E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রচলনের ৩৯ বছর 

২০২৪ জানুয়ারি ২৪ ১৭:১৭:২৯
কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রচলনের ৩৯ বছর 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


২৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ৩৯ বছর। কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বয়স একেবারে কম নয়, চার দশক হতে চললো। এই দীর্ঘ সময়ে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনেক উন্নতি হয়েছে। মুদ্রণ শিল্প আধুনিক হয়েছে। ছাপা পত্রিকা ঝকঝকে রূপ পেয়েছে। অনলাইনে গণমাধ্যমগুলো পাঠককে চোখের আরাম দিয়েছে। কিন্তু কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না।

দেশে কম্পিউটারের প্রবেশ ঘটে ১৯৬৪ সালে। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। মানুষের প্রয়োজনে এক সময় কম্পিউটারে এসেছে বাংলা ভাষা। আবার ব্যবহারকারীরাই এর উন্নয়ন সাধন (ডেভেলপমেন্ট) করেছেন। ফলে বাংলা ভাষা কম্পিউটারে প্রবেশ করে তা আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে।

কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন হয় ৩৯ বছর আগে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ তার মাকে বাংলা ভাষায় কম্পিউটারে টাইপ করে একটি চিঠি লেখেন। দিনটা ছিল ২৫ জানুয়ারি। ফলে এই দিনটাকে অনেকে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলনের দিন মনে করেন। সাইফুদ্দাহার শহীদ ম্যাকিন্টোশের যশোর ফন্ট এবং কি-বোর্ড লেআউট শহীদলিপি বানিয়েছিলেন। সেটি পরে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটি ব্যবহার হয়েছিল। ম্যাকরাইট নামে বাংলায় সফটওয়্যার তৈরি করে পরবর্তী সময়ে তা ২-৩টি পত্রিকা ব্যবহার করেছিল। একই সময়ে হেমায়েত হোসেন নামের একজন বাংলা ফন্ট তৈরি করেন।

১৯৮৬ সালে সৈয়দ মাইনুল হাসান তৈরি করেন মাইনুললিপি নামক একটি বাংলা ফন্ট। এর সুবিধা ছিল কোনও ড্রাইভার বা সফটওয়্যার ছাড়াই এ ফন্ট দিয়ে ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে সহজে বাংলা লেখা যেত। যুক্তাক্ষর সমস্যার জন্য তৈরি করা হয় চার লেয়ারের কি-বোর্ড।

১৯৮৭ সালের ১৬ মে আনন্দপত্র প্রকাশের মাধ্যমে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় বিজয় কি-বোর্ড। এর উদ্ভাবক ও সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, সে সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তিনি জানান, এখন দেশের প্রায় শতভাগ কম্পিউটারে বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। আর ইন্টারনেট মাধ্যমে বিজয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সফটওয়্যার ব্যবহার হয়। আর একুশে বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয় তার প্রায় সবই বিজয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে। খুবই সামান্য সংখ্যক বই প্রকাশিত হয় অন্যান্য সফটওয়্যার ব্যবহার করে।মোবাইল ফোন অপারেটর রবির লোগোর ফন্ট তার তৈরি করে দেওয়া। গ্রামীণফোন যে ফন্ট ব্যবহার করে তাও তার তৈরি। তার কথাতেই জানা গেলো, বিজয় সফটওয়্যারে রয়েছে ১০৮টি ফন্ট। বৈচিত্র্যময় সব ফন্টই রয়েছে বিজয়ে।

তবে ২০১১ ও ২০১২ সালের দিকে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে দিবস পালনের কথা শোনা গিয়েছিল। সাইফুদ্দাহার শহীদ যে তারিখে (২৫ জানুয়ারি) তার মাকে চিঠি লিখেছিলেন সেই তারিখটাকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বা নেটিজেনরা পালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

এসবের পাশাপাশি ডা. মেহেদী হাসান খানের উদ্ভাবিত অভ্র অনলাইনে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে অনলাইনে লেখালেখিতে জনপ্রিয়তা পায় সোনারবাংলা, রিদমিক ইত্যাদি।আর বাংলা ভাষা এখন আর শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষে ইন্টারনেট দুনিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতিটি শব্দ।

কম্পিউটার ছাড়াও মুঠোফোনে আমরা বাংলায় লিখছি, পড়ছি। কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রচলনেরও একটি ইতিহাস আছে।

১৯৮৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ তার মায়ের উদ্দেশে একটি চিঠি লিখেন। ৩৯ বছর আগের সেই চিঠি হাতে লেখা নয়। কম্পিউটারে টাইপ করে মায়ের কাছে প্রথম চিঠি লিখেছেন সাইফুদ্দাহার। তা-ও আবার বাংলায়।

জানা যায়, ১৯৮৫ সালের এই দিনে, ২৫ জানুয়ারি ‘শহীদ লিপি’র মাধ্যমে ম্যাকিনটস কম্পিউটারে প্রথম বাংলা টাইপ করে একটি চিঠি লেখার মধ্য দিয়েই কম্পিউটারে বাংলা ভাষা লেখার প্রচলন শুরু হয়। আর তাই এই দিনটিকে কম্পিউটারে বাংলা প্রচলন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

প্রথম বাংলা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক ছিলেন ড. সাইফ উদ দোহা শহীদ। পেশায় যন্ত্রকৌশলী হলেও বেক্সিমকোতে চাকরিরত অবস্থায় ১৯৮৩ সালের দিকে তাদের কম্পিউটার সিস্টেমের দায়িত্বে ছিলেন। তখন থেকেই তিনি বাংলা কম্পিউটিংয়ের উপর কাজকর্ম শুরু করেন। তবে বেশি দূর এগোতে পারেননি ‘শহীদ লিপি’ নামে বাংলা সফটওয়্যার।

১৯৮৪ সালে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং খানিকটা ম্যাকিনটস করপোরেশনের প্রযুক্তিগত সহায়তায় ম্যাক কম্পিউটারের জন্য বাংলা ফন্ট ‘যশোর’, কিবোর্ড লেআউট ‘শহীদ লিপি’ এবং বাংলা ইন্টারফেইসে ম্যাক সিস্টেম ডেভেলপ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি এই সিস্টেম ব্যবহার করে কম্পিউটারে প্রথম বাংলা চিঠি লেখেন তার মা’কে। এরপর ইউএনডিপিসহ প্রায় একশতটির মতো প্রতিষ্ঠান তার এই সিস্টেম কেনে এবং ব্যবহার শুরু করে।

শহীদলিপি নামকরণ নিয়ে প্রকৌশলী সাইফুদ্দাহার শহীদ একটি ব্লগে লেখেন, ‘১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ – এ চার বছর যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র – তখন প্রতিটি শহীদ দিবসে শহীদ মিনারে যেতাম প্রভাত ফেরীতে যোগ দিয়ে। শেষের বছরগুলোতে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কারণে আরও ব্যস্ততায় কাটতো ওই দিনটি। ফলে ১৯৮৫ সালে যখন লন্ডন থেকে কম্পিউটারে প্রথম বাংলায় চিঠি লিখে পাঠালাম ঢাকাতে আমার মা’কে, তখন একটা নামই শুধু মনে এসেছিল – শহীদলিপি।

বর্তমানে শহীদ লিপির প্রচলন না থাকলেও কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারে শহীদ লিপির ভূমিকা অনস্বীকার্য। শহীদ লিপির মাধ্যমেই কম্পিউটারে বাংলা ভাষার বিস্তার ঘটে। সেই চেষ্টার ফসল হিসেবে একপর্যায়ে আবির্ভূত হয় ওয়েবভিত্তিক বাংলা অ্যাপ্লিকেশন এবং সফটওয়্যার।

> বাংলা কম্পিউটিং প্রযুক্তির পরিধি অনেক ব্যপক হলেও এর প্রথম ধাপ হল ভাষার লেখ্য রূপকে কম্পিউটারে প্রবেশ করানো। আর কম্পিউটারে লেখালেখির কাজে কী-বোর্ড যেহেতু এখন অব্দি সবচে স্বীকৃত মাধ্যম, প্রবেশ করানোর কাজটা কী-বোর্ড দিয়েই হওয়া সঙ্গত

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা-প্রকাশের সরাসরি মাধ্যম হিসাবে কী-বোর্ডের অক্ষর-বিন্যাস বা লে-আউট কে হাতে লেখার বর্ণমালার সাথে তুলনা করা যায়। আজ যেমন প্রথম শ্রেনীর শিশুকে আমরা হাতে বর্ণমালা লিখতে শেখাই, অদূর ভবিষ্যতে শিশুদেরকে বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহার শেখাতে গেলে কোন একটি অক্ষর-বিন্যাস ব্যবহারে তাদেরকে অভ্যস্ত করাতে হবে। প্রশ্ন হল আমরা কোন অক্ষর-বিন্যাস শিশুদের শেখাব?

যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই, বাংলা ভাষাকে কম্পিউটারে ব্যবহারের প্রয়োজন প্রথম অনুভূত হয় প্রকাশনা শিল্পে, আশির দশকের মাঝামাঝি। তা মেটাতে তখনকার সফটওয়্যার নির্মাতারা বেশ কিছু সমাধান তৈরি করেন। সেগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল, প্রচলিত বাংলা টাইপরাইটারে ব্যবহৃত অক্ষর-বিন্যাসে যাঁরা অভ্যস্ত তাদের জন্যে শেখা সহজ কোন অক্ষরবিন্যাস কম্পিউটার কীবোর্ডের জন্য তৈরি করে তার মাধ্যমে লেখাকে কম্পিউটারে প্রবেশ করানোর ব্যবস্থা করা, এবং ছাপার যোগ্য কোন ফন্টের মাধ্যমে সেটাকে মনিটরে দেখানো বা প্রিন্টারে ছাপানোর ব্যবস্থা করা।

উল্লেখ্য কম্পিউটার সংখ্যা ছাড়া কিছু বোঝেনা, সেজন্য বর্ণমালার প্রতিটা বর্ণকে একেকটা সংখ্যাভিত্তিক কোড বা সংকেত দিয়ে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। যেহেতু ইংরেজীভাষীরা কম্পিউটার প্রথম তৈরী করে, শুরুর দিকে তাদের তৈরি ২৫৬ কোডের সংকেতমালা ascii তে ইংরেজী বা ল্যাটিন গোত্রের ভাষাগুলো ছাড়া অন্য ভাষা প্রকাশের জন্য কোন সংকেতের ব্যবস্থা তারা মাথায় রাখেনি। বিশ্বের সব ভাষার বর্ণমালাকে প্রকাশের জন্য সংকেতমালা ইউনিকোড এসেছে অনেক পরে। তাই প্রথম দিককার বাংলা-লেখনী সফটওয়্যারগুলোকে ২৫৬ সংকেতের সংকেতমালার মধ্যেই বর্ণমালাকে প্রকাশের চিন্তা করতে হয়। এছাড়াও পাশাপাশি আলাদা দুটি অক্ষরকে যুক্তাক্ষর হিসাবে প্রকাশের কোন ব্যবস্থা তখন কম্পিউটারে না থাকায় বাংলার প্রচলিত যুক্তাক্ষর গুলোকে আলাদা বর্ণ হিসেবে ধরে নিয়ে সংকেত মালা তৈরি করতে হয়।

তথাপি, একটি সর্বজনগ্রাহ্য প্রমিত কীবোর্ড-অক্ষরবিন্যাস এবং ২৫৬ সংকেতের একট প্রমিত সংকেতমালা তৈরীর ব্যাপারে কোন কারিগরী বাধা তখন ছিলনা। আর ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বর্ণমালার সাথে তুলনীয় হওয়ায় এরকম কোন অক্ষর বিন্যাসের পেটেন্ট অনুমোদনও সচেতন প্রযুক্তিবিদরা নীতিগতভাবে সমর্থন করেননি। কিন্তু বাস্তবে কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের মত ভিন্ন ভিন্ন অক্ষরবিন্যাস ব্যবহার করেন, এবং সরকারী মহলে জানাশোনার সুবাদে, একদিকে তাদের নিজস্ব অক্ষরবিন্যাস ও সংকেত মালাকে পেটেন্ট করিয়ে নেন, এবং অন্যদিকে নিজেদের অক্ষরবিন্যাস ও সংকেতমালাকে প্রমিত সংকেত হিসেবে চালু করার জন্য বিভিন্ন চতুর বিপনন পদ্ধতি এবং যোগসাজসের আশ্রয় নেন। কিছু ব্যক্তির এধরণের স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক আচরণের ফলেই প্রযুক্তিগত কোন বাধা না থাকা সত্ত্বেও সর্বজন গ্রাহ্য, মুক্তভাবে বিতরণযোগ্য এবং বিজ্ঞানসম্মত কোন অক্ষরবিন্যাস আমরা পাইনি। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এক-পর্যায়ে “ন্যাশনাল কীবোর্ড লে-আউট” নামে একটি অক্ষরবিন্যাসকে প্রমিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এর কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা নেই। তদুপরি, অন্যান্য অক্ষরবিন্যাস প্রনেতাদের কৌশলী বিপননের সাথে পাল্লা দিয়ে এটি জনপ্রিয় হতেও ব্যর্থ হয়।

আরো কয়েক বছর পরে, এই শতকের গোড়াতে বা তার কিছু আগে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট প্রযুক্তি জনগণের নাগালে আসার সাথে সাথে সেখানে নিজের ভাষায় যোগাযোগের প্রয়োজনে ব্যবহারকারীরা প্রচলিত ইংরেজী কী-বোর্ডের মাধ্যমে রোমান হরফে বাংলা লিখতে শুরু করেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে মোটামুটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী তরুণ প্রজন্ম প্রায় সর্বাংশে এরকম রোমান হরফে বাংলা লিখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।আর

ভাষা-প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন বাধা-বিপত্তির (যেমন ব্যবসা-স্বার্থসংশ্লিষ্ট আইনি বাধা পেটেন্ট এর) বিরোধিতা, সেটা আড়াল হয়ে যায়।

আমরা যদি পরবর্তী প্রজন্মের শিশুদের বাংলা ভাষায় কম্পিউটার শিক্ষার কথা চিন্তা করি, এবং যদি ৫০ এর দশকে নীতিগতভাবে রোমান বা উর্দু হরফে বাংলা লেখার বিরোধিতা করে থাকি, তবে আমাদেরকে সর্বসম্মতভাবে মুক্তভাবে ব্যবহারযোগ্য একটি বিজ্ঞানসম্মত বাংলা কীবোর্ড অক্ষর বিন্যাসের কথা ভাবতে হবে।

এই অক্ষর বিন্যাসের নিম্নোক্ত বৈশিষ্টগুলো থাকা বাঞ্ছনীয়

১) এটা সর্ব-সম্মত এবং বাস্তব-সম্মত কীবোর্ড অক্ষরবিন্যাস, যেটা সরকারী, একাডেমিক কিম্বা গণ উদ্যোগে করা হবে এবং এটি কখনো পেটেন্ট আইনের আওতায় আসবে না বা কোন পেটেন্ট ভঙ্গ করেছে বলে গণ্য করা যাবে না।

২) শিশুশিক্ষার কাজে এই অক্ষরবিন্যাসের ব্যবহার অনুমোদন এবং সরকারী/বেসরকারী প্রকাশনার কাজে এর ব্যবহার বাড়ানোর পক্ষে নীতিমালা তৈরী করতে হবে।

৩) এই অক্ষরবিন্যাস বিজ্ঞান সম্মত হতে হবে, অর্থাৎ বাংলা লেখায় সচরাচর যেসব বর্ণপরম্পরার প্রাচুর্য দেখা যায়, তাদের অনুলিখন সহজ হয় এমন হতে হবে। প্রচলিত বাংলা টেক্সট এর ভিত্তিতে এর যথার্থতা প্রমাণ করতে হবে।

৪) বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন অক্ষরবিন্যাস ব্যবহারকারীদের কাছে এটা সহজে শেখার যোগ্য হতে হবে।

৫) কী-বোর্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সহজলভ্য ১০১/১০৪/১০৫ কী এর প্রচলিত কীবোর্ড কে প্রমিত হিসেবে ধরে নিয়ে তাতে অক্ষর-বিন্যাস সাজাতে হবে, যাতে বাড়তি কোন হার্ডওয়্যার কিনতে না হয়, এবং একই কীবোর্ডে বাংলা, ইংরেজী এবং আরো অন্যান্য ভাষা একই সাথে ব্যবহার করা যায়।

৬) এর পাশাপাশি, প্রচলিত ইংরেজী qwerty অক্ষর বিন্যাসের মাধ্যমে রোমান হরফে লেখা বাংলাকে কম্পিউটারে ব্যবহার্য ইউনিকোড বাংলায় রূপান্তরের অন্তর্বর্তী-পদ্ধতি হিসেবে একটি সর্বসম্মত ফোনেটিক অক্ষর-বিন্যাস চালু রাখা যেতে পারে, যেটিও একই ভাবে সর্বজন গ্রাহ্য, মুক্তভাবে ব্যবহার্য এবং পেটেন্ট-আযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

তথ্য-প্রকৌশলী, শিক্ষক/শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশ সরকারে তথ্য-প্রযুক্তি নীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ, এবং প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করার কাজে নিয়োজিত যারা আছেন -- আসুন, উপরোক্ত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে এখনই একটি বাস্তবায়ন যোগ্য প্রকল্প হাতে নেয়া যায় কিনা, এব্যপারে আলোচনা করি।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিভিন্ন অংশ বা ধাপগুলো এরকম হতে পারে

১) একটি বিজ্ঞানসম্মত এবং বাস্তব-সম্মত কীবোর্ড অক্ষরবিন্যাস ডিজাইন করা। এটা গবেষণাধর্মী কাজ। একাজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের অন্য যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ অবদান রাখতে পারেন। বানিজ্যিক বা সরকারি প্রতষ্ঠান ও চাইলে এ-কাজে সহায়তা করতে পারেন, তবে গবেষণার রিপোর্ট মুক্তভাবে প্রকাশ করতে হবে, এবং এতে এ বিষয়ে পূর্বে যে গবেষণাগুলো হয়েছে সেগুলোর তথ্যও সংযুক্ত করতে হবে। এই অংশের ধাপগুলো হবে নিম্নরূপ -

ক) বাংলা লিখিত ভাষায় বিভিন্ন বর্ণ-পরম্পরার প্রাচুর্যের একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে।

খ) বর্ণ-পরম্পরার ভিত্তিতে কী-বোর্ডের অক্ষরবিন্যাসগুলোর কোনটি কতটা সহজে ব্যবহার্য সেটা বিবেচনার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো তুলনা করে এক বা একাধিক মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে, এবং ঐ মানদণ্ডের ভিত্তিতে বর্তমানে প্রচলিত এবং বহুল-ব্যবহৃত অক্ষরবিন্যাস গুলোর তুলনা করতে হবে।

গ) ক ও খ তে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রচলিত কী-বোর্ড গুলোর যথেষ্ট কাছাকাছি এবং বর্ণ-পরম্পরার মানদণ্ডের ভিত্তিতে যথেষ্ট মানসম্পন্ন একটি অক্ষরবিন্যাস তৈরি করতে হবে

ঘ) প্রচলিত বিন্যাস গুলোর ব্যবহারকারীদের জন্য নতুন বিন্যাসে স্থানান্তর কষ্টসাধ্য হবে না সেটা ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং ব্যবহারকালের তথ্য বিবেচনা করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ করতে হবে।

২) প্রাপ্ত অক্ষরবিন্যাসটিকে সর্বজনগ্রাহ্য করতে বর্তমান যেসব বাংলা লেখনী সফটওয়্যার বাজারে আছে, তাদের নির্মাতা/উদ্যোক্তাদের নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশ কম্পিটার কাউন্সিল বা সরকারের প্রযুক্তি-মন্ত্রণালয়ের অন্য কোন সংস্থা একাজটির সমন্বয় করতে পারে। আলোচনায় অবশ্যই (১) এ বর্ণিত গবেষকরা উপস্থিত থাকবেন, এবং তাঁদের ডিজাইনের সাথে অন্যান্য নির্মাতাদের মতামত সমন্বয় করবেন।

৩) প্রাপ্ত অক্ষরবিন্যাসটিকে জনপ্রিয় করতে এবং শিশুশিক্ষায় সমন্বিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সংশিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবেন। এটিকে পেটেন্ট আইনের আওতা বহির্ভুত ঘোষণা করতে সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থা সহায়তা করবেন।

৪) প্রাপ্ত অক্ষরবিন্যাসের ভিত্তিতে কম্পিউটারে ইউনিকোডসম্মত ভাবে বাংলা লেখা যায় এমন একটি লেখনী সফটওয়্যার নির্মাণ করতে হবে। এটির নির্মাণ-শৈলী এবং কোড উন্মুক্ত (ওপেন-সোর্স) ভাবে প্রকাশ করতে হবে এবং এটি মুক্ত-ভাবে বিতরণ এবং পরিমার্জনযোগ্য হিসাবে মুক্ত-সফটওয়্যারের লাইসেন্সের (GNU-GPL)অধীনে বিনামূল্যে বিতরণ করতে হবে। এর নির্মাতা বা অন্য কেউ একে এই মুক্ত-উন্মুক্ত পদ্ধতি ব্যতিরেকে অন্য কোনভাবে বিতরণ করতে পারবে না, এই শর্ত লাইসেন্সে থাকতে হবে। তবে এই শর্ত ভঙ্গ না করে, অর্থাৎ সফটওয়্যারের এই অংশকে মুক্ত ও উমুক্ত রেখে, এই সফটওয়্যার বা এর ভিত্তিতে নির্মিত পরিমার্জিত বা পরিবর্ধিত কোন সফটওয়্যার কেউ বানিজ্যিকভাবেও বিতরণ করতে পারেন।

এই ধাপটি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গণ-প্রচেষ্টায় করতে হবে। সম্ভব হলে কম্পিউটারকৌশলের ছাত্রদের শিক্ষা-প্রজেক্ট হিসেবে একে নির্মাণ করা যেতে পারে।

আসুন আর দেরি না করে উপরের প্রস্তাবিত প্রকল্প হাতে নিই এবং বাংলা কম্পিউটিং প্রযুক্তির এই প্রাথমিক ও মৌলিক ধাপকে নিয়ে আর কোন স্বার্থান্বেষী চক্রান্ত হবার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করি। বাংলা কম্পিউটিং প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। এই প্রাথমিক ধাপটি নিয়ে টালবাহানা অনেক হয়েছে, আর নয়।

পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমানে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারে বাংলার ব্যবহার অনেক বেড়েছে। গুগলে বাংলায় অনুসন্ধানে তথ্যের পাশাপাশি এখন ছবিও নিমিষেই হাজির হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ফেসবুকে এখন অনেকের অ্যাকাউন্ট সম্পূর্ণ বাংলায়। আসছে নতুন নতুন বাংলা ব্লগ। বাড়ছে বাংলা অনলাইন দৈনিকের পাঠকও। ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা সংবাদপত্রগুলো চালু হওয়ার পর ওয়েবে বাংলা আগের তুলনায় বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test