E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস 

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান

২০২৪ এপ্রিল ১৬ ১৫:১০:৪৭
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকারের গুরুত্ব ও অবদান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


১৭ এপ্রিল বুধবার ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস ২০২৪। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। পরে এই বৈদ্যনাথতলাকেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর নামকরণ করা হয়।

একই বছরের ১০ এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এ দিন গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।

সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। মুজিবনগর সরকারের শপথের দিন ১২ জন আনসার সদস্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। পর দিন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন। তার এই ভাষণ আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচার হয়।

ওই ভাষণে দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন তাজউদ্দীন। এছাড়া ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বেআইনিভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।

পরে একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ন্যায়-নীতি বর্হিভূত এবং বিশ্বাস ঘাতকতামূলক যুদ্ধ শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

তারই ধারাবাহিকতায় ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার মুক্তাঞ্চলে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এক বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ায় দুই ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান বিমানবাহিনী বোমাবর্ষণ ও আক্রমণ চালিয়ে মেহেরপুর দখল করে। ফলে, অস্থায়ী সরকার ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় এবং সেখান থেকে কার্যক্রম চালাতে থাকে। ১৮ এপ্রিল মন্ত্রী পরিষদের প্রথম সভায় মন্ত্রীদের দফতর বন্টন করা হয়। মুজিব নগর সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মুজিবনগর সরকার। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। নিচে মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা আলোচনা করা হলো।

১. মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ও আনুষ্ঠানিকতা প্রদান : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করে। এই গণহত্যা প্রতিরোধে বাঙালি জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই প্রতিরোধ যুদ্ধকে আনুষ্ঠানিকতা প্রদান করে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে

২. মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয় : মুজিবনগর সরকার মুক্তিবাহিনীকে একটি সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সরকারের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্ন সেক্টরে বিভক্ত করে তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ফলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।

৩. আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় : মুজিবনগর সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সরকারের নেতৃত্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। ফলে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

৪. ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা : মুজিবনগর সরকার ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই সরকারের অনুরোধে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে। ফলে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।

৫. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধান প্রণয়ন : মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধান প্রণয়ন করে। এই ঘোষণাপত্র ও সংবিধান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে। এটি ছিল মূলত স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের প্রথম ঘোষণাপত্র। আর এই সংবিধান প্রণয়ন বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে।

৬. বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ : মুজিবনগর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালায়। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়। আর এই কাজে ভারত সরাসরি মুজিবনগর সরকারকে সাহায্য করে।

৭. মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ : মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেমন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, গেরিলা বাহিনী গঠন, সম্পূর্ণ দেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্তিকরণ ইত্যাদি। এই সিদ্ধান্তগুলি মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৮. মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা : মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য বিভিন্ন প্রচারণা চালায়। এই প্রচারণার ফলে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহিত হয় এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, দল-মত নির্বিশেষে ঝাঁপিয়ে পরে।

৯. মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সাহস ও ত্যাগ স্বীকার : মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সাহস ও ত্যাগ স্বীকার করায় দেশপ্রেমিকদের সম্মানিত করে। এই পদক্ষেপের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের মনোবল বৃদ্ধি পায়। আর বাংলাদেশ পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলে অবশেষে স্বাধীন হয়।

১০. মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করা : মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করে। এই ব্যবস্থার ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষিত হয়। রচিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন বই। আর তাই বর্তমানের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে।

১১. মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতির পরিকল্পনা করা : মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতির পরিকল্পনা করে। এর মধ্যে ছিল পুনর্বাসন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় ও স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়ন। এই পরিকল্পনার ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি সুসংগঠিত ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

১২. বিভিন্ন গণমাধ্যম পরিচালনা : মুজিবনগর সরকার স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে থাকে। তারা দেশাত্নবোধক গান সম্প্রচার করতে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতো মুজিবনগর সরকার।

তাই মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি মাইলফলক যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে 'জীবন ও বৈধতা' দিয়েছে। জাতির জনক কারাবন্দি অবস্থায় তারই দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যে মহান নেতারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test