E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গরমে বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি, প্রয়োজন জনসচেতনতা

২০২৪ এপ্রিল ২০ ১৬:১১:২৮
গরমে বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি, প্রয়োজন জনসচেতনতা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে দেশের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এ সময় ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত গরমে হতে পারে হিটস্ট্রোক, পানিশূন্যতার মত মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা। তীব্র গরমে কিছু নিয়ম মেনে চলে নিজের ও পরিবারের সকলের সুস্থতা নিশ্চিত করুন। 

গ্রীষ্মের এ তীব্র গরম ও হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে বেশ কিছু টিপস মেনে চলতে হবে। তাহলে চলুন প্রথমেই জেনে নেই, হিটস্ট্রোক কী?

সাধারণত, দেহের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায় থেকে অতিরিক্ত বেড়ে গেলে হিটস্ট্রোক হয়। হিটস্ট্রোক হলে, ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে শরীরের তাপমাত্রা ১০৬° ফারেনহাইট বা তার বেশি পৌঁছাতে পারে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, বেশি সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রায় থাকলে হিটস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এই পর্যায়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, বৃক্ক ও পেশির ক্ষতি হতে পারে।আর মানুষের শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তৈরি একধরনের জটিলতার নাম হিট স্ট্রোক। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এটি ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের চেয়ে বেশি হলেই হিট স্ট্রোক হতে পারে। এ সমস্যায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা না পেলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।হিট স্ট্রোক হলো এমন একটি চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা যার ফলে শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পরাটা অস্বাভাবিক নয়। একথা কে না জানে যে গরম একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে এমন কিছু সমস্যাকে যা বাস্তবিকই ভয়ের বিষয়। যেমন ধরুন অতিরিক্ত গরমের কারণ যে কোনও সময় হিট স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে ক্লান্তি এবং পেশিতে ক্র্যাম্প লাগার মতো আসুবিধা তো রয়েছেই। তাই সাবধান হওয়াটা জরুরি। প্রত্যেক বছরের সাথে সাথে গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ প্রকটতা সাথে বেড়েই চলছে, ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো হিটস্ট্রোক। হিটস্ট্রোক একটি মারাত্মক শারীরিক সমস্যা, যার ফলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। তবে এই গরমে একটু সতর্কতার সাথে চললেই আমরা বাঁচতে পারি এই সমস্যা থেকে।

প্রথমেই জেনে নেই হিট স্ট্রোক কি?

হিট স্ট্রোক : অতিরিক্ত গরমে বাইরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে আমাদের শরীর নিজের ভেতরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার চেষ্টা করে। বাইরের তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আমাদের ত্বকের শিরাগুলো প্রসারিত হয় অতিরিক্ত তাপ বাইরে বের করে দেয়। আবার ঘাম হওয়ার ফলেও আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা শীতল হয়। প্রচণ্ড গরমে অতিরিক্ত ঘামের ফলে আমাদের শরীর থেকে অনেক লবণ ও পানির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাথা ঝিমঝিম করা, বমি বমি ভাব হওয়া, মাংসপেশিতে ব্যথা, প্রচন্ড পিপাসা ইত্যাদি শারীরিক অস্বস্তির দেখা দেয়। এ অবস্থার নাম "হিট ক্র্যাম্প" বা "হিট এক্সোশন"।

অতিরিক্ত গরমে বা আদ্র পরিবেশে অনেকক্ষণ অবস্থান করার ফলে অথবা শারীরিক পরিশ্রম করলে আমাদের শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়ে পরে।

হিট স্ট্রোক হলে আমাদের করণীয় :

* প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের আগেই যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সোশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব।

* আপনার পাশের কোনও ব্যক্তির হিট স্ট্রোক হলে তাকে দ্রুত শীতল কোনও স্থানে নিয়ে যান। ফ্যান বা এসি চালিয়ে দিন।

* ভেজা কাপড়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে রোগীর কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমানোর চেষ্টা করুন।

* যদি হিট স্ট্রোক হয়েই যায়, তাহলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে কিছু পরামর্শ

গ্রীষ্মকালে সূর্যের প্রকটতা এমনি বেশি থাকে। পানির ঘাটতি দেখা দেয়। তাই রোদের তীব্র তাপমাত্রায় আমাদের শরীর দেহ থেকে ঘাম বের করতে অক্ষম হয়ে পরতে পারে। সেহেতু আমারা একটু সতর্কতার সাথে চললেই হিট স্ট্রোক থেকে নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হবো। তাই বেশি বেশি পানি ও পানীয় জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেসকল খাবার আমাদের শরীরকে অনেকক্ষণ সময় পর্যন্ত ডিহাইড্রেড রাখতে পারবে, সেই সকল খাবার গ্রহণ করতে হবে।

কাঁচা আমের শরবত : গ্রীষ্মকালে কাঁচা আম সহজলভ্য। কাঁচা আম খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতে আমের জুড়ি নেই। তাই গ্রীস্মের প্রকটতার থেকে বাঁচতে কাঁচা আমের শরবত ইফতারিতে রাখতে পারি। অথবা কাঁচা আম তরকারি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

তেঁতুলের শরবত : দ্রুত শরীরকে ঠান্ডা করতে তেঁতুলের শরবত অত্যন্ত উপকারী। সাথে চিনি ও লবণের সংযোগে তৈরি করা তেঁতুলের শরবত আরো বেশী সুস্বাদু করে তোলে এবং শরীরকে দ্রুত পানিস্বল্পতা থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও এতে রয়েছে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম যা শরীরকে দীর্ঘক্ষন সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে।

ডাবের পানি : হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে ডাবের পানির মতো প্রাকৃতিক উপাদানের জুড়ি নেই। এটি তাৎক্ষণিকভাবে শরীরকে ঠান্ডা করে এবং শরীরে তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে। অতিরিক্ত গরমে শরীরকে ডিহাইড্রেশন হওয়া থেকেও রক্ষা করে।

দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পিপাসাকে রোধ করে এবং এতে অন্যান্য খনিজ লবণ বিদ্যমান যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী।

আখের শরবত : শরীরে পানি স্বল্পতার সমস্যার জন্য আখের শরবত অনেক উপকারী। এটি তাৎক্ষণিকভাবে শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখে। এছাড়াও আখের শরবত প্রচুর পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং খেতেও সুস্বাদু।

লেবুর শরবত: হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার জন্য লেবুর শরবত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লেবুতে রয়েছে ভিটামিন সি যা শরীরকে দ্রুত সতেজ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর পানীয় যা শরীরের তাপমাত্রা কে স্বাভাবিক করে। এর সাথে ধনিয়া ও পুদিনা মিক্স করে শরবত তৈরি করলে তাও শরীরের জন্য উপকারী।

মাঠা : আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে প্রতিদিন এক গ্লাস মাঠা খাওয়া শরীরের জন্য উপকারী। এটা প্রোবায়োটিক্সয়ের ভালো উৎস এবং গরমে পানিস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। তাই গরমের অস্বস্তি থেকে বাঁচতে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় মাঠা যুক্ত করুন।

অ্যালোভেরার শরবত : রোদপোড়া থেকে বাঁচতে অ্যালোভেরার শরবত অনন্য। এটা হজমে সাহায্য করে, বুক জ্বালাপোড়া কমায় এবং পেটের নানা রকম সমস্যা দূর করে। গরমে প্রতিদিন এক গ্লাস অ্যালোভেরার শরবত পান করলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে আসে।

পেঁয়াজের রস : হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার অন্যতম ভালো উপায় হলো পেঁয়াজের রস। অনেকেই এর ঝাঁজালো স্বাদ পছন্দ করে না। তবে এর রস ঔষধি গুণাগুণ সম্পন্ন। পেঁয়াজের রস গরম থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে।

উপরের বর্ণিত পানীয় গুলো আমাদের শরীরের পানিস্বল্পতা হওয়া থেকে রক্ষা করে। এসকল পানীয় গুলোর মধ্য থেকে নিজের পছন্দনীয় পানি রাখতে চেষ্টা করব। এছাড়াও বেশি বেশি পানি খাওয়ার চেষ্টা করব।

বর্জনীয়

* সফট অথবা হার্ড ড্রিঙ্কস নেওয়া থেকে বিরত থাকুন : অতিরিক্ত গরমে সফট অথবা হার্ড ড্রিঙ্কস নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। ড্রিঙ্কস শরীরের পানিকে নিরূদিত করে যা শরীরে পানি স্বল্পতা তৈরী করে। এছাড়াও ঘন ঘন পানি পিপাসা পায় এবং গলা শুখিয়ে আসে। তাই গরমে সাময়িক তৃষ্ণা মেটাতে অবশ্যই ড্রিঙ্কস না।

* পানি পানের সময় সতর্ক থাকুন : গরমের কারণে যেকোনো জায়গা থেকে পানি পানে বিরত থাকুন। দূষিত পানি থেকে পানিবাহিত রোগ হতে পারে। এজন্য পানি পান করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। বাইরে পানি পান করার ক্ষেত্রে অবশ্যই মিনারেল ওয়াটার গ্রহণ করুন।

* ফাস্টফুডকে না বলুন : ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবারকে না বলুন। ফাস্টফুড এবং তেল চর্বি জাতীয় খাবার শরীরের জন্য খারাপ। গরমে তেলে ভাজা বা রিচ ফুড খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। গরমে এ জাতীয় খাবার যত বেশী খাবেন, তত বেশী গরম লাগবে। সুতরাং এ ধরনের খাবার না খাওয়াই ভালো। স্ট্রীট ফুড বর্জন করুন অতিরিক্ত গরমে।

* স্যালাইন খাওয়ার সময় সতর্ক থাকুন : গরমের কারণে ঘরে থাকতে চাইলেও অনেকেই আছেন শারীরিক পরিশ্রম করেন। তাদেরকে কাজের জন্য বাইরে যেতেই হয়। অনেকেই আছেন দিন আনেন দিন খান। সেক্ষেত্রে যেন শরীরে পানি বা লবণের স্বল্পতা না হয় এই জন্য স্যালাইন খেতে পারেন। বাইরে চলাচলের সময় কাছে স্যালাইন রাখতে পারেন। যদি শরীর দুর্বল মনে হয়, সেক্ষেত্রে সাথে সাথে স্যালাইন খেয়ে নিতে পারেন। এতে দুর্বলতা কমবে। প্যাকেটের গায়ে নির্দেশিত পরিমাণ পানির চেয়ে কম পানি দিয়ে স্যালাইন খাবেন না। শুধু স্যালাইন গুড়া খেলে বা কম পানি দিয়ে স্যালাইন খেলে লবণের ঘনত্ব বেড়ে কিডনির ক্ষতি হতে পারে।

হোমিওসমাধান

রোগ নয় রোগীর চিকিৎসা করা হয় তাই অভিজ্ঞ চিকিৎসকে হিট স্ট্রোক রোগীর রোগের পুরা লক্ষণ নির্বাচন করতে পারলে তাহলে আল্লাহর রহমতে হোমিওতে সম্ভব।বিশেষজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক গন প্রাথমিক ভাবে যেই ঔষধ নির্বাচন করে থাকেন, বেলেডোনা, গ্লোনিয়ম, আর্সেনিক অ্যালম্বা, ব্রায়োনিয়া, কেলকেরিয়া কার্ব, কেলকেরিয়া সালফ, ডালকামারা, হিপার সালফ, কেলি আয়োড, মার্কসল, চায়না, ন্যাট্রাম মিউর, জেলসিয়াম, ন্যাট্রাম সালফ, নাক্স ভম সহ আরো অনেক ঔষধ লক্ষণের উপর আসতে পারে, তাই মেডিসিন নিজে নিজে ব্যবহার না করে বিশেষজ্ঞ হোমিওচিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরামর্শ

এই গরমে নিজের পাশাপাশি পরিবারের যত্ন নিন। বাইরে চলাফেলার সময় বয়স্ক এবং শিশুদের দিকে খেয়াল রাখুন এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দিন যানবাহনে চলাচলের ক্ষেত্রে। তাই প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকব। অতি তাপ এড়িয়ে চলব। ঢিলে ঢালা পোশাক পরিধান করব। প্রয়োজনে ছাতার ব্যবহার করব।কেউ অসুস্থ হলে সচেতনতার সাথে সিদ্ধান্ত নিন।তাই তাপমাত্রার এই চরম অবস্থায় হিটস্ট্রোকের ব্যাপারে প্রতিটি মানুষের সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি, চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test