E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

শীতের গল্প

২০২৪ জানুয়ারি ২৬ ১৬:৪১:১৭
শীতের গল্প

গোপাল নাথ বাবুল


প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্যভেলায় আনন্দ উপাদানের কোনো কমতি নেই। ঘর থেকে দু’পা ফেলে বাইরে দৃষ্টি মেললেই চোখে পড়ে নিসর্গের অমৃত। আমাদের দেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুরঙ্গময়ী রূপসী বাংলাদেশ। ঋতু পরিবর্তনের বর্ণবিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা, রঙের খেলা, সুরের খেলা। ষড়ঋতুর এ খেলায় হেমন্তের পৌঢ়ত্বের পর আসে অন্যতম ঋতু শীত। পৌষ ও মাঘ, এ দু’মাস শীতকাল। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে শীত আসে রূপ ও রসের ডালি সাজিয়ে। শীতের মোহনীয় নৈসর্গিক রূপ ধরা পড়ে শিশির স্নাত সকাল বেলায়। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে চারপাশ। সূর্যিমামা মুখ লুকায় লজ্জায়, অভিমানে। ধীরে ধীরে মুখ বাড়িয়ে হাসে সোনালি সূর্য। ঘাসের ডগায় পড়ে থাকা শিশির বিন্দুতে রোদের আলো পড়ে মুক্তোর মতো চকচক করে।

এসময়ে দেশের বেশকিছু জেলায় বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্য প্রবাহ। ফলে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে শীতের অনুভূতি। একদিকে রোদের দেখা নেই, পড়ছে ঘন কুয়াশা। অন্যদিকে কনকনে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কমেছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এটাই শীতের তীব্রতা বাড়ার মূল কারণ। উত্তর-পশ্চিম থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় কয়েকদিন ধরে মানুষ কাবু হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে হিমেল বাতাসে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে উত্তরাঞ্চলের মানুষ।

চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জেলায় ৬.৬ থেকে ৬.৮-এর মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। তার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মতো ঝরছে কুয়াশা। বলা যায়-জনজীবন একেবারে বিপর্যস্ত। শীতের তীব্রতার কারণে ইতিমধ্যে ২ দিনের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ করা হয়েছে। উত্তরের হাওয়া রীতিমতো কাঁপুনি ধরাচ্ছে। এজন্যই বুড়োবুড়িরা বলতেন, মাঘের শীতে বাঘ ডাকে।

শীতকালেই গ্রামে শুরু হয় পিঠা উৎসব। এ শীতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে পিঠা-পুলির নাম। হিম শীতল ঠান্ডায় ভাপা, দুধপুলি, চিতই, দুধচিতই, সিদ্ধ পিঠা, রস পিঠা, তেলের পিঠা, ক্ষীরপুলি, পাটিসাপটা প্রভৃতি পিঠা রসনায় আনে তৃপ্তির আস্বাদ। শীতের পিঠায় কামড় বসিয়ে কিংবা কোচড় ভরা মুড়ি নিযে সকালের রোদকে বরণ করা অথবা সবাই মিলে গান গেয়ে রোদ পোহানো এবং সন্ধ্যা হলে সবাইকে নিয়ে খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে এক ধরণের আনন্দে মেতে ওঠা বাঙালির চিরাচরিত চরিত্র। কুয়াশাভেজা সবুজ প্রান্তরে সারাদিন খেলাধুলায় মেতে সন্ধ্যার পরে খোলা ময়দানে বৈদ্যুতিক লাইট টাঙ্গিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলায় মেতে ওঠা যেন আরেক আনন্দ।

একমাত্র শীতকালেই পাওয়া যায় খেজুরের রস। তাই ভোররাতে গাছ থেকে পেড়ে আনা টাটকা ও খাঁটি খেজুরের রস সারা শীতকাল জুড়ে খেতে ভালোবাসেন পিঠা প্রিয় বাঙালি। এসব পিঠা অন্য সময়েও তৈরি করা যায় ঠিকই, কিন্তু শীতকালে চাদর মুড়ি দিয়ে মায়ের পাশে বসে খেজুর রসে ডুবিয়ে ভাপা পিঠা এবং নলেন গুড় দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়ার স্বাধ আর কোনো ঋতুতে পাওয়া যায় না।

শীতকালে শুরু হয় বিভিন্ন মেলাসহ নাটক, কবিতা ও গান উৎসব। ছোটবেলায় দেখতাম, মাসব্যাপী শুরু হতো সারা রাতব্যাপী যাত্রাপালা বা যাত্রা উৎসব। যদিও বর্তমানে প্রায় হারিয়ে গেছে বাঙালির ঐতিহ্য ‘যাত্রাপালা’। আমাদের দোহাজারীতে চলচ্চিত্রের তৎকালীন সেরা অভিনেতা আনোয়ার হোসেন ও অভিনেত্রী আনোয়ারা অভিনীত ‘নবার সিরাজ-উদ-দৌলা’ নাটক এবং অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ‘শঙ্খ নদীর মাঝি’ কত দেখেছি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রানী শেফালী ঘোষ, কল্যানী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, সনজিত আচার্যের কত গান শুনেছি। তখনকার সময়ে চলচ্চিত্রের যেকোনো ষ্টারকে সামনাসামনি মঞ্চে অভিনয করতে দেখাটাই ছিল বিশাল ব্যাপার। অভাবের কারণে তখন সবার কপালে ধরতো না এমন নাটক দেখা। কনকনে শীতে চাদর মুড়ি দিয়ে রাত জেগে যিনি কখনো যাত্রাপালা দেখেননি, তাঁর জীবনটাই বৃথা। এ শীতেই সুফি ও বাউল ভাব-দর্শনে বিশ্বাসীরা মেতে উঠেন নানা আচার অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন মরমী সাধকদের মাজার ও খানকাকে ঘিরে শুরু হয় ওরস। আর এ ওরসকে ঘিরেই হয় মেলা।

এ সময়ে হাটবাজারগুলো ভরে উঠে সবুজ সতেজ ও টাটকা শাকসব্জিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয়- এবার তার বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছে। বাজারে শাক-সব্জির দামে যেন আগুন লেগেছে, যা নেভানোর দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। সরকারও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। ফলে দুধের স্বাধ ঘোলে মেঠানোর মতোই মানুষ বর্তমানে অল্প শাক-সব্জি কিনে দিন গুজরান করছেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা আছে মহা সমস্যায়।

শীতকালকে আবার ফ্যাশনের ঋতুও বলা হয়। কারণ, এ শীতে মানুষের পোশাকে আসে আমূল পরিবর্তন। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই গায়ে তুলে নেয় রঙ-বেরঙের হাল ফ্যাশনের চাদর, সোয়েটার, ব্লেজার, কোট, জাম্পার, কার্ডিগান প্রভৃতি। অন্যদিকে প্রচন্ড শীতের কারণে দেশের বেশির ভাগ স্থান বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষগুলোর দৈনিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের নিঃস্ব ও ছিন্নমূল মানুষগুলোকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যারা দৈনিক মুজুরি খেটে সংসার চালান, প্রচন্ড শীতের কারণে তারা তাদের কাজে যেতে পারেন না বিধায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করেন। আবার এমনো অনেক লোক আছে যাদের ঘর-বাড়ি নেই, শহরে ফুট ফরমাস খাটে আর রাতে ঘুমায় রাস্তার ফুটপাতে, তাদের জন্য শীত অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। শৈত্যপ্রবাহ থাকলে শীতের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। গরীব ও দুঃস্থ মানুষদের কষ্টের শেষ থাকে না। এ সময় বৃদ্ধ ও শিশুরা নিউমোনিয়া, হাঁফানি, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। জানা যায়, তীব্র শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে সক্ষমতার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছে। শুধু মানবকুল নয়, পশু-পাখিদেরও এমন সমস্যা হয়। বিশেষ করে গরু-ছাগলের রোগগুলোর মধ্যে ঠান্ডাজনিত রোগ খুবই মারাত্মক। এ রোগে আক্রান্ত হওয়া অধিকাংশ পশুকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে পড়ে।

ফলে গৃহহীন, বস্ত্রহীন মানুষ খোঁজে একটু আশ্রয়, প্রশান্তির উষ্ণ আদর। দরিদ্র ছেলেমেয়েরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রোদের আদরের ভরসায়। রাত জাগে সকালের প্রত্যাশায় এবং সকাল জাগে সূর্যের স্পর্শ কামনায়। তবুও সবকিছু মিলিয়ে শীতকাল হলো আমাদের কাছে প্রিয় মুহূর্ত, ভাস্বর নৈসর্গিক অপূর্ব উপাদান।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test