E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্যার-ম্যাডাম-মাই লর্ড সম্বোধনে ঔপনিবেশিকতা

২০২৩ মার্চ ২৬ ১৬:৪০:৫৭
স্যার-ম্যাডাম-মাই লর্ড সম্বোধনে ঔপনিবেশিকতা

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


'স্যার শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে ১২৯৭ সাল থেকে যখন বৃটিশ রাজতন্ত্র বিশেষ ভুমিকা রাখার জন্য 'নাইট' উপাধিপ্রাপ্তদের নামের পূর্বে 'স্যার'যুক্ত করা শুরু করা হয়।কর্তৃত্ব, প্রভূত্ব ও আভিজাত্য বুঝাতে বঙ্গদেশে 'স্যার' শব্দের প্রচলন শুরু হয় ভারতে বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজরা আসার পর দেশি জনগণ কর্তৃক প্রশাসনিক কর্তাদের 'স্যার' হিসেবে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু হয় মূলতঃ শ্বেতাঙ্গ বৃটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও প্রভূত্ব স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ।

প্রায় সতেরশো শতকের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে' স্যার' প্রচলন হয়।তৎকালীন সময় বৃটিশরা এই শব্দটি ব্যবহার বেশি করতো।ইংরেজি শব্দ 'sir' এর উৎপত্তি ফ্রেঞ্চ শব্দ সায়্যার(sire)থেকে।বৃটিশরা এই উপমহাদেশ থেকে চলে ৭৫ বছর পূর্বে, কিন্তু আমাদের দেশে এখনো তাদের বৈশিষ্ট্য (যা তারা উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের উপর চালাতো) বা ঔপনিবেশিক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে, তারা যে শব্দটা উপমহাদেশে প্রচলন করেছিলো সেটা তারা নিজেরাও ব্যবহার করে স্বল্প পরিসরে।
বৃটিশরা কথা বলার সময় অপরিচিত কাউকে শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে স্যার' বলে সম্বোধন করে থাকে।আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও মি.প্রেসিডেন্ট সম্বোধন করা হয়।আমাদের দেশে শিক্ষকদের স্যার/ম্যাম বলে সম্বোধন করা হয়।কিন্তু কেউ যদি না করে তাতে নিশ্চয়ই উক্ত শিক্ষকের মনঃক্ষন্ন হওয়ার কথা না।

কথা বলার সময় স্যার সম্বোধন না করায় সমাজের উচ্চ বর্ণের লোকের দ্বারা প্রতিনিয়ত সাধারণ নাগরিক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। কোনো ব্যক্তি অবশ্যই কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে যোগদানের সুযোগ পান তাদের স্যার বলে সম্বোধন করাটা রুচিসম্মত। তবে এর মানে এই নয় যে,কথা বলার সময় অবশ্যই স্যার সম্বোধন করতে হবে।

সাধারণ নাগরিক, সংবাদকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে বিব্রত পড়েছেন স্যার সম্বোধন না করায়। বলা হয় সরকারি আমলারা জনগণের সেবক।কিন্তু এ ধরনের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা করেন তবে তারা জনগণের সেবক হন কিভাবে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বক্তৃতায় সাধারণ নাগরিকদের সম্মান করতে বলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এর উল্টোটা হচ্ছে। জনগন হয়ে যাচ্ছে দাস আর উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিরা প্রভূ রুপে আবির্ভূত হচ্ছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাজই হচ্ছে জনগণের সেবা করা।অফিসিয়াল প্রটোকল ছাড়া কাউকেই স্যার বলা উচিত না।এই কলোনিয়াল ধ্যান ধারণা থেকে যত দ্রুত বের হওয়া যায় ততই জাতির জন্য মঙ্গল। ব্রিটিশ দের রেখে যাওয়া কলোনিয়াল হ্যাংওভার যে আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের ভেতরে এখনো রয়ে গিয়েছে, একটা বড় অংশের সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদেরকে একালের জমিদার বলে মনে করেন -এগুলো হচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ

বর্তমানে 'স্যার'শব্দের সবচেয়ে বহুল ব্যবহার দেখা যায় শিক্ষাঙ্গনে। সেখানে অবশ্য এটি প্রভূত্ব বুঝানোর পরিবর্তে ব্যবহৃত হশ সম্মানার্থে। বাংলায় স্যারের পরিবর্তে আগে শিক্ষক - কে 'মাস্টারমশাই ', ' পণ্ডিতমশাই' প্রভৃতি সম্বোধন চালু ছিল যার ব্যাবহার এখন অচল।বৃটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় সম্বোধনের পুরুষ শিক্ষক কে 'স্যার' এবং নারী শিক্ষক - কে 'মিস' ডাকা বহুল প্রচলিত যেটি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় এদেশেও আত্মীয়করণ হয়েছে।

বৃটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত গিয়েছে বহু আগে,পাকিস্তানের উপনিবেশিকতা থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্ত হয়েছি - প্রায় অর্ধ শতক তবুও স্বাধীন - সার্বভৌম দেশের সত্ত্বা নিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ঔপনিবেশিক প্রেতাত্মা আজো ভর করে আছপ, নানারুপে - সম্বোধন তারই বহিঃপ্রকাশ। স্যার/ ম্যাডাম না বললে উচ্চ বর্ণের লোকেরা ক্ষেপবেন- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা এতেই অভ্যস্ত। এই পরিস্থিতি আমরাই তৈরী করেছি। পত্রিকার কলাম লেখক কে আমরা স্যার বলি, কবি /সাহিত্যিককে আমরা স্যার বলি, মেয়র- কাউন্সিলর -ইউপি চেয়ারম্যান মতে জনগণের সেবককে স্যার বকি, এমনকি ফেসবুক সেলিব্রিটিকেও স্যার বলে তৃপ্তি পাই।কোনো কবি-লেখক, কোনো শিল্পী, কোনো বুদ্ধিজীবী স্যার সম্বোধনের কখনো কি প্রতিবাদ করেছেন? কারণ 'স্যার' সম্বোধন সবাই উপভোগ করে।

ইউরোপ -আমেরিকায় যারা সরকারি চাকরী করে তাদেরকে ধরে নেওয়া হয় জনগণের সেবক। মানুষজনও টিক তেমনটিই ভাবে। কারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন দেওয়া হয়। তাই তারা সব সময় খুব বিনয়ী হয়।এটাই তো হবার কথা ছিলো আমাদের দেশেও! আমরা কিনা "স্যার", "ম্যাডাম" কেন ডাকা হচ্ছে না, এই নিয়ে ব্যস্ত! এটাই কি তাহলে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আর্দশ?

'আপনি চাকরী করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক।’ (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)

বৃটিশরা বহু দশক ধরে এই উপমহাদেশে আর সশরীরে না থাকলেও তাদের বদলে এখন যাদেরকে 'স্যার'/সাহেব সম্বোধন করা হয়। তাদের অনেকেই পেশাগত পরিচয়ে বাঙালি হলেও মন- মগজে বৃটিশদের ভাষার ছাড়া লেগে আছে-ডাক্তার, চেয়ারম্যান, জজ, ব্যারিস্টার, ইন্জিনিয়ার, ডিসি, ওসি, এমপি। এখনই সময় পরিবর্তনের নচেৎ 'স্যার' শব্দটির অতিমাত্রায় ভক্তি সমাজে সৃষ্টি করতে পারে নানা সমস্যা। প্রত্যাশা একটাই রক্তে কেনা এ দেশটির মানুষের চিন্তা- চেতনার পরিবর্তন হোক।

লেখক :সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test