E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ব্যাংকের বেনামি ঋণ চিহ্নিত করা যায় কীভাবে

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ০২ ১৭:৪৯:৪৭
ব্যাংকের বেনামি ঋণ চিহ্নিত করা যায় কীভাবে

চৌধুরী আবদুল হান্নান


সম্প্রতি বেসরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদের প্রথম সভায় বেনামি ঋণের সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে; তাতে অনুমান করা যায় ব্যাংকটিতে বেনামি ঋণের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সে কারণে তাঁদের উদ্বেগও কম নেই।

ব্যাংকে বিদ্যমান একটি বড় সমস্যা তাদের নজরে এসেছে যা আশাজাগানিয়া। তবে কেবল এই ব্যাংকটিতেই বেনামি ঋণ রয়েছে তা নয়; সরকারি বেসরকারি সকল ব্যাংকের অনেক শাখাতেই এমন ঋণ রয়েছে। সুশাসন ফেরাতে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে চেয়ারম্যান করে গত ডিসেম্বরে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বেনামি ঋণ কী?

নিজের নামে না নিয়ে অন্য একজনের নাম ব্যবহার করে যে ঋণ নেওয়া হয় সেটাই বেনামি ঋণ, এখানে যার নামে ঋণটি সৃষ্টি হয়, তিনি ঋণের প্রকৃত উপকারভোগী নন। একজনের নামে দায় আর সুবিধা ভোগ করে অন্য একজন। বেনামি ঋণ অর্থ লোপাটের ব্যাংক ব্যবস্থার একটি বড় গোপন সুড়ঙ্গ।

ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বেনামি ঋণের এ সকল ছদ্মবেশী উপকারভোগীদের খুঁজে বের করার মতো একটি কঠিন কাজের শুভ সূচনা করেছে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাত খেলাপি ঋণ, বেনামি ঋণের ভারে বর্তমানে দূরবস্থায় নিপতিত; এ অবস্থায় তাঁদের এ উদ্যোগ সময়োপযোগী বলতেই হবে।

প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভিন্ন কৌশলে এবি ব্যাংক থেকে ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ বের করে নেওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়ে যাওয়ার এক চাঞ্চল্যকর তথ্য পত্রিকায় এসেছে, খেলাপি ঋণ থাকা সত্বেও জনৈক মোহাম্মদ আলী নামে এক ব্যবসায়ীর নামে এবি ব্যাংক থেকে ৩৫০ কোটি টাকা অনুমোদন হয়।তবে ঋণ ছাড় করার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পরিদর্শনে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। (সমকাল ২৫/০৫/২৩ ইং)

এখানে উল্লেখ করা প্রসঙ্গিক হবে যে, এক্ষেত্রে ঋণ বিতরণ করার পর এ জালিয়াতি ধরা পড়লে, বড় জোর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হতো কিন্ত এ ধরনের তদন্ত রিপোর্ট কদাচিৎ আলোর মুখ দেখে।

যারা ঋণখেলাপি হিসেবে ব্যাংকের রেকর্ডভূক্ত বেনামে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা তাদের মধ্যেই বেশি; ব্যাংক পাড়ায় তারা চিরচেনা মুখ এবং অন্যের নাম ব্যবহার করে ঋণ বের করার কৌশলও তাদের নখদর্পণে।

সমাজে চেনা এবং বুক ফুলিয়ে চলা অর্থ আত্মসাতকারীদেরই যেখানে পাকড়াও করার সক্ষমতার অভাব সেখানে বেনামি বা লুকিয়ে থাকা ঋণ গ্রহীতাদের খুঁজে বের করা সহজ নয়।

ব্যাংক কর্মকর্তা যারা এসব বেনামি ঋণ দেওয়ার সাথে জড়িত তাদের বড় বিপদ হবে যদি ঋণগুলো বেনামি হিসেবে প্রকাশ্যে আসে। সঙ্গত কারণেই তাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া দুস্কর।

ব্যাংকের অবস্থা সাময়িক ভালো দেখানোর জন্য খেলাপি ঋণের পরিমান কম দেখানো বা প্রকৃত তথ্য গোপন করে রাখার প্রবণতা তো তাদের রয়েছেই।

বিপদ যখন উভয়ের, ঋণ গ্রহীতা ও ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের, তখন বিষয়টি গোপন রাখতে তারা এক হয়ে কাজ করবেন।তাই বলেছিলাম, ন্যাশনাল ব্যাংক একটি কঠিন কাজে হাত দিয়েছে।

বেনামি ঋণের যে প্রকৃতি তাতে এ ভৌতিক ঋণ বিতরণের দিন থেকেই শুধু খেলাপি নয়, অপরাধমূলক খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন।

ঋণখেলাপি, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও বেনামি ঋণের সুবিধাভোগী সকলেই একসূত্রে গাঁথা এবং তারা সমাজে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। টাকা কেবল মানুষের ক্ষমতাই বাড়ায় না, বেপরোয়াও করে আর যে টাকা নিজের কষ্টার্জিত নয়, অনায়াসে হাতে এসেছে সে টাকার ক্ষমতা অনেক ব্যাপক।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৬৪ হাজার কোটি টাকার মতো বিদেশে পাচার হচ্ছে। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, এ পাচারকৃত টাকার মধ্যে ব্যাংক থেকে কৌশলে বের করে নেওয়া টাকার পরিমান কম নয়। কিছু চোর-বাটপার বিদেশে নিজেদের প্রয়োজনে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছে।

অর্থলোভী নীতিহীন লোকেরা ব্যাংক থেকে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করে যারা বিলাসী জীবন যাপন করেন, বিদেশে অর্থ পাচার করেন তারা দেশ ও জাতির শত্রু।

এমন ঋণ চিহ্নিত করতে ব্যাংকের ব্যবস্তাপনা কর্তৃপক্ষ আর একটি কাজ করতে পারেন; ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় সময় বেধে দিয়ে এই মর্মে সার্কুলার জারি করতে হবে যে, শাখায় কোনো বেনামি ঋণ থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা প্রধান কার্যালয়ে জানাতে হবে। পরে তদন্ত করে কোনো বেনামি ঋণ পাওয়া গেলে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মানুষ সাধারণত কাজ করে ভয়ে অথবা লাভের আশায়।

ন্যাশনাল ব্যাংক শুরু করেছে, শুরুটা তো হোক, শুরু না হলে শেষ হবে কীভাবে?

অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ব্যাংকের নবগঠিত পর্ষদ তাদের ব্যাংকের বেনামি ঋণের সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার সাফল্য দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের সফলতা ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক— এমন প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test