E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাঙালি জাতির উৎপত্তি

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ১১ ১৬:৩২:২৮
বাঙালি জাতির উৎপত্তি

নবী নেওয়াজ


অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষাভাষীদের ভাষা আন্দোলনের মাস সেই বাংলা ভাষাভাষীদের বাঙালির উৎপত্তি বিষয়ে আমাদের অনেকেরই জানা নাই। সেই বাঙালির উৎপত্তি কথা নিয়ে আজকের সংবাদ বাঙালি জাতির উৎপত্তি কীভাবে হলো তার সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারেনা। এসব নিয়ে গবেষক ও পন্ডিতদের মধ্যে নানা মতপার্থক্য রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদিম মানব সভ্যতার যে, রূপবিবর্তণ ঘটেছিল সেরূপ বাংলাদেশেও ঘটেছে। বাঙালি বলতে এমন একটি জাতি গোষ্ঠীকে বোঝায় যাদের জাতিগত সংস্কৃতিক পরিচয় মূলত বাংলার মাটিকে কেন্দ্র করে।

বাঙালি ও বাংলা উভয় শব্দের উৎস বাঙ্গালা থেকে যা ছিল ফর্সি ভাষায় এ অঞ্চলের নাম। পৃথিবীর বুকে বাঙালি একটি বৈচিত্রময় জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। চীনা এবং আরবীয়দের পরে বাঙালিরা হচ্ছে, পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তর জাতি-গোষ্ঠী এবং তারা ইন্দোইউরোপীয়দের মাঝে বৃহত্তম জাতি-গোষ্ঠী। বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানিদের ধারণা হচ্ছে, তারা একটি মিশ্র জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিমতম মানব গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম।

হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে, অনেকে আবার বেড়িয়েও গেছে, রেখে গেছে তাদের আগমনের অকাট্য প্রমান। বৃহত্তম বাঙালি রক্তে মিশে আছে, বহু নড়গোষ্ঠীর অস্তিত্ব। গবেষক ড. অতুলসুর তার ‘বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বাংলা অতী প্রাচীন এক দেশ। ভূতাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে প্লিওসিন যুগের পরে প্লাইস্টোসিন যুগের উদ্ভব ঘটে। বাংলায় বিভিন্ন স্থানে প্লাইস্টোসিন যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

এদিকে গবেষকদের মতে, আদিম সভ্যতার প্রাকআর্য জনগোষ্ঠী ও অনার্য জনগোষ্ঠীর সংশ্রিণে গড়ে উঠেছে আজকের বাঙালি জাতি। নৃতাত্ত্বিকগণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ১. প্রাক আর্য বা অনার্য বা আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠী। ২. আর্য জনগোষ্ঠী, প্রাক আর্য জনগোষ্ঠী সাধারণভাবে অনার্য জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত। আর্যগণ এদেশে আগমনের পূর্বে যে সকল জাতি বসবাস করতো তারাই অনার্য জাতি। এই অনার্য গোষ্ঠী বাঙালি জাতির শিকড়। অনার্য জাতিগুলো হলো: ১. নেগ্রিটো (নিগ্রোয়েড) ২. আস্ট্রিক (অট্রোলয়েড, অস্ট্রো এশিয়াটিক, নিশাদ জাতি) ৩. দ্রাবিড় ৪. ভোটচেনিয় ৫. আলপাইন (আল্পিয়)।

১. নেগ্রিটো জনগোষ্ঠী : ঐতিহাসিকদের মতে, নেগ্রিটো বা নিগ্রোয়েড হলো বাংলার আদিমতম জাতি। এদের আদি নিবাস ছিল আফ্রিকা, তারা ভারতবর্ষে কখন বসবাস শরু করে তা জানা যায় না। তবে তাদের বাংলার আদিম জনগোষ্ঠীর প্রথম স্তর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

২. অস্ট্রিক বা অস্ট্রলয়েড: তারা অস্ট্রোলিয়া বা তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে আগমন করেছিল, তাদেরকে অস্ট্রিক, অস্ট্রালয়েড, ভেদ্দিক ও নিসাদ জাতি বলা হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক অস্ট্রিকদের এদেশের প্রাচীনতম বাসীন্দা বলে অভিহিত করেছেন। অস্ট্রিকরা ৫ হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন দিয়ে আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাদের গায়ের রং কালো, মাথার গড়ণ লম্বা, চুল ঘন, নাক প্রসস্ত, উচ্চতা বেটে ও মধ্যম আকার। তারা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলতো যার আদিরূপ মুন্ড বা মান্ডারি, শাওতাল, ভীম ভাষায় কথা বলে। জুয়াঙ, কোরবু প্রভৃতি এ জাতীয় লোক এ ভাষায় কথা বলে। অস্ট্রিক জাতি নিপ্রোয়েড জাতিকে উচ্ছেদ করে বাংলায় বসবাস শরু করে। অনেক নৃতত্ত¡বিদ মনে করেন, অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। এরা কৃষি কাজ দ্বারা জীবীকা নির্বাহ করতো এবং গ্রামাঞ্চল ছিল এদের আবাস স্থল।

৩. দ্রাবিড় : জনগোষ্ঠীর সমকালে বা কিছু পড়ে প্রায় ৪-৫ হাজার বছর পূর্বে ভ’মধ্যসাগর অঞ্চল থেকে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে। এদের ভাষা ছিল দ্রাবিড়। দ্রাবিড় জাতি উন্নততর সভ্যতায় ছিল বলে তারা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করেছিল। কালক্রমে অস্ট্রিক ও দ্রারিড় জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল আর্যপূর্ব বাঙালি জনগোষ্ঠী। নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা এদের মিশ্র রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবাহমান। অস্ট্রিক-দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে যে জাতির প্রবাহর সাথে আর্যজাতি এসে সংযুক্ত হয়ে গড়ে তুলেছে বাঙালি জাতি।

৪. ভোটচেনিয় বা মঙ্গোলয়েড : এ জনগোষ্ঠী এদেশে আগমন করে দক্ষিণ ও পশ্চিম চীন থেকে। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় চাকমা, গাড়, খাসিয়া, মণিপুরি,হাজম,মড়ঙ নামে পরিচিত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আসে। এরা মঙোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর। দ্রাবিড় জাতির সাথে মঙ্গোলীয় বা ভোটচিনি জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটে আর্য আগমনের বেশ কিছু পূর্বে।

৫. আলপাইন বা আলপিয় জনগোষ্ঠী : আলপাইন জনগোষ্ঠীকে আর্যজনগোষ্ঠীর শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নৃতাত্ত্বিক ও পন্ডিতদের মতে, অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ের পর আরও একটি জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষ ও এক সময় বাংলায় বসতি স্থাপন করে। আল্স পর্বতমালা, পালির মালভ’মি ও পূর্বভারত থেকে এরা বাংলায় এসেছিল বলে তাদের হোমোআাল পাটনাস বলা হয়। জাতিতে তারা বৈদিক না হলেও আর্যভাষায় কথা বলতো। বাংলায় তারা আর্যদের আগমনের পূর্বেই উন্নত সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল। অতুনসুর বলেছেন, অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষির পড়ে বাংলায় আসে আল্পিয়রা, অনুমান করা হয়, এদের ভাষা ছিল আর্য বা ইন্দোইউরোপীয়। এরা কালক্রোমে ওড়িশা, বিহার, কাশি এবং আসামে বসতি স্থাপন করেছিল।

আর্যদের আদি বাসস্থান নিয়ে ঐতিহাসিক ও নৃতত্ত¡বিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, আর্যরা ভারতীয় আবার কেউ বলেন, আর্যরা বিদেশি। এসিদাসের মতে, আর্যরা ভারতীয়। সপ্তসিন্ধু অববাহিকায় ছিল আর্যদের বাসভুমি। ঐতিহাসিক বেশম এর মতে, আর্য একটি ইন্দোইরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর নাম এবং এই ভাষায় যারা কথা বলে তারা সাধারণভাবে আর্য নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার কোনো কোনো গবেষকের মতে, ইউরোপ হলো আর্যদের আদি বাসভূমি। অন্যদিকে জার্মান ঐতিহাসিক ম্যাক্স এর মতে, পশ্চিম এশিয়া হলো আর্যদের বাসভূমি। পশ্চিম এশিয়া হতে আর্যদের একদল এশিয়া মাইনর অতিক্রম করে ইউরোপ চলে যায় এবং অপর একদল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।

খ্রিস্টপূর্ব ১৫ শ অব্দে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বছর পূর্বে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল বলে অধিকাংশ পন্ডিত ও গবেষক মনে করেন। তবে বাংলায় তারা এসেছিল তারও অনেক পড়ে। তাদের আগমনের পর দুর্বল স্থানীয়রা তাদের ভয়ে অড়ণ্যে চলে যায়। ড. রমেশচন্দ্র বলেন, তবে অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দী বা তার পূর্বে যুদ্ধযাত্রা, বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচার উপলক্ষে ক্রমশঃ বহু সংখ্যক আর্য আগমন ও বসবাস করেন। আর্যরা ছিল বলিষ্ঠ ও সুঠাম দেহের অধিকারী। আর্যদের ভাষা, ধর্ম, সামাজিক রীতি-নীতি, সংস্কার বাংলার জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। মৌর্য বংশ থেকে গুপ্ত বংশের অধিকার পর্যন্ত খ্রিস্টীয় ৫শ অব্দ পর্যন্ত সময় মোট ৮শত বছর ধরে বাংলায় ক্রমেক্রমে আযিকরণের পালা চলে। ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে গুপ্তযুগে বাংলাদেশে ভাষা ও সংস্কৃতির দৃঢ়মূল হয়। আর্যিকরণের পর খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীতে সিন্দু বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আসে আরবিয় মুসলমানেরা।

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বকতিয়ার খিলজির নদীয়া দখলের পর বাংলায় আগমন ঘটে খিলজি বা তুর্কি মুসলমানদের। বাংলায় আসতে থাকেন আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের বণিক, সুফি, সাধকগণ। এদের অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে আসেন এবং বাংলায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তাদের প্রচারিত ইসলামে সাম্য ও মৈত্রীর বাণীতে আক্রিষ্ট হয়ে জাতিভেদ প্রথায় জর্জরিত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধমের উঁচু ও নিচু শ্রেণীর মানুষেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তুর্কি ও আরবীয়রা ছাড়াও সুদুর আবিসিনিয়া থেকেও অনেক মুসলমানেরা বাংলায় এসেছিল। ১৪৮৩ থেকে ১৪৯৩ পর্যন্ত সময় কালে আবিসিনীয়রা যাদেরকে হাফসি বলাহয়। তারা বাংলায় শাসন ক্ষমতায়ও অধিষ্ঠিত হয়েছিল।এরপর ১৬ শতকে বাংলায় আসে সুর বংশীয় ও পররানী আফগানরা, তারাও বাংলায় শাসন ক্ষমায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আফগানরা বাংলায় বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করে জনগণের সাথে অনেকটা মিশে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে পাঠান, লোহানী, খান ইত্যাদি উপাদি আফগানদের থেকে পাওয়া। এরপর ভারতবর্ষে আসেন মোগলরা, যাদের দেহে চেঙ্গিস খান ও তৈমুর লঙের রক্ত প্রবাহিত। সম্রাট আকবর ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলায় তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মোগলরা ধীরেধীরে বাংলার জনগণের সাথে মিশে যায়। এরপর শুরু হয় বাংলায় নবাবী আমল। বাংলায় নবাব আলীবর্দি খান, নবাব সিরাজদৌলা, মীরজাফর আলী খাঁ, মীর কাশেম আলী খাঁ ছিলেন পারশ্য বা ইরান থেকে আসা শিয়া সম্প্রদায়। মোগল আমলে প্রচুর শিয়া মুসলমান পারশ্য থেকে ভারতবর্ষ ও বাংলায় এসেছিলেন। এরপর বাংলায় আসে, পর্তুগীজ, ফ্রেন্স, ইংরেজ প্রভৃতি ইউরোপীয় জনগণ। তারা বাংলায় স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন না করলেও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, শাসন পদ্ধতি, বাংলার জনগণের উপর স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলে। তাই বাঙালির রক্তে মিশে আছে বহু বিচিত্র সব নড়গোষ্ঠীর অস্তিত্ব।

পৃথিবীর প্রচীন নড়গোষ্ঠীগুলোর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। দীর্ঘকাল এই আদি নড়গোষ্ঠীগুলো বাংলার বিভিন্ন বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছে। একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয়েছে, শতকের পর শতক ব্যাপী। ফলে আজকের বাঙালি জাতি শঙ্করায়নের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে একটি আলাদা সক্রিয় বৈশিষ্ট নিয়ে বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়েছে। এ জন্য বাঙালিদের দেহের বিভিন্ন অংশ ভিন্নভিন্ন নড়গোষ্ঠীর চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। এমনিভাবে অন্তত: দেড় হাজার বছর ধরে গ্রহণ, বর্জন, ও রূপান্তরের মাধ্যমে নেগ্রিটো, আস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, আলপাইন, আর্য ও সেমেটিক ইত্যাদী নড়গোষ্ঠীর রক্তধারার সংমিশ্রণে আজকের বাঙালি জাতির উদ্ভব ঘটেছে আর এ কারণে বাঙালি জাতিকে শঙ্কর জাতি বলা হয়।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test