E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ছদ্মবেশধারী সুনিপুণ দ্বিচারি চরিত্রের কবলে বাংলাদেশ

২০২৪ জানুয়ারি ২৩ ১৬:২৫:৪৫
ছদ্মবেশধারী সুনিপুণ দ্বিচারি চরিত্রের কবলে বাংলাদেশ

আবীর আহাদ


বিগত এক বছর পূর্বে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো। এসব অনুষ্ঠানের বদৌলতে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে দেখা-সাক্ষাত ঘটেছে। নাম উচ্চারণ করে তাদের কাউকে বিব্রত করতে চাই না। এসব সচিবরা ঐসব জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে  বক্তব্যের সময় ও আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য, কেউ তারা কারো বাবা-চাচা-মামা হওয়ার কথাও বেশ গর্বের সাথে স্মরণ করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কেউ কেউ বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা  মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছিলেন বলেই তারা আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সচিব হয়েছেন। জীবনে যা কল্পনাও করেননি তেমন সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। পাকিস্তান থাকলে তা কোনোদিনই সম্ভব হতো না। হয়তো কেউ কেউ বড়োজোর উপসচিব হতেন। অধিকাংশই হতেন উচ্চমান কেরানি। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সচিব সাহেবদের এহেন গালভরা কথাবার্তা শুনে আমি মনে মনে যেমন হেসেছি, তেমনি দুঃখও পেয়েছি যে, একই মানুষের চরিত্রে দু'টি রূপ তারা অত্যন্ত সুন্দরভাবে ধারণ করে চলেছেন! কতো বড়ো ছদ্মবেশধারী দ্বিচারি চরিত্রের অধিকারী তারা। যেনো 'মুমে শেখ ফরিদ বগলমে ইট'!

প্রকাশ্যে তাদের কিছু না বললেও ব্যক্তি আলাপচারিতায় যখন বলেছি যে, তারা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এতগুলো সচিব প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে বহাল থাকলেও তাদেরই 'সচিব কমিটি' কীভাবে কোন আক্কেলে মুক্তিযোদ্ধা কোটা শুধুমাত্র তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্য বহাল রেখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরির জন্য বাতিল সুপারিশ করতে পারলেন ? সরাসরি উত্তর পাইনি। তবে ইনিয়ে বিনিয়ে যা বলেছেন তাহলো, এসব ছিলো নাকি আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত! কিন্তু আমরা তো জানি, হাসিনা সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে যৌক্তিক সংশোধনে এনে বিষয়টি সম্পর্কে একটি প্রস্তাবনা পেশ করতে বলেছিলেন। এ-কাজটি সাবেক কেবিনেট সচিব শফিউল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত সচিব কমিটি কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের তথাকথিত মারমুখো আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করে তা পাশ করিয়ে নিয়েছেন! আর আমাদের বোকারাম মন্ত্রীরা তা বুঝে বা না বুঝে হোক, সচিব কমিটির সুপারিশটা মেনে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার মধ্য দিয়ে তারা মূলত: বঙ্গবন্ধুকেই অপমান করেছেন! কারণ এ কোটাটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুই।

সচিব সাহেবরা যদি এতোই মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ দরদী হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের হাতে কী করে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অবমাননা হয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমূল্যায়ন ঘটলো? তাদের যদি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এতোই দরদ থাকতো, তাহলে তো তারা কোটাটিকে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে এনে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করতে পারতেন! কিন্তু তা না করে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীতে বিবেচনা করে মূলত: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাকেও ঐসব শ্রেণীতে নামিয়ে এনেছেন! মুখে তারা যতোই বলেন মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, অপরদিকে এ প্রক্রিয়ায় তারা সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর মধ্যে নিয়ে এলেন! অথচ শুধুমাত্র স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস এলে মুক্তিযুদ্ধের ফসলভোগী অন্যান্য সবার মতো প্রজাতন্ত্রের আমলারাও মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় অহংকার বলে গুণকীর্তন করে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে মেকি সম্মান প্রদর্শন করে বলা চলে একধরনের ছদ্মবেশী দ্বিচারি চরিত্রের পরিচয় দেন!

শুধু সচিবরাই নন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবিধাভোগী উচ্চশ্রেণী সমাজের দরিদ্রশ্রেণীর অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের স্বীকৃতি ও তাদের মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে মানসিক দৈন্যতায় ভোগেন, কারণ তাদের অধিকাংশ উচ্চবিত্ত বাপ-দাদা-চাচারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে-পাকিস্তানীদের দালাল। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে তাই তারা যেমন মেনে নিতে পারেননি, সে একই মানসিকতায় আক্রান্ত আজকের তথাকথিত উচ্চশ্রেণী তাই পারিবারিক ঐতিহ্যগত কারণে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। ফলে তারা মনের দিক দিয়ে চান না যে, ঐ দরিদ্র অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিশেবে তাদের ওপরে অবস্থান করুক। কথাটি মুখ ফুটে বলার সৎসাহস তাদের নেই, তাই তারা ছলেকলেকৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বক্ষেত্রে কোণঠাসা করে রাখার জন্যে যা কিছু করণীয় তার সবই করছে। সমাজ-রাষ্ট্রের এসব উচ্চশ্রেণীর চক্রান্তের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বলা চলে বংশপরম্পরায় অবহেলিত সম্প্রদায় হিশেবে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন।

কী নিদারুণ পরিহাস যে, যারা তাদের জীবন-যৌবনকে বিসর্জন দিয়ে সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এনে দিলো, তারা থাকে গাছতলায় আর যাদের কোনোই অবদান নেই, উপরন্তু স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তারাই দু'হাতে স্বাধীনতার যাবতীয় ফসল লুটেপুটে খেয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের সম্মান ও ক্ষমতার আসনে বসে আছেন! মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ফসল ভোগ করবো, কিন্তু তাদের কোনো মর্যাদা দেবো না- এমনতর নিষ্ঠুর অকৃতজ্ঞতার অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা ডুবে আছে। আমলাতন্ত্র বা সমাজের উচ্চশ্রেণীর এ মানসিকতা বিকশিত হতে পারতো না যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক শক্তির পদস্খলন না ঘটতো। আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক শক্তি মেধা ও মননে বেশ খাঁটো। অপরদিকে তারাও আদর্শ ও চেতনাকে দূরে সরিয়ে রেখে ক্ষমতার জোরে সবকিছু গ্রাস করতে চান- এখানেই গণবিরোধী উচ্চশ্রেণীর আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপ। তারা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কোন কৌশলে অর্থ লুটপাট করে হজম করা যায়, সে ফন্দিফিকির ও কলাকৌশল নিয়ে ক্ষমতাসীন সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক শক্তির পাশে এসে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের সর্বত্র উচ্চশ্রেণীর আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তিকে একত্রে মিলেমিশে লুটপাট করার কার্যকলাপে আমরা ডুবে থাকতে দেখছি। তারা ১শ' কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার কোটি, ১০ হাজার টাকার ক্রয়মূল্য ৫০ হাজার কোটি টাকা, একটা নারকোল গাছের ক্রয়মূল্য ৯ লক্ষ টাকা, একটা ৫০০ টাকার বালিশের ক্রয়মূল্য ৬ হাজার টাকা, একটা পর্দার ক্রয়মূল্য ৩৫ লক্ষ টাকা দেখিয়ে সাগর চুরি ঘটালেও কারো কিছু হয় না! ভুয়া প্রকল্প বানিয়ে বা শিল্প-বাণিজ্যের আমদানি খাতে ব্যাঙ্কের শতশত হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতেও কিছু হয় না। বিদেশে অর্থ পাচার করা হলেও তা ধরার কেউ নেই! মূলত: ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় এতোসব লুটপাট সংঘটিত হচ্ছে। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের একটু সুযোগ সুবিধা দিতে গেলেই বাজেটে টাকা থাকে না! কী একটা ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তায়নের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হাবুডুবু খাচ্ছে তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর এসব নিয়ে ভাবনার সময় নেই। তারা ফ্রিস্টাইলে নির্দ্বিধায় সব অপকর্ম করে যাচ্ছে।

সুতরাং দেশে এভাবেই চলছে ভদ্রতা ও সভ্যতার মুখোশধারী অশুভ দ্বিচারি মানুষের সুনিপুণ কার্যকলাপ!

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test