E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অমর হয়ে আছেন লতাজি

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১৬:১২:০৩
অমর হয়ে আছেন লতাজি

গোপাল নাথ বাবুল


এমনিতে বয়সের ভারে কাবু ছিলেন। তার উপর করোনা ও নিউমোনিয়ার যৌথ ধাক্কা। অবশেষে সবার প্রার্থনাকে ব্যর্থ করে মৃত্যুর কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন আজীবন কঠোর অনুশাসনে নিজেকে বেঁধে রাখা কিংবদন্তি সুর সম্রাজ্ঞী ৯২ বছরের লতা মঙ্গেশকর। ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ইংরেজি রবিবার সকালে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শাস্ত্রীয় সংগীতের মহাগুরু ও থিয়েটার জগতের প্রথিতযশা শিল্পী মারাঠি দীননাথ মঙ্গেশকর এবং সেবন্তি মঙ্গেশকরের (পরবর্তী নাম সুধামতি) ঘরে জন্ম নেয়া ভারতীয় সংগীতের দেবী খ্যাত গোল্ডেন বয়েজের অধিকারি এ স্বনামধন্য গায়িকা। সরস্বতী পুজোর ঠিক পরেরদিনই চলে গিয়েছিলেন সরস্বতীর বরপুত্রী।

৫ বছর বয়সে নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে গানকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন। কারণ, মেকআপ, আলো, লোকজন, গ্লামার একদম ভালো লাগতো না বলে অভিনয়কে বিদায় জানান লতাজি। সংগীত শিক্ষার প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন বাবার কাছে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সে বাবাকে হারিয়ে ৫ ভাইবোনের মধ্যে বড় লতাজি সংসারের সকল দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। তারপর সাধনার ধন করে নেয়া সংগীতকে তিনি উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হন। তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতের অন্যতম সেরা ও সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পে আট দশকের বেশি সময় অবদানের জন্য তিনি ‘সুরের রাণী’, ‘ভারতের পাপিয়া’ ও ‘সহস্রান্দের কণ্ঠ’-সহ একাধিক সম্মানসূচক উপাধি প্রাপ্ত হন।

১৯৪২ সালে ‘কিটি হাসাল’ নামক এক মারাঠি ছবির গানে কন্ঠ দেয়ার মাধ্যমে শুরু করে ক্রমান্বয়ে এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করে তিনি খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসেন। ভারতের ৩৬টি ভাষায় গান গাওয়ার অনন্য রেকর্ড তাঁর। ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ খ্যাত লতা মঙ্গেশকরের ধ্রুপদি থেকে রোমান্টিক, গজল, ভজন গানের প্রতিটি ধারায় ছিল স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ। ১৯৭৪ সালে তিনি গিনেস বুকে স্থান পান। প্রায় ৩০ হাজার গানে কন্ঠ দেয়া সংগীতের এ নক্ষত্রকে যাঁরা একদিন সরু কন্ঠের অধিকারি বলে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন, তাঁরাই পরবর্তীতে এ মহিয়ষীর পিছনে লাইন দিতে বাধ্য হন। কারণ, ভারতীয় সংগীত ততদিনে তাঁর কন্ঠ ছুঁয়ে অন্যতর ও ভিন্নতর উচ্চতা লাভ করেছে। প্রকাশ আছে, স্বাধীনতার পর এক অনুষ্ঠানে সুরকার কবি প্রদীপ (রামচন্দ্র নারায়ণজি দ্বিবেদী) রচিত ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগো’ গানটি পরিবেশন করার সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কেঁদেছিলেন। নেহেরু বলেছিলেন, “এই গান শোনার পর যদি কারও চোখে জল না আসে, তা হলে সে ভারতীয়ই নয়।” শুধু তাই নয়, লতাজি এ গান থেকে পাওয়া সমস্ত রয়্যালটি বাবদ অর্থ আর্মি রিলিফ ফান্ড এবং নিহত সেনাদের স্ত্রীদের জন্য তৈরি ফান্ডে জমা দেন।

শঙ্কর জয়কিষাণ, নওশাদ আলী, এসডি বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মদন মোহনের মতো সংগীত জগতের প্রবাদপ্রতিম পুরুষদের সাথে গান করেছিলেন লতাজি। জীবনের শেষ গান ছিল ময়ুরেশ পাই রচিত ‘সৌগান্ধ মুঝে ইস মিট্টি কি’। ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ মুক্তি পাওয়া এ গানটি ভারতীয় সেনাবাহিনী ও জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লতাজি কন্ঠে ধারণ করেছিলেন।

হিন্দি ভাষার পর যে ভাষায় তিনি অধিক গান করেন তা হলো বাংলা ভাষা। বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে গভীর যোগাযোগ ছিল লতাজির। সংগীত জগতের প্রবাদপ্রতিম সুর সাধক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে এসে শুদ্ধ বাংলায় গান করার জন্য শিখেছিলেন বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রসংগীত। আপন করে নিয়েছিলেন বাংলাভাষাকে। এ মহান শিল্পীর সুরে লতাজি ১৯৫৬ সালে প্রথম বাংলা গান করেন ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’। এছাড়া, সলিল চৌধুরী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ভুপেন হাজারিকা ও সুধীন দাশগুপ্তের সুরেও অনেক গান করেন লতাজি। প্রায় ১৮৬টি বাংলা গানের মধ্যে ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘ও পলাশ ও শিমুল’, ‘রঙিলা বাঁশিতে’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বেলে’, ‘কেন যেন গো ডেকেছে আমায়’, ‘ও ভগবান আমায় তুমি কোন দোষে বরবাদ কর’সহ তাঁর ১৫০টিরও বেশি গান এখনো সমান জনপ্রিয়। বাংলা গানের পাশাপাশি গভীর মনোযোগে পাঠ করতেন রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের মারাঠি অনুবাদ। উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের বাংলা ছবি মনোযোগ সহকারে দেখতেন। বাঙালি তাঁতের শাড়ি ছিল তাঁর খুব পছন্দ। একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও বিবেকানন্দের। তাঁর গলার লকেটে ছিল এ দু’মহাপুরুষের ছবি। ঠাকুরঘরে সযত্নে রাখতেন মা সারদাদেবীসহ রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ছবি।

এত যশ, খ্যাতি, সুনাম অর্জনের পরও মানসিকভাবে সুখী ছিলেন না লতাজি। এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর আবার না জন্মালে তো নেই। যদি জন্মাই তাহলে যেন লতা মঙ্গেশকর হয়ে না জন্মাই।’ সাক্ষাৎ গ্রহণকারী তার কারণ জিগ্যেস করায় হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘লতা মঙ্গেশকরের মনে যে কত কষ্ট, তা কেউ বুঝে না।’ প্রকাশ আছে, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে সুরের জাদুকর লতাজির জীবনে। ডুঙ্গারপুর রাজপরিবারের মহারাজা রাজ সিং ও লতাজি একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কিন্তু রাজসিং মা-বাবার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকায় লতাজিকে শেষ পর্যন্ত জীবনসাথী করতে পারেননি। তবে দু‘জনই আজীবন নিজেদের হৃদয়ে অন্য কাউকে জায়গা দেননি। চিরকুমার ও চিরকুমারী হিসেবে দু’জনই ইহধাম ত্যাগ করেন।

প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী প্রয়াত ভুপেন হাজারিকার সংগে সম্পর্কের কথাও জানা যায়। মুম্বাইয়ের এক প্রখ্যাত শিল্পীর সাথে সম্পর্ক ছিল বলে ভুপেন হাজারিকা তাঁর আত্মজীবনী ‘আমি এক যাযাবর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। ৫ নভেম্বর, ২০১১ সালে মৃত্যুর বছর খানেক পর তাঁর তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী প্রিয়ংবদা প্যাটেল আসামের এক টিভি চ্যানেলকে জানান, লতাজির সংগে ভুপেন হাজারিকার সম্পর্ক ছিল, যার কারণে ১৯৬৩ সালে তাঁদের ১৩ বছরের সংসার ভেঙ্গে যায়।

দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৮৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার এবং সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের জন্য দ্বিতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ১৯৬৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০০৭ সালে তিনি ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘লেজিওঁ দনরের অফিসার’ খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, ৪টি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কন্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ২টি বিশেষ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে সঙ্গীত পরিবেশন করার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সুরিনামের সাম্মানিক নাগরিকত্ব প্রাপ্ত হন। ১৯৯০ সালে পুনে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।

পরিশেষে বলবো, তাঁর সুরের জাদুতে মোহিত করেছেন আসমুদ্র হিমাচলের মানুষকে। গানের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন বিশ্বের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে। সুরের জাদুতে অমর হয়ে আছেন তিনি। এ কিংবদন্তি শিল্পীর মহাপ্রয়াণে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test