃতিকারীদের আড্ডাস্থল এবং চোরাকারবারীদের আবাসভূমিতে পরিনত হয়। ফলে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর রোষানলে পরায় এই গ্রামের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় নিরাপদ স্থাপনা গড়ে তুলেন। আমিও ওই সময় সপরিবারে ওই সময় পার্শ্ববর্তী ধাক্কামারা ইউনিয়নের মীরগড় পশ্চিমপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেছি।এখন আমরা খুবই শান্তিতে আছি।তবে সাবেক গ্রামটিতে অপরাধিরা দিবারাত্রি খারাপ করছে, কেউ কিচ্ছু বলছে না।

গ্রামের প্রবীন ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, "২০০২ সাল থেকে ওই গ্রামের বসতিরা স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। ২০০৫ সালে গ্রামটিতে হাফিজ উদ্দীন ও সামাজ উদ্দীনের পরিবারের মধ্যে জমিসংক্রান্ত বিরোধে একজন খুন হয়, এরপর মামলা, পুলিশের ধরপাকর, পালিয়ে বেরায় এলাকাবাসী, এই সুযোগ কাজে লাগায় অপরাধি চক্র, সীমান্তরক্ষী বাহিনীরা নড়েচড়ে বসে,বেরে যায় সীমান্ত বাহিনীদের কর্মকান্ড।জনমানুষ নিরাপদে বসতি স্থনান্তর করায় গ্রামটি এখন পুরোপুরি জনশুন্য।"

গ্রামটি সরেজমিন পরিদর্শনকালে ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার গোয়ালগজ বিএসএফ ক্যাম্পের টহল সৈনিকদের সাথে কথা হয় বেলা ১২ঃ২৪ মিনিটে, চান্দারপারা বাংলাদেশ ও চান্দারপারা -ভারত সীমান্ত ৪২০ পিলারে জিএনসিং নামের সদস্যের সাথে, তিনি বলেন, "তোমার দেশের জাহাঙ্গীর, ছিদ্দিকুর, আনোয়ারুল, দেলোয়ারা সুযোগ পেলেই সীমান্তের কাটাতার কেটে ভারতের ছাগল গরু চুরি করে, ভারতের চা বাগানের পাতা কেটে নিয়ে যায়।

বিএসএফ যাদের নাম বলেছেন, তারা চান্দারপারা গ্রামের বাসিন্দা নয়, তারা সবাই গরিনাবাড়ি ইউনিয়নেন গাড়িয়ানপারা গ্রামের বাসিন্দা।চান্দারপারা গ্রামের ফসলের মাঠে কথা হয় ইয়াকুব আলী (৫৫)'র সাথে, তিনি জানান, "জনশুন্য গ্রামটিতে পাশের গ্রামের একটি দুষ্কৃতিকারী দল সবসময় আনাগোনা করে, সুযোগ পেলেই তারা সীমান্তের কাটাতার কেটে ছাগল-গরু চুরি করে।তার খেসারত দিতে হয় আমাদের।

ধাক্কামারা ইউনিয়নের মীরগড় গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহীম আলী(৪৫) জানান, "অপরাধ করে চিহৃিত অপরাধীরা, দোষ চাঁপে চান্দারপারার স্থানান্তরিত বাসিন্দাদের উপর। ধাক্কামারা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার জাহের আলী(৬৮)জানান, "চান্দারপারা গ্রামের মানুষরা খেঁটে খাওয়া সহজ সরল। তাঁরা শান্তির জন্য নিজ গ্রাম ছেড়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামে বসতি স্থাপন করেছে, এরপরও চিহৃিত অপরাধীর অপরাধ করেছে, বিপদ আসছে সরলদের ঘাড়ে।"

গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো মনোয়ার হোসেন দীপু বলেন, "ওই সীমান্তে কে কি ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত তা বিজিবি, পুলিশ জানে, এদের বিরুদ্ধে কঠোর হলেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।" এই বিষয়ে শেখপারা গ্রামের মহসিন আলী (২৫)নামের এক তরুণ বলেন, "জনশুণ্য গ্রামটি যদি লোকালয় করার জন্য মাদ্রাসা, এতিমখানা, বিনোদন কেন্দ্র অথবা বিজিবি -বিএসএফ ভ্রাম্যমান টহল চৌকি করা যায়, এতে করে অপরাধী অপরাধ করার সুযোগ পাবে না, আমাদের বাংলাদেশ অংশের মানুষ-জনরা কিছুই মানতে চায়না, ভারতের সীমান্তের মানুষ-জন, বিএসএফরা অনেক ভাল আচারণ করে। এ বিষয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো.জহুরুল ইসলাম বলেন, "স্থানীয় জনমানুষদের সচেতন হতে হবে, প্রশাসনকে তাদের সমস্য জানাতে হবে, আমরা জন মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এক কালের ঘটনায় অন্যকাল দায় নয়।

পঞ্চগড় জেলা পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা (পিপিএম) বলেন, "চান্দারপারা গ্রামটি ক্রাইমজোন, এখানের সাধারণ জনমানুষ নিরাপত্তাহীনতায় আছে, এটা আজকেই জানলাম,তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। পঞ্চগড় বিজিবি ১৮ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক লেঃকর্নেল মাহফুজুল হক বলেন, "সীমান্তে কোন প্রকার অস্থিরতা, অশান্তী, সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করার মতো অপরাধ হতে দেওয়া হবে না,আমরা মানুষ,মানবতা এবং সীমান্ত রক্ষায় সদা প্রস্তুত।"

লেখক : শিক্ষক, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।

পাঠকের মতামত:

২৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test