E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপর্যয় : প্রতিকারে চাই জনসাধারণের পরিবেশ আইন সচেতনতা  

২০২৩ জানুয়ারি ২০ ১৫:৩১:৪৮
চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপর্যয় : প্রতিকারে চাই জনসাধারণের পরিবেশ আইন সচেতনতা  

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামের অন্যতম সমস্যা পরিবেশ বিপর্যয়। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, ড্রেনেজের বেহাল দশা, নদী দখল ও দূষণ, অবৈধ ইটভাঁটা, জাহাজ নির্মাণের ফলে প্রতিনিয়ত সমুদ্র দূষিত হচ্ছে।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডা. এম এম মাজেদ তারপরও কলামে লিখেন- পরিবেশের সমস্যা বিশ্বের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি। আর পরিবেশ বিপর্যয় হলে বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের এক-চতুর্থাংশ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দূষণরোধে দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি। শিশুদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করলে তারা একটি উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। তারা নিজেদের স্বার্থেই নিজের শহর এবং দেশের পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে ভাবতে পারবে। তাই পাঠ্যপুস্তকে পরিবেশ-বিষয়ক প্রবন্ধ থাকা জরুরি।বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকসই উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ এবং সেই অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি ও যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতার অভাব ও চিন্তা-ভাবনার দৈন্যতাও আছে। এটা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প তৈরি ও বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহারের বিষয় থেকে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রকল্পগুলোর পরিকল্পিত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে উপযুক্ত স্থানে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তাও স্পষ্টভাবেই সবার সামনে এসেছে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের সাথে মিলিত না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনোই টিকবে না। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাজেটে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। বরাদ্দের বিবেচনার পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনায় গুরুত্ব বেশি দেওয়া প্রয়োজন।

পরিবেশ খাতের উন্নয়নের অন্যতম শর্তই হচ্ছে পর্যাপ্ত গবেষণাগার। যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করা যাবে এবং ওই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশ বিনষ্ট এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তির মূলে রয়েছে মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড। জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের সংকল্প বাস্তবায়নে মানুষের ভূমিকা রাখতে হবে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। জলাভূমি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়নের নামে শুধু কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এখনো সময় আছে, পরিবেশ ধ্বংস না করে সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

বায়ু, শব্দ, মাটি, নদী, সাগর দূষণ রোধ বা পরিবেশ সুরক্ষার বিষয় অনুধাবনে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার শর্টকাট কোনো উপায় এখন নেই। এটি শিরায় উপশিরায় ঢুকে পড়েছে। পরিবেশ সুরক্ষার যে পরিকল্পনা করা হয় তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দেয়। তদারকিতে গাফলতি লক্ষ করা যায়।

আমাদের গ্রহের সম্পদ এবং ইকোসিস্টেমকে টেকসইভাবে পরিচালনা এবং এর গুরুত্ব বুঝতে হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে মানবজীবনের সমৃদ্ধি লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর। পরিবেশের দূষণ, বিষাক্ত বর্জ্য নির্গমন, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ক্যানসার সৃষ্টিকারী জীবাণুসহ সকল প্রতিকূলতা রোধ করে, প্রকৃতির সাথে মানুষের সুসম্পর্ক স্থাপন করে দারুণ এক পৃথিবী গড়ে তুলতে চাই আমরা।

আমাদের প্রথমেই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধ করতেই হবে। এই নীতিতে অটল থেকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ সংরক্ষণ সমন্বিত কর্ম কৌশল ও সবুজ টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আমাদের সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়িয়ে দূষণ কিছুটা হলেও কমাতে হবে।

অবৈধ ইটভাটা

চট্টগ্রামে ৩২০টি অবৈধ ইটভাটা চলছে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন উপজেলায়। বনের কাঠ পুড়িয়ে উঁচু চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে নির্বিচারে। নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে পাহাড়ি মাটি ও ফসলি ভূমির। এতে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটলেও নীরব রয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। ফলে এ পর্যন্ত বন্ধ হয়নি কোনো ইটভাঁটা। অথচ এসব ইটভাঁটা বন্ধে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট আদেশ রয়েছে। যা অমান্য করে ইটভাঁটাগুলো চালু রাখা হয়েছে এখনও। এ অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীর মাঝে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

মানুষের ভাষ্য, উচ্চ আদালতের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর চট্টগ্রামের অবৈধ ইটভাঁটার মালিকরা। এসব কথা শোনা যায় স্বয়ং ইটভাঁটার মালিকদের মুখেও।

স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, সরকারদলীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া, প্রকট চাহিদা, অধিক মুনাফা ও কাঁচামালের সহজলভ্যতায় চট্টগ্রামে যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ ইটভাঁটা। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। প্রশাসনের নামমাত্র অভিযান ইটভাঁটার সাময়িক উৎপাদন থামাতে পারলেও মিলছে না দীর্ঘমেয়াদি সুফল।

উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে এসব ইটভাঁটার মালিকদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইটভাঁটা উচ্ছেদে স্থানীয় প্রশাসনের কৌশলগত অসহযোগিতাও রয়েছে। এতে পরিবেশ অধিদফতর অসহায় বলে একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ের পরিচালক এ বিষয়ে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। বরাদ্দ স্বল্পতা ও জনবল সঙ্কট রয়েছে। তবুও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ইটভাঁটা উচ্ছেদে আমরা বদ্ধপরিকর।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় অবৈধ ইটভাঁটা রয়েছে ৩২০টি। ১৪ উপজেলার মধ্যে একটি ইটভাঁটা রয়েছে পটিয়া উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাঁটা রয়েছে সাতকানিয়া উপজেলায়। এই উপজেলায় ইটভাঁটার সংখ্যা ৬৮টি। এ ছাড়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৫০টি, ফটিকছড়ি ও লোহাগাড়া উপজেলায় ৩৩টি করে ৬৬টি, রাউজান উপজেলায় ৩২টি, হাটহাজারী উপজেলায় ৩১টি, চন্দনাইশে ২৮টি, মিরসরাইয়ে ১৩টি, কর্ণফুলী উপজেলায় ১০টি, সন্দ্বীপে ৬টি, বাঁশখালীতে ৫টি, সীতাকুণ্ডে ৪টি, বোয়ালখালীতে ৪টি ও আনোয়ারায় ২টি ইটভাঁটা রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব ইটভাঁটা গড়ে তোলা হয়েছে সংরক্ষিত বন ও ফসলি জমিতে। এর মূল কারণ বনের কাঠ, পাহাড়ি ও কৃষি জমির মাটির সহজলভ্যতা।

অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাঁটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করার উদ্দেশে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হতে মাটি কেটে বা সংগ্রহ করে ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না। ৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইটভাঁটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসেবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না

বঙ্গোপসাগরে পরিবেশ বিপর্যয়

অব্যাহত দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক অর্থনীতির এ অঞ্চলটি নিয়ে এরই মধ্যে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দেশি-বিদেশি প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব বঙ্গোপসাগর। শিল্প ও মানববর্জ্য তো আছেই, এর বাইরে নদীপথে ঢুকছে ৩০০ ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য। আর সমুদ্রগামী জাহাজের তেল দূষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন নদ-নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য হজম করছে বঙ্গোপসাগর। এতে চট্টগ্রাম উপকূলে সামুদ্রিক মাছসহ জীববৈচিত্র্য দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে। যে হারে দূষণ বাড়ছে তাতে সাগরের বিশাল এলাকা অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এখনই এ ব্যাপারে সচেতন না হলে হুমকিতে পড়বে সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা।

বঙ্গোপসাগর দূষণ প্রসঙ্গে সবুজ আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, ‘আমরা কর্ণফুলীর দূষণ নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ বঙ্গোপসাগরের দিকে নজর দিচ্ছি না। নদীর দূষণ কমলে সাগরের দূষণও কমবে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের দূষণ যে পর্যায়ে গেছে তাতে আর স্বচ্ছ পানি নজরে পড়ে না। বিশেষ করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় জাহাজ ভাঙার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের দূষণ, কর্ণফুলীর মোহনা ও বহির্নোঙর জুড়ে তেল দূষণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বঙ্গোপসাগরের বড় অংশই বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। অথচ আমরা বিষয়টির গুরুত্ব দিচ্ছি না। এখন থেকে সচেতন না হলে এই সাগরের দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন আর সামাল দেওয়া যাবে না।’

পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ

দূষিত পরিবেশের প্রভাবে জীব জগতের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এতে মানুষের জীবনধারা ব্যাহত হয়। পরিবেশের অপরিহার্য বিভিন্ন উপাদান যেমন – বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের ফলে পরিবেশ সংকট দেখা দেয়। পরিবেশ সংকটে মানব জীবন বিপুল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং জীব জগতের স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।

পরিবেশের উপাদানগুলো দূষণের ফলে নানা রোগ ব্যাধি ছড়ায়। পানি দূষণের ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, চুলকানি ইত্যাদি রোগ হয়। শব্দ দূষণের ফলে হৃদরোগ, মাথাব্যথা, মানসিক সমস্যা ও কানের অসুখ হয়। বায়ু দূষণের ফলে ফুসফুসের অসুখসহ নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। এছাড়া মাটি দূষণের ফলে রোগ উৎপাদক বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব ছড়ায়। এছাড়া জমির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে খাদ্য ও অর্থ সংকট দেখা দেয়।পরিবেশ দূষণের অনেক কারণের মধ্যে নগরায়ন, শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ, গাছপালা কর্তন, সার ওষুধ কীটনাশকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ও পশুপাখির মৃতদেহ ফেলা, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, গাড়ি কারখানা ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া, কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি, বনভূমি কমে যাওয়া, নলকুপ স্থাপন, ভূমির অপর্যাপ্ততা, ভূমি ক্ষয়, অপরিকল্পিত চুলা ও জ্বালানি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যপরিবেশ দূষণ জনস্বাস্থ্যের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা মানবজাতিকে পরিবেশ সংকট বিপন্ন করতে পারে।পরিবেশ দূষণ রোধ করা অত্যন্ত জরুরি।

পরিবেশ দূষণ প্রতিকার করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে গণমাধ্যমে বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে, গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে, বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে, পশুপাখির মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান ও সম্পদের সংরক্ষণ, সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিতে হবে, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ কয়লা তেল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জনবসতিপূর্ণ স্থানে ইটভাটা বন্ধ করতে হবে ও ইটভাটা অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে, পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

পরিবেশ বিপর্যয় আইন সমূহ

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধনীসহ), পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৬, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬, চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা-২০০৮, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধনীসহ), জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, মোটরযান আইন-১৯৪০, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫, পণ্যে পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ ইত্যাদি আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না! পরিবেশ আইনের প্রয়োগ হলে জনসাধারণের মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে, তেমনি পরিবেশও রক্ষা পাবে।

পরিবেশ আদালত আইনটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হওয়ার ফলে পরিবেশ সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না! পরিবেশ আইন-২০১০ অনুসারে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি আদালত গঠনের বিধান থাকলেও ৩টি পরিবেশ আদালত (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) ও ঢাকায় একটি পরিবেশ আপিল আদালত কার্যকর রয়েছে। ফলে বিভিন্ন জেলার পরিবেশ দূষণের মামলা পরিচালনায় বাদী-বিবাদী উভয়েরই সমস্যা হচ্ছে। প্রত্যেকটি জেলায় পরিবেশ আদালত না থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা পরিবেশ দূষণ-সংক্রান্ত মামলা দায়ের করতে পারছেন না। আবার পরিবেশ আদালতের সংখ্যা কম থাকায় মামলা নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, বিদ্যমান পরিবেশ আদালত আইনের আওতায় সাধারণ মানুষ দূষণ সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করতে পারেন না! তারা শুধু ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। তথ্য মতে, বাংলাদেশে পরিবেশ আদালতগুলোয় বছরে গড়ে মাত্র ৮০টির মতো মামলা দায়ের করা হয়!

প্রশ্ন হলো, দেশের অন্য আদালতগুলো যেখানে মামলার ভারে ন্যূব্জ, সেখানে পরিবেশ আদালতে এত কম মামলা দায়ের করা হয় কেন? প্রতিদিন গণমাধ্যমে পরিবেশ দূষণ, অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের কথা শোনা গেলেও মানুষ কেন পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হয় না? এর প্রধান কারণ হলো পরিবেশ আইন সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা এখনো সেভাবে গড়ে না ওঠা। সাধারণত দেখা যায়, পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণকারী ব্যক্তি ধনী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর হয়ে থাকেন। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি দরিদ্র তথা সাধারণ হওয়ায় অনেক সময় মামলা দায়ের করতে উৎসাহিত হন না। আবার ন্যায়বিচার নিয়েও অনেক সময় সন্দিহান থাকেন! দেখা যায়, মামলা চালনা করার খরচও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির থাকে না! এসব কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, পরিবেশ আদালত কতটুকু জনবান্ধব? আবার পরিবেশ আদালতে অভিযোগকারীকেই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয়, যা অভিযোগকারীর জন্য কঠিন কাজ বটে! পরিবেশ আদালতে আবার পরিবেশ-সংক্রান্ত অন্যান্য সব (বন রক্ষা, পানি দূষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ইত্যাদি) মামলাও দায়ের করা যায় না। শুধু ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর অপরাধসমূহের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি করা যায়। তাই এখন সময়ের প্রয়োজনে পরিবেশ আদালতে পরিবেশগত অধিকার সুরক্ষায় জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পরিবেশ আইন সংশোধন করে সব ধরনের মামলা করার এখতিয়ার ও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও বিধিমালার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এর ফলে নিজেদের আশপাশের পরিবেশ রক্ষার্থে জনসাধারণ সরাসরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

পরিশেষে বলতে চাইপরিবেশদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার, প্রশাসন ও জনগণকে সম্মিলিতভাবে পরিবেশদূষণ রোধে কাজ করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি যাতে না হয়, সেভাবে সবাইকে অগ্রসর হতে হবে। পরিবেশ ধ্বংস করে এমন দ্রব্য যেমন—পলিথিনের ব্যবহার কমানোর কৌশল গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয় যাতে না হয়, সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। শিল্প-কারখানা তৈরির সময় পরিবেশ দূষণ হবে কি না তা ভাবতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পানিসম্পদ রক্ষার জন্য নদ-নদীর পানিকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। আমাদের বিশাল সমুদ্রের পরিবেশ নষ্ট হয়ে মৎস্য সম্পদের ক্ষতি যাতে না হয়, তার জন্য কর্মপন্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে। পুকুর, বিল, হাওর, হ্রদ ও দিঘির পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। পাহাড়-পর্বতের ক্ষয়রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি করতে হবে।আর
আমাদের দেশে পরিবেশ-বিষয়ক আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। এ ছাড়া আমরা নিজেরাই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন নই।শুধু আইন করে দূষণরোধ করা সম্ভব হবে না। পরিবেশদূষণ রোধ করতে হলে নিজেদেরও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমরা যদি পাহাড় না কাটি, আমরা যদি যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলি, তাহলে পরিবেশ অনেকটা রক্ষা হবে।আর পরিবেশ বিপর্যয় ও মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও প্রতিনিয়ত অ্যাজমা (হাঁপানি), ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি রোগ (সিওপিডি), ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এসবের মূলে মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। যথেচ্ছ বৃক্ষ নিধন, অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, যানবাহনের কালোধোঁয়া, জোরালো শব্দের হর্ন, আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা ও ইটভাটার অবস্থান, ইত্যাদি পরিবেশকে দূষিত করছে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test