E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধুর মানবতা ও বিশ্বশান্তির দর্শন এক সূত্রে গাঁথা

২০২৪ মার্চ ১৫ ১৬:৩৫:৫৩
বঙ্গবন্ধুর মানবতা ও বিশ্বশান্তির দর্শন এক সূত্রে গাঁথা

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


১৭ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়েছিলেন যে খোকা, তিনিই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন জাতিরূপে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেন বঙ্গবন্ধু। যে নেতার জন্ম না হলে আমরা হয়তো কখনোই স্বাধীনতা পেতাম না, সেই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

কবির ভাষায় বলা যায়- 'জন্মেছিলে তুমি, তাই জন্মেছে এই দেশ।/মুজিব তোমার আরেকটি নাম স্বাধীন বাংলাদেশ।'

বঙ্গবন্ধু আজীবন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বারবার কারাবরণ করেছেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, মামলা-হামলা সবকিছু উপেক্ষা করে নিজ আদর্শে অবিচল থেকেছেন। অন্যায়ের সঙ্গে তিনি কখনও আপস করেননি। কখনও মাথা নত করেননি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বাঙালির অধিকারের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন- 'আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ।'

একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্বই খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষে আমি ঘোষণা করিতেছি, আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ।'

বিশ্বসন্মোহনী নেতাদের নামের তালিকায় বাঙালি জাতিসত্তার ধারক এবং স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সবার আগে। তিনি তাঁর অসামান্য নেতৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস, দেশপ্রেম ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি নতুন মানচিত্র উপহার দিয়েছেন। বাঙালিদের মানবাধিকার রক্ষায় তিনিই ছিলেন পথ প্রদর্শক।

বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার- এই দুটি শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর জন্মই হয়েছিল মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য। শৈশব থেকে আমৃত্যু তিনি মানবাধিকারের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি মানবদরদী ছিলেন। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল, দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি থাকে। কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদের কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন- “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যাক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।”

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনে কলঙ্কময় এক কালো অধ্যায়। ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না। সত্য কখনও আড়াল করা যায় না। সত্য বারবার উদ্ভাসিত হয়, প্রস্টম্ফুটিত হয়, উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো আগামীর পথ প্রদর্শন করে। যারা সেদিন ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাস থেকে, বাঙালির হৃদয় থেকে, তাঁর নাম মুছে ফেলা যায় তাদের উদ্দেশে কবি শামসুর রহমানের ভাষায় বলতে চাই - 'ওরা তাঁকে হত্যা করে ভেবেছিল তিনি সহজে হবেন লুপ্ত ঊর্ণাজাল আর ধোঁয়াশায়, মাটি তাকে দেবে চাপা বিস্মৃতির জন্মান্ধ পাতালে। কিন্তু তিনি আজ সগৌরবে এসেছেন ফিরে দেশপ্রেমিকের দৃপ্ত উচ্চারণে, সাধারণ মানুষের প্রখর চৈতন্যে, শিল্পীর তুলিতে, গায়কের গানে, কবির ছন্দের আন্দোলনে, রৌদ্র ঝলসিত পথে, মহা মিছিলের পুরোভাগে।'

কল্যাণমুখী দর্শনের ধারক বঙ্গবন্ধু লন্ডভন্ড ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর পর দেশের হাল ধরে চেয়েছিলেন একটি শোষণহীন উন্নত-সমৃদ্ধ সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করবেন, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলবেন, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি আনবেন, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, মানুষের মৌলিক অধিকার (সংবিধানে বর্ণিত) প্রতিষ্ঠা করে তাদের ভাগ্য বদলসহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করবেন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ অপবাদ থেকে মুক্ত করে বিশ্বের মানচিত্রে মর্যাদার আসনে বসাবেন।

মানব মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অগ্রদূত। সহস্র বছরের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তির মহান ব্রত নিয়ে। উচ্চারণ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নিজ জন্মভূমির অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষকে তিনি ধীরে ধীরে সংগঠিত করেছিলেন মুক্তির মন্ত্র শুনিয়ে। ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড়ে বাঁধা একটি পশ্চাত্পদ জাতিকে তিনি বিদ্রোহের, বিপ্লবের দীক্ষা দিয়ে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেছিলেন। জাতিকে তিনি সাহসের অভয়ারণ্যে তুলে এনেছিলেন সংগ্রামী চেতনায়। তাই প্রশিক্ষিত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রণাঙ্গনে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্ব মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল সেই ১৯৭১ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব পর্যায়ের নেতায় পরিণত হলেন। জন্মেছিলেন এ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর হূদয়ে ধারণ করেছিলেন পুরো বাংলাকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিংশ শতাব্দীতে এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের নাম। আমরা যারা তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছি, তাঁর বক্তব্য ও নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়েছি, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের মধ্যে সেই অমর ও অমোঘ প্রভাব অটুট রয়েছে। সেই ষাটের দশক থেকেই আমার মতো অনেককে তিনি স্বাধিকারের পথ ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আমরা তখনই নিশ্চিত ছিলাম, হাজার বছরের বঞ্চিত বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা এসে গেছেন।

বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ শুধু নয়, এ ভাষণ বিশ্ববাসীরও সম্পদে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববাসী চিনত বাংলাদেশ মুজিবের দেশ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন লাখো বাঙালির দুর্বার কাণ্ডারি, মহীরুহের রূপকথার মহানায়ক। তিনি বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও আপন জ্ঞান করতেন। সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

লেখক : উপপরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test