E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চাটগাঁর আঞ্চলিক গানের রানী শেফালী ঘোষের ১৭তম মৃত্যু দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২০২৪ জানুয়ারি ০১ ১৬:৩৫:২০
চাটগাঁর আঞ্চলিক গানের রানী শেফালী ঘোষের ১৭তম মৃত্যু দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

গোপাল নাথ বাবুল


৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রানী খ্যাত কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী শেফালী ঘোষের ১৭তম মৃত্যু দিবস। এ গুণী শিল্পীর মৃত্যু দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি, যিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বাংলার লোকগীতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। 

এ গুণী শিল্পী ১৯৪১ সালের ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে কৃষ্ণ গোপাল ঘোষ ও আশালতা ঘোষের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তাঁর শৈশব কাটে। ৫ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন শেষে ভর্তি হন স্থানীয় মুক্তাকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯ বছর বয়সে বিশিষ্ট সংগীতানুরাগী ননী গোপাল দত্তের সাথে শেফালী ঘোষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সুকন্ঠ দত্ত ছোটন নামের তাদের এক সন্তান ছিলেন, যিনি একজন কন্ঠশিল্পী ছিলেন। কয়েকবছর আগে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের রয়েল হাসপাতালে মারা যান। আঞ্চলিক গানের এ মহান শিল্পী শেফালী ঘোষ বেশ কিছুদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ভারতের এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিকেল পৌণে ৬ টায় দেশ-বিদেশের কোটি কোটি ভক্ত-অনুরক্তকে চোখের জলে ভাসিয়ে ইহধাম ত্যাগ করেন।

পরিবারের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই তাঁর গান গাওয়া ও শেখার সূত্রপাত ঘটে। মাত্র ৭ বছর বয়স থেকে গান শেখা শুরু করে ওস্তাদ তেজেন সেন, ওস্তাদ শিবশংকর মিত্র, জগদানন্দ বড়–য়া, নীরদ বড়ুয়া মিহির নন্দী, গোপাল কৃষ্ণ চৌধুরীসহ বিভিন্ন সংগীতজ্ঞের কাছে সংগীত শিক্ষা করেন। প্রথম দিকে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি ও আধুনিক গান শিখলেও ওস্তাদ এম এন আক্তার, এম এ কাশেম, আব্দুল গফুর হালি ও সৈয়দ মহিউদ্দিনের সংস্পর্ষে আসার পর তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান, লোকগীতি, পল্লীগীতি, মাইজভান্ডারী, পীর মুর্শিদের শানে রচিত গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। হৃদয়কাড়া সুরে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ও সংস্কৃতিকে তাঁর নিজস্ব গায়কী ভঙ্গিতে দেশ-বিদেশে তুলে ধরার ফলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশ ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে। সংগীত পিপাসুদের করতালিতে মুখরিত আসর মাত করে মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের আঞ্চলিক ভাষায় গান করে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ প্রায় ২০টিরও অধিক দেশ সফর করেন। তিনি এক বিশাল জনপদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা কণ্ঠে ধারণ করেন এবং তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হতো বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবনাচরণ আর সংস্কৃতি। তাঁর গানে ছিল বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ শিকড় সংলগ্নতার বিভূতি।

প্রায় দুই শতাধিকের অধিক জনপ্রিয় এ্যালবাম প্রকাশ করা এ গুণী শিল্পীর পাকিস্তান আমলে প্রখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফীর তত্ত্বাবধানে তৎকালিন বিখ্যাত ইএমআই গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে প্রথম সংগীত এ্যালবাম বের হয়। ১৯৬৩ সালে ২২ বছর বয়সে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের স¤্রাট খ্যাত শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের সাথে চট্টগ্রাম বেতার, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান পরিবেশন করে শ্রোতাদের প্রচুর প্রশংসা পান। স্বাধীনতার পরে তিনি বীরদর্পে মঞ্চ কাঁপিয়ে সারাদেশে যাত্রায় অংশ নিয়ে নিজেকে অপ্রদ্বন্দ্বি কন্ঠশিল্পী হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তাঁর অনেক গান ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গানের মধ্যে এম এন আক্তার রচিত ও সুরারোপিত “যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম / যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম / মইশখ্যাইল্যা পান’র খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম”, মোহন লাল দাশ রচিত ও সুরারোপিত “ওরে সাম্পান ওয়ালা / তুই আমারে করলি দেওয়ানা”, কর্ণফুলি নদী সম্পর্কে লেখা ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত্ / লুসাই পাহাড়ত্তুন নামি যারগই কর্ণফুলি”, “ন বোতাই ন বোলাই গেলারে বন্ধুয়া”, বাইন দুয়ারদি ন আইস্য তুঁই নিশিরকালে / মা বাপরে লাগাই দিবো মাইনষ্যে দেখিলে”, “কি ছবি বানাইবা তুঁই আঁই ন বুঝি”, “ও শ্যাম রেঙ্গুন ন যাইও”, “পালে কি রং লাগাইলো মাঝি / সাম্পানে কি রং লাগাইলো / শঙ্খ নদীর সাম্পানওয়ালা মোরে পাগল বানাইলো”সহ চট্টগ্রামের লোকসংগীত, পল্লীগীতি, মাইজভান্ডারী, পীর মুর্শিদের শানে রচিত অসংখ্য জনপ্রিয় গান। তিনি প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে বসুন্ধরা, মালকাবানু, মধুমিতা, মাটির মানুষ, স্বামী, মনের মানুষ, সাম্পানওয়ালা, বর্গী এলো দেশে সহ যথেষ্ট চলচিত্রের গানে কন্ঠ দেন।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর যখন উপদ্রুত উপকূল মৃত্যু-উপত্যকায় পরিণত হয় তখন শেফালী ঘোষ গেয়ে উঠলেন তাঁর বিখ্যাত গান-ভাঙ্গা গাছর নয়া ট্ইেল/ পাতা মেলি দেহার খেইল/ পঙ্খী আবার উডের ফিরের/ চুপতে প্রেমের হথা হঅর। ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে এসে আবার জীবনের হাল ধরার এমন প্রেরণাদায়ী গান গেয়েছিলেন বলেই জীবনমুখী শিল্পী শেফালী ঘোষ বেঁচে আছেন কোটি প্রাণের কোলাহলে।

অসংখ্য জনপ্রিয় গান পরিবেশন করার জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯০ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক পদক, ২০০২ সালে বাংলা একাডেমি আজীবন সম্মাননা পদক, ২০০৩ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক ও ২০০৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

পরিশেষে বলা যায়, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শিল্পী শেফালী ঘোষ, যাঁর পরিচিতি রয়েছে চাটগাঁর আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী হিসেবে। একটা সময় ছিল, চট্টগ্রামের শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ আঞ্চলিক গানকে অশিক্ষিত শ্রেণির গান মনে করতেন। তারা আঞ্চলিক গানকে গানই মনে করতেন না। এতসব বৈরিতা জয় করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান গেয়ে এ কিংবদন্তি কন্ঠশিল্পী শুধু গণমানুষের মন জয় করেননি, তিনি সীমাহীন পরিশ্রমের মাধ্যমে এবং নিজের প্রতিভায় চট্টগ্রামের গন্ডি ছাড়িয়ে একেবারে বিশ্ব দরবারে চাটগাঁর আঞ্চলিক গানকে পৌঁছে দিয়ে উপমহাদেশের সঙ্গীতশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছেন। আজও দর্শক-স্রোতা মনোযোগ সহকারে তাঁর গান শোনেন। বর্তমানের অনেক শিল্পী তাঁর গান নতুনভাবে গেয়ে দর্শক মহলে পরিচিতি লাভ করেছেন।

সুতরাং আঞ্চলিক গানের রানী শেফালী ঘোষকে নিয়ে আমাদের অহংকারের শেষ নেই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক তথা লোকগীতি ও সংস্কৃতি বিকাশে শেফালী ঘোষের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, এ কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। যতদিন এ বাংলা থাকবে, ততদিন তাঁর সুর মূর্চ্ছনা আমাদের আন্দোলিত করবে। শেফালী ঘোষের কীর্তি আমাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে সংরক্ষণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test