E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পরমেশ্বর মহাদেবের মহিমা

২০২৪ মার্চ ০৯ ১৬:৩১:২৬
পরমেশ্বর মহাদেবের মহিমা

গোপাল নাথ বাবুল


প্রতিবারের মতো এবারও ৮ মার্চ পালিত হলো শিব চতুর্দশী। সারাবিশ্বের সকল সনাতনী সম্প্রদায় মেতে উঠেছিলেন সত্যম, শিবম, সুন্দরের আরাধনায়। পরমেশ্বর ভগবান শিব পরমব্রহ্ম। তাঁর জন্ম-মৃত্যু নেই। তিনি অনাদি এবং দেবেশ। তিনি যেমন কোটি সূর্যসম তেজসম্পন্ন তেমনি কোটি চন্দ্রসদৃশ শীতল ও প্রশান্ত। আবার দেবাদিদেব মহাদেব প্রলয় বা ধ্বংসের প্রতীক। ত্রিশক্তি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, এ তিনের মধ্যে মহেশ্বর অতি সদাশয়, আত্মভোলা, শ্মশানবাসী। তিনি রজতগিরি সদৃশ অর্থাৎ শুভ্রবর্ণ, অর্ধচন্দ্র বিভূষিত ললাট, নানা রত্নবিভূষিতাঙ্গ, পরশু, মৃগ বর এবং অভয়হস্ত, প্রশান্ত মূর্তি, পদ্মাসনে উপবিষ্ট অমর বৃন্দদ্বারা সংস্তুত, ব্যাঘ্রচর্ম সমন্ধ কটিদেশ, অনন্ত ব্রহ্মান্ডের আদি এবং বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের কারণ, সংসার ভয় তারণ, পঞ্চানন, ত্রিনয়ন। সনাতনীরা এ শিবকেই ধ্যান করেন। শিবমহাপুরাণ অনুসারে, যে রাত্রে শিব সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের মহাতান্ডব নৃত্য করেছিলেন, সেটাই হল মহাশিবরাত্রি। আবার সেই রাত্রেই শিব ও পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। এর নিগুঢ় অর্থ হলো শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তি বা পরাপ্রকৃতির মিলন।

বলা হয়, অল্পতেই তুষ্ট করা যায় দেবাদিদেবকে। শুধুমাত্র একটি বেলপাতাতেই তুষ্ট হন শিব, এমন একটি গল্প সনাতনী সমাজে প্রচলিত আছে। শিবরাত্রি ব্রত সৃষ্টির পিছনে রয়েছে এক ব্যাধের গল্প। বারাণসী নগরে এক ব্যাধ বাস করতেন। তিনি পশু-পাখি শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ফাল্গুন মাসের চতুর্দশী তিথিতে তিনি শিকারে বের হন। কিন্তু সারাদিন কোনও শিকার না পেয়ে রাত্রিবেলা এক বিল্ববৃক্ষের ডালে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাত যতই গভীর হতে থাকে ততই তিনি শীতে ও ক্ষুধায় কাতর হতে থাকেন। তিনি যে গাছের ডালে বসেছিলেন সেই গাছের নিচে ছিল একটি শিবলিঙ্গ। প্রচন্ড ক্ষুধায় ও শীতে কাতর ব্যাধ কাঁদছিলেন। তাঁর চোখের পানির চাপে (কারও কারও মতে, ব্যাধের শারীরিক নড়াচড়ার ফলে) একটি বিল্বপত্র ওই শিবলিঙ্গের ওপর পড়ে। এতেই দেবাদিদেব প্রসন্ন হয়ে ওই পূজা গ্রহণ করেন। ব্যাধ নিজের অজান্তেই শিবকে সন্তুষ্ট করেন। মৃত্যুকালে যমদূতরা যখন ব্যাধকে নিয়ে যেতে চাইলেন তখন শিবের অনুচররা বাধা প্রদান করেন এবং ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে যান। সারাজীবন ব্যাধ হিংসাত্মক কাজ করার পরেও অজ্ঞানবশত শিবকে পূজা করার ফলে রুদ্রলোকে স্থান পান শিবের দয়ায়। আত্মভোলা শিবের এমন মাহাত্ম্যের জন্যই শিবের আশীর্বাদ লাভ করতে সনাতনীরা নিয়মিত শিবপূজা করেন।

সনাতনীরা যে শিবলিঙ্গের পূজা করেন সে জ্যোতির্লিঙ্গ মূলত পরমাত্মা শিবেরই প্রতীক। যেহেতু পরমাত্মা জ্যোতিস্বরূপ নিরাকার সেহেতু জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে মন্দিরে মন্দিরে তাঁর পূজা ও আরাধনা করা হয়ে থাকে। “শিবং কল্যাণং বিদ্যতে হি অস্য শিব।” অর্থাৎ যার দ্বারা সমস্ত কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে তিনিই শিব। ঋক মন্ত্রে তিনি ঈশান অর্থাৎ জগতের ঈশ্বর, পৌরাণিক তন্ত্রেও তিনি ঈশান নামে পরিচিত। তিনি জগৎ পিতা, জগৎ পতি দেবাদিদেব মহাদেব। তাই শিবঠাকুর সনাতনীদের জীবনে এক মহান আদর্শ।

এ রাত্রিকে শিবরাত্রি মহোৎসবও বলা হয়। কারণ, তিনি রাত্রি অর্থাৎ এ বিশ্ব যখন ধর্মের গ্লানিতে ও পাপাচারে আছন্ন হয়ে তমোপ্রধান হয়ে যায়, তখন শিব পরমাত্মা তাঁর দিব্য অবতরণ দ্বারা এবং জ্ঞান ও রাজযোগের শিক্ষা দ্বারা বিশ্বের অন্ধকার দুর করে আলোর তথা সত্যপ্রধান বিশ্ব স্থাপনার কার্য করে থাকেন বা করে যাচ্ছেন। সেজন্য এ রাত্রিকে মহাশিবরাত্রি মহোৎসবও বলা হয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী শিবলিঙ্গের আরাধনা, ব্রত, উপবাস ও পূজা করা হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য হলো মহাদেবের বর দানে ভরপুর সব কালকণ্টক দুর করা। কারণ, তিনি সর্ব আত্মাদের পিতা। এক ও অভিন্ন, অবিনশ্বর ও পরমজ্যোতি পরমেশ্বর, সর্ব দেবদেবীরও উপাস্য। পুণ্যাত্মা, পাপাত্মা, মহানাত্মা, দেবাত্মা অনেক পরমাত্মা এক এবং পরমধাম নিবাসী। পরম কথার অর্থ হলো শ্রেষ্ঠ।

পুরাণে মহেশ্বর শিবের স্থান অতি উচ্চে। তার মহিমা অনন্ত ও অচিন্ত্যনীয়। শিবপুরাণের এক আখ্যায়িকা অনুসারে স্বয়ং ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুও লিঙ্গরূপী শিবের-আদি-অন্ত সন্ধান করতে পারেননি। শিব পুরাণের আরেক স্থানের বর্ণনানুযায়ী ‘শিব’ শব্দের ব্যাখ্যা দৃষ্ট হয়। শ, ই, ব- এ তিনটি বর্ণের সমন্বয়ে শিব শব্দটি নিষ্পন্ন। ‘শ’ কার শব্দের অর্থ নিত্য সুখ ও আনন্দ, ‘ই’ কার শব্দের অর্থ পুরুষ এবং ‘ব’ কার শব্দের অর্থ অমৃতশক্তি। শিবের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী কেউ নেই। তিনি স্বয়ম্ভু জীবসমূহ তার সমীপেই মহা ঐশ্বর্য যাজ্ঞ করে, তাই তার নাম মহেশ্বর। তিনি সকল জীবের প্রভু, তাই তাঁর এক নাম ঈশান। তিনি ষড়ৈ শ্বর্য্যশালী, তাই তিনি ভগবান। দেবগণ বন্দিত, তাই তিনি মহাদেব। ধূরূপী বলে তিনি ধূর্জটী। মানুষের নিয়ত মঙ্গল কামনা করে বিবিধ কর্মের দ্বারা তাদের উন্নত করেন বলে তিনি শিব। পশুদের অধিপতি ও পালনকর্তা রূপে তিনি পশুপতি। ডমরু এর প্রিয় বাদ্য, কৈলাস প্রিয়ধাম, প্রমথগণ প্রিয় সহচর। হলাহল পানে নীলকণ্ঠ হেতু তিনি ‘নীলকণ্ঠ’। সর্বগুণাম্বিত আসক্তি বর্জিত, সদা সন্তুষ্ট আনন্দময় শিব। শিবের অধিষ্ঠান ভূমি শিবলোক নামে খ্যাত। বিষ্ণুপুরাণ মতে, ব্রহ্মলোক ও বিষ্ণুলোকের বহু উর্ধ্বে শিবলোক। শিবভক্তরা শিবের মধ্যেই সর্বদেবতার অধিষ্ঠান দর্শন করেন।

শিবপুরাণ, জ্ঞান-সাহিত্যের ২৮৩ পৃষ্ঠায়, স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সতী পার্বতী, দেবরাজ ইন্দ্র, দেবাদিদেব মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেন, কোন ব্রত অথবা পূজা করলে আপনি সন্তষ্ট হয়ে দেব-দানব-মানবদের সর্বকষ্ট থেকে মুক্তি দেন? ভূবনমোহন হাসি হেসে ভূবনভোলানো শংকর বললেন, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথির রাত্রিটির নাম শিবরাত্রি। তাই এ রাত্রিতে পঞ্চামৃত, উপবাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে শিবপূজা করলে মানুষ আমার কৃপা সর্বাধিক লাভ করবে। স্নান, মন্ত্র, জপ, পূজা, ধ্যানের চেয়েও শিবরাত্রির উপবাসে আমি সর্বাধিক প্রসন্নতা লাভ করি। ব্রাহ্মণ-শৈব-বৈষ্ণব-শূদ্র-নারী-কুমারী-আশ্রমিক সকলের উত্তম ধর্ম সাধন কর্ম হয়। ত্রিবিধ পাপ নাশ হয়। আধিভৌতিক কোনও অশুভ বাধা মানবজীবনকে স্পর্শ করতে পারে না। পঞ্চামৃত দ্বারা স্নান, নানাবিধ ফল, পুষ্প-চন্দন সহ নিবেদনে ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপও খন্ডন হয়।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র সবাই শিবের আরাধনা করেছিলেন। মহাভারতের শান্তি পর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ‘হে অর্জুন, আমি যদি বরদাতা শিবের অর্চনা না করি তাহলে কেহই আমার অর্চনা করবে না।’ শ্রীকৃষ্ণ আরও বলেছিলেন, ‘রুদ্র (শিব) ভিন্ন আর কেহই আমাকে বর প্রদান করতে সমর্থ নহে।’ গীতায় ভগবান বলেছেন-আমার জন্মদিব্য, আমার কর্মদিব্য, আমি প্রকৃতিকে বশ করে অব্যক্ত প্রবেশ দ্বারা এ জগতে ধর্ম স্থাপনা করি ও লুপ্তপ্রায় জ্ঞান শোনানোর জন্য যুগে যুগে এসে থাকি। পরমাত্মা শিব হলেন স্বয়ম্ভু। তাঁর জন্ম-মৃত্যু নেই। তিনি মাতৃগর্ভের মাধ্যমে এ ধরাধামে আসেন না। তাই পাপ-পুণ্য বা কর্ম-অকর্ম তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনা। পরকায়া প্রবেশের মাধ্যমে এ ধরাধামে এসে সত্যধর্ম স্থাপনার কাজ করে থাকেন। পরমাত্মা শিবের প্রতীকী চিহ্নরূপে শিবলিঙ্গের পূজা হয়ে থাকে।

ভগবানুবাচ, যিনি গীতা জ্ঞান (পরমাত্মার দেওয়া জ্ঞান ধারণ) ও রাজযোগের নিয়মিত অভ্যাস করবে, তিনি সমস্ত আসুরিক বৃত্তি ও বিকারকে জয় করে নতুন সৃষ্টিতে দেব-দেবীরূপে রাজভাগ্য প্রাপ্ত হবে। সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর, কেদারনাথ, ভীমাশংকর, বিশ্বনাথ, ব্রহ্মকেশর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর, ঘুষেনশ্বর, এ দশ নামের যে নামেই ডাকি না কেন, তিনি আত্মারূপী সন্তানদের মনোষ্কামনা পূর্ণ করে দেন।

শিব হলেন, সত্যম-শিবম-সুন্দরম বা সৎ-চিৎ-আনন্দ স্বরূপ, যা অন্য কারোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ সৃষ্টিতে তিনটি সত্য চিরন্তন। পরমাত্মা সত্য, আত্মা সত্য, প্রকৃতি সত্য। কারণ, এ তিনের বিনাশ নেই। না চাইতেই যিনি সবকিছু দিয়ে দেন, তাঁর কাছে চাওযার কী আছে। তাইতো মহাকবি কালিদাস বলেছিলেন, “মেঘ থেকে বৃষ্টি, ফুল থেকে ফল, কারণ থেকে কার্য হয়, কিন্তু হে প্রভু! তোমার প্রসাদের যোগ্য না হয়েও সম্পত্তির অধিকারী হয়ে গেলাম।”

সুতরাং এবারের মহা শিবরাত্রি মহোৎসব বিশ্ববাসীর জন্য শান্তি ও সম্প্রীতি বয়ে আনুক। এমন কামনাই করছি দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। শুভায়ু ভবতু।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test