E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দোহাজারীকে জেলা সদর দপ্তর ঘোষণা করা হোক

২০২৩ জুন ০৪ ১৫:৪৫:৫০
দোহাজারীকে জেলা সদর দপ্তর ঘোষণা করা হোক

গোপাল নাথ বাবুল


মোগল আমলে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ উপশহর এবং ইতিহাসখ্যাত এক বিশাল জনপদের নাম দোহাজারী। দোহাজারী নামকরণেও এক মজার ইতিহাস রয়েছে। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, আরাকান যুদ্ধে আধু খান এবং লক্ষ্মণ সিংহ হাজারী জমিদারদ্বয় শঙ্খনদীর দু’পাড়ে তাদের ২ হাজার সৈন্য দিয়ে মোগল সুবেদার শেরশাহকে সহযোগীতা করেন এবং দু’হাজার সৈন্য থেকেই দোহাজারী নামকরণ হয়। ভৌগোলিক ও যোগাযোগের অবস্থানগত কারণে নদী এবং পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দোহাজারীকে নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত করেছে। কাঠের জন্য প্রসিদ্ধ দোহাজারীতেই একটি ‘পেপার মিল’ এবং ‘জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ স্থাপন করার সম্ভাবনার কথা ১৯৬৭ সালের জরিপের সূত্র ধরে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত ৯ম ও ১০ম শ্রেণির পাঠ্য ভূগোল বইতে অন্তর্ভূক্ত ছিল যা আমরা পাঠ করেছি। এছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বৃটিশের সামরিক ঘাঁটি এবং ৯৫১ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত সুবেদার শাসিত রাজধানী ছিল এ দোহাজারী। 

এ সময়কালে ৯৫১ সাল থেকে বার্মার রাজার শাসন, ১১৬৭ সাল থেকে মগ ও পর্তুগীজ শাসন, ১৪২৫ সাল থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন খন্ডকালীন সময়ে ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্য চন্দ্রের শাসন, আফগান সুলতান মাহমুদ শাহ ও হাবশি সুলতান গৌড়ের শাসন এবং আরাকান পর্যন্ত দখলের পর ১৬০০ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত মুঘলরা দোহাজারী থেকে সমগ্র আরাকান অঞ্চল শাসন করেন। (সূত্রঃ সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেন)

১৯৮৫ সালে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনাধীন তখনকার সময়ে গঠিত এতদবিষয়ক সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ “জেলা ও উপজেলা/থানার সীমানা নির্ধারণ কমিশন’ এর নিকট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠায় দোহাজারী থানা / উপজেলার বিষয়ে সুপারিশ করার জন্য। কমিশন এ ব্যাপারে ১৯৮৫ সনের ১১ আগস্ট জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম এর সম্মেলনে সর্বস্তরের জনগণের উপস্থিতিতে শুনানী গ্রহণ করে। অতঃপর কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব কফিল উদ্দিন মাহমুদ যথারীতি দোহাজারীকে থানায় এবং উপজেলায় উন্নীত করার সুপারিশের পাশাপাশি বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার ৫টি উপজেলা নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন জেলা সৃষ্টির প্রস্তাবও করেন। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি ‘নিকার’ দোহাজারীকে থানা ও উপজেলা প্রস্তাব এবং পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলা নিয়ে নতুন জেলা সৃষ্টির ব্যাপারে প্রস্তাব অনুমোদন করে। ‘নিকার’-এর অনুমোদিত প্রস্তাব অনুযায়ী দক্ষিণ চট্টগ্রামে নতুন জেলা হলে দোহাজারীই হবে জেলা হেডকোয়ার্টার। এরপর এ ব্যাপারে সরকারি গেজেট আকারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও অদ্যাবধি দোহাজারীকে উপজেলা কিংবা জেলায় রূপান্তর করা হয়নি।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে দোহাজারীকে সদর দপ্তর করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা হলে প্রশাসনিক কাজ-কর্মসহ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দোহাজারীর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলপথ, নদীপথ ও সড়কপথে অনুকুল সুযোগ বিদ্যমান থাকায় অর্থনৈতিক বিকাশকে সমৃদ্ধ করেছে। চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক পথ এবং বান্দরবান-দোহাজারী নৌপথ পার্বত্য এলাকাকে সমতল জেলার সঙ্গে যোগসূত্র ঘটিয়ে চলেছে। বলা যায়, এত সুন্দর ও সুবিধার যোগাযোগ ব্যবস্থা দক্ষিণ চট্টগ্রামের আর কোথাও নেই। শঙ্খ নদী দোহাজারীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কর্ণফুলীর নদীর সঙ্গে মোহনা সৃষ্টি করেছে। যদি প্রশাসনের সহায়তা ও উদ্যোগে নদীটি নিয়মিত ড্রেজিং করা হয়, তাহলে অচিরেই দোহাজারী বন্দর শহরে রূপান্তরিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেল, বাংলাদেশের শেষ স্টেশন দোহাজারী থেকে বর্তমানে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে প্রকল্পের আওতায় সরকার রেললাইন বর্ধিত করে কক্সবাজার জেলার গুনধুম পর্যন্ত নেওয়ার কাজ প্রায় শেষের পথে। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় রামু জংশন রেলওয়ে স্টেশন থেকে আরেকটি রেললাইন পর্যটন বিকাশে কক্সবাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ লাইন চালু হলে দোহাজারীই হবে যাত্রাবিরতি স্টেশন ও বিশাল জংশন। সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েকমাসের মধ্যে হয়তো ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এছাড়াও ১২ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি আয়তন বিশিষ্ট দোহাজারীর বনাঞ্চল রয়েছে।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রস্তাবিত নতুন জেলা হেডকোয়ার্টারের অবকাঠামো হিসেবে দোহাজারীতে সমসাময়িককালে স্থাপিত হয়েছে ৩২/৩৩ কেভি ও ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন। নৌ পরিবহন সংস্থার আন্তর্জাতিক সাংকেতিক কেন্দ্র ডেকা চেই রেড স্টেশন, বিএডিসি’র সার, বীজ ও কৃষি সম্প্রসারণসহ যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের মহাকর্মভিত্তিক জোন, সিভিল সাপ্লাই কেন্দ্র (খাদ্য গুদাম), ভবনসহ দোহাজারী হাইওয়ে থানা, দোহাজারী সড়ক বিভাগ, বন শিল্প কারখানা, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক-বীমার জোনাল অফিস, জোনাল ডাকঘর, তহসিল অফিস, কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ, বনবিভাগের রেঞ্জ অফিস, লবণ ক্রশিং শিল্পসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক অফিস।

বর্তমানে দোহাজারীকে থানা ও পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পৌরসভার ওয়ার্ড বিভাজন সম্পন্ন হওয়ার পর গত ৪ ডিসেম্বর দোহাজারী পৌরসভার নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করা হয়। ফলে বিধি অনুযায়ী গেজেট প্রকাশের ১৮০ দিনের মধ্যে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে। সে হিসেবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আগামী ১৭ জুলাই, ২০২৩ ইংরেজি দোহাজারী পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।

দোহাজারী ও সাঙ্গু থানা বাস্তবায়নের কাজও প্রায় শেষের পথে। বিশ শতকের নব্বই দশকে ও তার পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামীলীগ, বিএনপিসহ সর্বস্তরের জনগণ কর্তৃক দোহাজারীকে জেলা করার আন্দোলন জোরদার হলে তৎকালীন সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে দোহাজারীকে সদর দপ্তর করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা করার আশ্বাস দেয়া হয়। জেলা করার জন্য মধ্যবর্তী এবং উত্তম জায়গা হিসেবে স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারগুলোও দোহাজারীকে বাছাই করেন বলে এক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। এ উপলক্ষে জেলা বাস্তবায়নের জন্য দোহাজারী লালুটিয়ায় জায়গাও নির্বাচন করা হয় বলে জানা যায়। কিন্তু শুধুমাত্র এক সময় মহকুমা ছিল, এ দাবিতে চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ১২ মাইলের মধ্যে পটিয়াকে জেলা করার জন্য পটিয়াবাসীরা আন্দোলন শুরু করলে দোহাজারীতে দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর স্থাপন করার পথে বাধা সৃষ্টি হয় এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামকে জেলা করার প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। অথচ প্রশাসনের কাজের সুবিধার জন্য দক্ষিণ চট্টগ্রামে একটা জেলা খুবই প্রয়োজন।

সুতরাং এতদ অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে এবং প্রশাসনের কাজের সুবিধার্থে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী ও উপযুক্ত জায়গা হিসেবে দোহাজারীতে সদর দপ্তর স্থাপন করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সফল প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শেখ হাসিনার কৃপা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test